শৃঙ্খলা পরিপন্থি কর্মকাণ্ড
নেতাকর্মী নিয়ন্ত্রণে হিমশিম বিএনপি
তারিকুল ইসলাম
প্রকাশ: ১৮ আগস্ট ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ফাইল ছবি
রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর সারা দেশে শুরু হয় সহিংসতা। দেশের বিভিন্ন এলাকায় অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড ও সহিংসতায় সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ পাওয়া নেতাদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে যায় দলটি। গত ১২ দিনে বিএনপি ও এর অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের অন্তত ৯০ জন নেতা-কর্মীকে বহিষ্কার করা হয়েছে। এছাড়া কারণ দর্শানোর নোটিশ (শোকজ) ও পদ স্থগিত করা হয়েছে অর্ধশতাধিক নেতাকর্মীর।
দেশের পরিস্থিতি আগের চেয়ে অনেক স্বাভাবিক হলেও এখনও বেশ কয়েকটি জেলায় নেতাকর্মীদের নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খাচ্ছে দলটি। দখল, চাঁদাবাজি, নিজেদের মধ্যে মারামারি ও সহিংসতার তথ্য পাচ্ছেন তারা। এ নিয়ে বিব্রত দলটির নীতিনির্ধারকরা। এ ব্যাপারে আরো কঠোর বার্তা দিয়েছেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও। দলের যে কোনো স্তরের নেতার অন্যায়কে তিনি মেনে নেবেন না-এই বার্তা কঠোরভাবে পালন করার জন্য মহাসচিবসহ শীর্ষ নেতাদেরকে পরামর্শ দিয়েছেন। এক্ষেত্রে তাদের তাৎক্ষণিক কার্যকর ভূমিকা রাখার নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে। বিএনপি সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য।
এদিকে নানা অপকর্মে জড়িতরা বেশিরভাগই ‘অনুপ্রবেশকারী’ বলে দাবি বিএনপি নেতাদের। তাদের মতে, দলের কোনো পদ-পদবিতে নেই। ছিলেন না কোনো কর্মসূচিতে। আন্দোলন-সংগ্রামেও দেখা যায়নি বিগত দিনে। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তারাই এখন বিএনপির ‘নেতাকর্মী’ সেজে গেছেন। দাপট দেখাতে শুরু করেছেন নিজ নিজ এলাকায়। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর বিভিন্ন দখল, চাঁদাবাজি আর অপকর্মে জড়িয়ে পড়ছেন অনেকে।
এ পরিস্থিতিতে ‘অনুপ্রবেশকারী’ কথিত নেতাকর্মীর বিষয়ে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্তও রয়েছে। পাড়া-মহল্লায় প্রতিরোধ কমিটি গঠন করা হয়েছে। রাজধানীসহ বেশ কয়েকটি জেলায় দখল করা বাড়ি, দোকান, ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান বিএনপি ও অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতারা দখলমুক্ত করে প্রকৃত মালিককে বুঝিয়ে দিয়েছেন-এমন ঘটনাও অনেক রয়েছে। শুধু হাইব্রিড নেতাকর্মী নয়, দলের কোনো নেতাকর্মীও অপকর্মে সম্পৃক্ত হলে তাৎক্ষণিক শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
এদিকে অপকর্মকারীদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে তুলে দেওয়াসহ শান্তি ও শৃঙ্খলা রক্ষায় ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নানা নির্দেশনা নিজ নিজ এলাকায় সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন বিএনপি নেতারা। বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, দলের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে এরই মধ্যে নির্দেশনা জারি করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত বিএনপির ওয়ার্ড থেকে জাতীয় পর্যায় এবং অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের ওয়ার্ড থেকে কেন্দ্রীয় কমিটি পর্যন্ত কোনো স্তরেরই কমিটিতে অন্য কোনো রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী বা অরাজনৈতিক ব্যক্তিকে যোগদান করানো যাবে না।
সূত্রমতে, গত ১২ দিনে অন্তত ৯০ জন নেতা-কর্মীকে বহিষ্কার করেছে বিএনপি ও এর অঙ্গ-সহযোগী সংগঠন। তাদের মধ্যে যুবদলের অন্তত ৬০ জন রয়েছেন। এছাড়া ৫০ জনেরও বেশি নেতা-কর্মীকে কারণ দর্শানোর নোটিশ ও পদ স্থগিত করা হয়েছে। বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত নেতাদের মধ্যে হবিগঞ্জ জেলা বিএনপির আহবায়ক আবুল হাশিমও রয়েছেন। আর বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক (বরিশাল বিভাগ) বিলকিস জাহান শিরিনের পদও স্থগিত করা হয়েছে। এসব নেতা পদ ফিরে পেতে আবারও লবিং-তদবির শুরু করেছেন বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে।
তবে একজন নীতিনির্ধারক জানান, যাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ পাওয়া গেছে। তাদের এখনই পদ ফিরিয়ে দেওয়া হলে সারাদেশে ভিন্ন বার্তা যাবে, অন্যরা অপকর্মে আরও উৎসাহ পাবে। এ বিষয়ে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান কঠোর অবস্থানে রয়েছেন, তাকে ভুল বুঝিয়ে বা তদবির করে পদ ফিরে পাওয়া যাবে না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে পরিস্থিতি অনেকটা স্বাভাবিক হলেও এখনও বেশ কিছু জেলায় চলছে চাঁদাবাজি ও দখল। আবার নিজ এলাকার অবস্থান ধরে রাখতে নিজ দলের নেতাকর্মীদের ওপর হামলার ঘটনাও ঘটছে। বিএনপির কেন্দ্রীয় দপ্তর এ বিষয়ে জেলা থেকে অভিযোগও দেওয়া হচ্ছে। খোঁজ নিয়ে দলের কারও সংশ্লিষ্টতা পেলে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিচ্ছে দলটি। তবে এসব অপকর্মের সঙ্গে জড়িতরা বেশিরভাগই ‘অনুপ্রবেশকারী’ বলে তথ্য পেয়েছে দলটি। আবারও কোনো কোনো নেতার বিরুদ্ধে ‘অনুপ্রবেশকারীদের’ নিয়ে পক্ষ ভারি করার অভিযোগও পাওয়া গেছে।
জানা গেছে, গত ১৩ আগস্ট নারায়ণগঞ্জ আড়াইহাজারের কালাপাহারিয়া ইউনিয়নে সরকারি সফর আলী কলেজের সাবেক এজিএস ও আড়াইহাজার থানা যুবদলের যুগ্ম আহবায়ক আবু হানিফের ওপর হামলা হয়।
বিএনপির হাইকমান্ডের নির্দেশনা পেয়ে গ্রামের সাধারণ মানুষদের নিয়ে শান্তি ও সম্প্রীতি বজায় রাখতে বৈঠক শেষে ফেরার পথে তার ওপর অতর্কিত হামলা চালিয়ে গুরুতর আহত করে। তিনি এখন রাজধানীর একটি হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। আবু হানিফ যুগান্তরকে বলেন, ‘কোনো চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী, জ্বালাও-পোড়াও, জুলুম যেন না করা হয়, গ্রামকে সুন্দর করে পরিচালনা করার জন্য ওই বৈঠক করেছিলাম। বৈঠক শেষ করে বের হলে ৭০-৮০ জন লোক পিস্তল ও দেশীয় অস্ত্র নিয়ে আমার ওপর হামলা করে। বিএনপির কেন্দ্রীয় সহসাংগঠনিক সম্পাদক নজরুল ইসলাম আজাদের নির্দেশে আড়াইহাজার উপজেলা ছাত্রদলের সদস্য সচিব মোবারক হোসেনের নেতৃত্বে এই হামলা হয়। অথচ মোবারক এক সময় ছাত্রলীগ করত। ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনেও নৌকা মার্কায় নির্বাচন করেছে, আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ নেতাদের সঙ্গে মিছিল-মিটিংয়ের ছবিও আছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাকে এলোপাতাড়ি কুপিয়েছে। ডান হাতের চারটি রগ কেটে ফেলেছে। চাইনিজ কুড়াল দিয়ে বাম হাতে আটটি কোপ দিয়েছে। পরে স্থানীয় লোকজন আসলে ফাঁকা গুলি করে পালান তারা। আমার ওপর হামলা করার সময় তারা বারবার বলছিল, আজাদ ভাই নির্দেশ দিয়েছে তোকে মেরে ফেলার জন্য। তুই সুমনের (বিএনপির কেন্দ্রীয় সহ-অর্থ বিষয়ক সম্পাদক মাহমুদুর রহমান সুমন) হয়ে নেতৃত্ব দিস। তোরে সরিয়ে দিলে সুমন কারে নিয়ে রাজনীতি করে দেখিয়ে দিব।’
এ বিষয়ে নজরুল ইসলাম আজাদের মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তাকে পাওয়া যায়নি।
বগুড়ার জেলা বিএনপির একজন নেতা জানান, পটপরিবর্তনের পর কয়েকটি উপজেলায় ভোল পালটে আওয়ামী লীগ ক্যাডাররা এখন বিএনপি সেজেছে। তাদের দাপটে এক সময় বিএনপি সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারত না। এখন তারাই আবার বিএনপি হয়ে দাপট দেখাচ্ছে। এরই মধ্যে দখল, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অপকর্মও শুরু করেছে তারা। এতে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ছেন মামলা-হামলার শিকার স্থানীয় বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের ত্যাগী নেতাকর্মী। তারা এসব ‘হাইব্রিড’ ঠেকাতে চেষ্টা করছেন।
বরিশাল, জামালপুর, কুমিল্লাসহ অন্তত দশটি জেলার শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে কথা বলেছে যুগান্তর। তারা জানান, গত ৫ আগস্ট থেকে তারা মাঠে আছেন। উপজেলা পরিষদ, থানা ভবনসহ সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন অফিস রক্ষা করেছেন। দলের হাইকমান্ড সব ইউনিটের নেতাকর্মীকে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়সহ ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষের জানমাল রক্ষার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। তারা আপ্রাণভাবে তা করার চেষ্টা করছি। এরপরও কোনো নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে চাঁদাবাজিসহ অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের প্রমাণ পাওয়া গেলে বহিষ্কারসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে তুলে দেওয়া হবে। আর দলে অনুপ্রবেশকারীদের ঠেকাতে চেষ্টা চলছে। তাদের দলে ঢোকাতে যদি কোনো নেতার ইন্ধন থাকে তাকেও ছাড় দেওয়া হবে না।
দুলুকে শোকজ : এদিকে বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলুকে কারণ দর্শানোর নোটিশ (শোকজ) দেওয়া হয়েছে। এতে আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দলের নয়াপল্টন বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে লিখিত জবাব জমা দিতে বলা হয়েছে। শনিবার এই নোটিশ দেওয়া হয় বলে বিএনপির কেন্দ্রীয় দপ্তর সূত্রে জানা গেছে। বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর স্বাক্ষরে এই নোটিশে বলা হয়, ‘১৬ আগস্ট ‘টিভি-পত্রিকায় খুনি হাসিনার ছবি ও বক্তব্য প্রচার করলে জ্বালিয়ে দেওয়া হবে’ মর্মে আপনি যে বক্তব্য দিয়েছেন তা বিএনপির নীতি ও আদর্শের চরম পরিপন্থি। বিএনপি দেশের একটি উদার ও বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল। এ দলটি কখনোই দখল ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডকে প্রশ্রয় দেয় না।