সশস্ত্র বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের মতবিনিময়
আয়নাঘর ও বিডিআর বিদ্রোহে জড়িতদের বিচার দাবি
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ১৮ আগস্ট ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ফাইল ছবি
রাজধানীর পিলখানায় বিডিআর হত্যার ঘটনায় পুনঃতদন্ত ও নেপথ্যে থাকা ব্যক্তিদের চিহ্নিত করা এবং আয়নাঘর পরিচালনার সঙ্গে যুক্তদের বিচার দাবি করেছেন সশস্ত্র বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা। একই সঙ্গে তারা আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সশস্ত্র বাহিনীর যেসব সদস্য বৈষম্য, নির্যাতন ও গুমের শিকার হয়েছেন তাদের প্রতিকার দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন।
শনিবার রিটায়ার্ড আর্মড ফোর্সেস অফিসার ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের (রাওয়া) হেলমেট হলে আয়োজিত এক মতবিনিময় সভায় বক্তারা এসব দাবি জানান। ‘অবসরপ্রাপ্ত সামরিক বাহিনীর অফিসারগণ’ ব্যানারে ‘৫ আগস্টের সফল বিপ্লব : আমাদের ভাবনা ও আমাদের প্রস্তাবনা’ শীর্ষক এ মতবিনিময় সভার আয়োজন করা হয়।
সভায় বক্তারা ভারতসহ বিভিন্ন দেশের সঙ্গে স্বার্থবিরোধী চুক্তি বাতিল, সংবিধান সংশোধন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহাল, জাতীয় সংগীত পরিবর্তন ও র্যাব বিলুপ্ত করার দাবি জানান। তারা সশস্ত্র বাহিনীর ভেতরে শৃঙ্খলা ভঙ্গের ঘটনায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিককে মাস্টারমাইন্ড উল্লেখ করে তার বিচার দাবি করেন। সেনাবাহিনীর সুনাম রক্ষায় তাদের হেফাজতে থাকা ব্যক্তিদের নাম প্রকাশ ও তাদের পুলিশের কাছে হস্তান্তর করারও দাবি জানান। বসুন্ধরা গ্রুপকে মাফিয়াতন্ত্র উল্লেখ করে এর কার্যক্রম রাষ্ট্রের আওতায় নেওয়ারও দাবি উঠে।
সাম্প্রতিক গণঅভ্যুত্থান নিয়ে বক্তারা বলেন, ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে বাংলাদেশ দ্বিতীয় স্বাধীনতা লাভ করেছে। এ আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে নিহত রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদকে বেসামরিক সর্বোচ্চ খেতাবে ভূষিত কতে হবে। ছাত্র-জনতার আকাঙ্ক্ষা ধারণ করে পদক্ষেপ নেওয়ায় সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানকে ধন্যবাদ দেন সাবেক কর্মকর্তারা।
মুহাম্মদ লুৎফুল হকের উপস্থাপনায় এ মতবিনিময় সভায় গণঅভ্যুত্থানে নিহতদের স্মরণে ১ মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। তাদের রুহের মাগফিরাত ও আহতদের সুস্থতার জন্য দোয়া করা হয়। এতে সশস্ত্র বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কয়েকশ কর্মকর্তা অংশ নেন।
বীর মুক্তিযোদ্ধা লে. কর্নেল (অব.) মানিষ দেওয়ান বলেন, সদ্য বিদায়ি স্বৈরাচারী শাসক শেখ হাসিনা কুমতলব ও দুরভিসন্ধি নিয়ে এ জাতিকে দুভাগে বিভক্ত করে ২০৪১ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ শাসন করার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি স্বাধীনতার চেতনার সপক্ষের শক্তি ও বিপক্ষের শক্তি আখ্যায়িত করে জাতিকে বিভক্ত করেছেন। তার অনুসারীদের যারা তার গুণগান গাইবে, তার সরকারের তল্পিবাহক, যারা তার পদলেহন করবে তারাই স্বাধীনতার সপক্ষের শক্তি। আর যারা তার বিরোধিতা করেছেন তাদেরকে পাকিস্তানের দালাল আখ্যায়িত করেছেন। তবে দুঃখজনক হলো তিনি যাদের রাজাকার বলে আখ্যায়িত করেছিলেন তাদেরই আন্দোলনের ফলে তিনি শুধু ক্ষমতাচ্যুত হননি, দেশত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন। তিনি বলেন, শেখ হাসিনা জীবিত আছেন। কিন্তু এ দেশের মানুষের কাছে আজ তিনি ক্লিনিক্যালি ডেড।
সভায় মানিষ দেওয়ান বলেন, শেখ হাসিনা দলীয় সরকারের অধীনে ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে নির্বাচন করে নিজেকে ক্ষমতায় বসিয়েছেন। কীভাবে নির্বাচন ও সংসদ গঠিত হয়েছে তা সবাই জানেন। আমরা প্রস্তাব রাখতে চাই, সংবিধানে আবার তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ও গণভোটের বিধান সংযোজিত হোক।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সম্পাদিত সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) ও চুক্তি সই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এসব আবার যাচাই করতে হবে। যেসব চুক্তি আমাদের দেশ, সার্বভৌমত্ব ও জনগণের বিরোধী সেগুলো বাতিল করতে হবে। বিশেষ করে ভারতের সঙ্গে যেসব চুক্তি হয়েছে সেগুলো সব বাতিল করতে হবে। সে দেশের সঙ্গে রেল ও সড়ক যোগাযোগ বাতিল করতে হবে।
বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনা প্রসঙ্গে মানিষ দেওয়ান বলেন, ২০০৯ সালে বিডিআর হত্যাকাণ্ডের ঘটনা অনেক সংস্থা তদন্ত করেছে। কোনো তদন্ত প্রতিবেদন আলোর মুখ দেখেনি। আমরা চাই, ওই বিষয়ে একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করা হোক। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অর্থ চুরি হয়েছে। ওই ঘটনায় শেখ হাসিনা কোনো শব্দ করেননি। ওই টাকা ফেরত আনার ঘটনা মাঝপথে থামিয়ে দেওয়া হয়। ঘটনার পরম্পরায় জানা যায়, ওই টাকা পাচারের সঙ্গে স্বয়ং শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় জড়িত। এ ঘটনারও শ্বেতপত্র প্রকাশ করতে হবে।
সাম্প্রতিক ছাত্র-জনতার আন্দোলন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, গণআন্দোলনের সময়ে পুলিশ, বিজিবি ও সেনাবাহিনীর সামনে যারা বুক পেতে দিয়েছেন তাদের কথা জাতি সারা জীবন মনে রাখবে। রংপুরের রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ বুক পেতে পুলিশের গুলিতে আত্মাহুতি দিয়েছেন এবং তার আত্মাহুতিতে শেখ হাসিনার পতন ত্বরান্বিত হয়েছে, তাকে বেসামরিক সর্বোচ্চ খেতাব দিয়ে এই বীরের আত্মাকে সম্মান জানানো উচিত।
সেনাবাহিনীর সুনাম ও নিরাপত্তা রক্ষায় পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানান সাবেক এ কর্মকর্তা। তিনি বলেন, সেনাপ্রধান কদিন আগে বলেছেন, জীবন রক্ষার তাগিদে দলমত নির্বিশেষে কিছু লোককে সেনানিবাসে রাখার ব্যবস্থা করেছেন। তার এ সিদ্ধান্তকে আমরা সম্মান জানাই। যারা ক্যান্টনমেন্টে আশ্রয় নিয়েছেন, তারা দোষী। আমি সেনাপ্রধানের প্রতি সম্মান রেখে তার কাছে আবেদন জানাতে চাই, তাদের পুলিশ হেফাজতে দিয়ে তাদের নিরাপত্তা বিধান করা যায়। তাদের ক্যান্টনমেন্ট থেকে বিতাড়িত করে জেলহাজতে প্রেরণ করুন।
কর্নেল (অব.) মো. আহসান উল্লাহ বলেন, আয়নাঘরের সঙ্গে জড়িতদের বিচার করতে হবে। পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনা পুনঃতদন্ত করে দায়ীদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। দুর্নীতির শ্বেতপত্র প্রকাশ করতে হবে।
সংবিধান সংশোধনের দাবি জানিয়ে মেজর (অব.) এম সরোয়ার হোসেন বলেন, আইন বিভাগ, বিচার বিভাগ ও শাসন বিভাগের মধ্যে যদি ভারসাম্য থাকে তাহলে রাষ্ট্র ভালো থাকে। বাংলাদেশের বর্তমান সংবিধান স্বৈরতন্ত্র সৃষ্টির বড় যন্ত্র। যিনি রাজনৈতিক দলের প্রধান, তিনিই সরকার প্রধান, তিনিই সংবিধান প্রধান আবার তিনিই সবকিছুর প্রধান। এর ব্যালেন্স না থাকলে গণতন্ত্র চর্চা ও স্বৈরতন্ত্র ঠেকানো অসম্ভব। তিনি আরও বলেন, আমাদের অগ্রাধিকার কাজ হচ্ছে-দরকার হলে ২০টি স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল করে সেখানে দুর্নীতিবাজদের বিচার করতে হবে। তাদের সম্পদ জব্দ করে আন্দোলনে হতাহতের দিতে হবে। বিদেশে পাচার করা টাকা ফিরিয়ে আনতে হবে। ভারতের সঙ্গে দেশ ও জনগণের স্বার্থবিরোধী চুক্তি হয়েছে তা রিভিউ করে বাতিল করতে হবে।
বসুন্ধরা গ্রুপকে মাফিয়া আখ্যায়িত করে তিনি বলেন, আমাদের অনেক সাবেক কর্মকর্তা না বুঝে বিভিন্ন কাজে জড়িয়ে গেছেন। একটি ভুয়া ব্যাংক আছে সেখানে চাকরি নিয়েছেন। বিশেষ করে বসুন্ধরা গ্রুপে গিয়ে তাদের মাফিয়াতন্ত্রকে তারা সমর্থন করেন। বসুন্ধরা গ্রুপ একটি মাফিয়াতন্ত্র। তারা জল, বিল, খাল দখল করে। বসুন্ধরা গ্রুপকে রাজউক টেকওভার করতে পারে।
গণআন্দোলনে হতাহতদের সম্মান জানানোর দাবি জানিয়ে কর্নেল (অব.) আব্দুল হক বলেন, আন্দোলনে যে ৬০০ জন শহিদ হয়েছেন তাদের তালিকা করে তাদের পরিবারকে সম্মান জানাতে হবে। যারা আহত হয়েছেন তাদের সহযোগিতা করতে হবে। তিনি বলেন, ১৯৭১ সালে যে বীর পুরুষরা এ দেশ স্বাধীন করেছেন, তাদের ভুলে গেলে চলবে না, তাদের পরিবার আজকে ধ্বংসের শেষ সীমায় চলে গেছে। সেনাবাহিনীর যেসব সদস্যকে বঞ্চিত করা হয়েছে, তাদের পুনর্বাসন করার দাবি জানান তিনি।
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সাইদুর বলেন, মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিক একজন মাস্টারমাইন্ড। তার বিচার করতে হবে। এছাড়াও ২০০৮ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত যেসব সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা নিয়মনীতি ভেঙে সরকারকে অনৈতিকভাবে সাহায্য করেছেন তাদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। বাংলাদেশে ফাইভ স্টার জেনারেল নেই। শেখ হাসিনাকে ফাইভ স্টার জেনারেল করিয়ে আমাদের ফরমাল অনুষ্ঠানে নিয়ে আসত। সাধারণ পাবলিকের সামনে শেখ হাসিনার পা ধরে সালাম দিতে। এই চাটুকারদের আমাদের দরকার নেই।
বিগত দিনে সেনা কর্মকর্তারা নির্যাতনের শিকার হয়েছেন জানিয়ে মেজর (অব.) রেজা বলেন, মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিককে নিয়ে আমার ফেসবুকে একটি পোস্ট দিয়েছিলাম। এ কারণে গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআই ডেকে সারা দিন আমাকে বসিয়ে রেখেছিল। এরপর আমার জীবনে গজব নেমে এসেছিল। তিনি বলেন, সেনাবাহিনীর যত শৃঙ্খলা ভঙ্গ হয়েছে তার সবকিছুর নাটের গুরু তারিক সিদ্দিক। আরেক ঘটনা তুলে ধরে তিনি বলেন, কর্নেল তৌহিদ স্যারকে যে রাতে উঠিয়ে নেওয়ার খবর পেয়ে আমি কয়েকজন অফিসার ও মিডিয়া ব্যক্তিকে ফোনে জানিয়েছিলাম। সেই কারণে আমাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। যে সাংবাদিক ওই বিষয়ে রিপোর্ট করেছিলেন তাকে এবং তার পরিবারকে তছনছ করে ফেলা হয়েছে।
এয়ার কমডোর রশিদুল হক বলেন, আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান দেব। ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা থেকে বাদ দিতে হবে।
কর্নেল মশিউজ্জামান বলেন, ডিজিএফআইর নিয়ন্ত্রণে গত ১২ বছর ধরে আয়নাঘরে যে ব্যবসা চলেছে, তাতে আমাদের সাধারণ মানুষের কাছে জবাবদিহি করতে হচ্ছে। সেনাপ্রধানের উদ্দেশে তিনি বলেন, আইএসপিআরের মাধ্যমে এই বিষয় পরিষ্কার করুন যে, ডিজিএফআই আপনার নিয়ন্ত্রণে নয়, সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের নিয়ন্ত্রণে। বিগত দিনে ডিজিএফআই যা করেছে সেটার জন্য প্রধানমন্ত্রী দায়ী।