পাঁচ হাজার কোটি টাকা লোপাটের পরও বহাল ওয়াসার এমডি তাকসিম এ খান
ছবি: সংগৃহীত
ঢাকা ওয়াসার বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন ও রাজস্ব লোপাটে বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রকৌশলী তাকসিম এ খানের সময়ে ৫ হাজার কোটি টাকার বেশি দুর্নীতি হয়েছে। এতে রাজধানীবাসীর পানি ও পয়ঃসেবার দাম বেড়েছে। বৈদেশিক সহায়তানির্ভর প্রকল্প বাস্তবায়নে এই সংস্থাটি প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছে বলে জানিয়েছেন ঢাকা ওয়াসা কর্মকর্তা ও কর্মচারী ঐক্যপরিষদের নেতারা।
তাদের মতে, পদ্মা (যশলদিয়া) পানি শোধনাগার প্রকল্পের সঞ্চালন লাইন নির্মাণে দুর্নীতি হয়েছে ৬০০ কোটি টাকা, দাশেরকান্দি পয়ঃশোধনাগারের নিুমানের যন্ত্রপাতি ক্রয়ে ৬০০ কোটি টাকা, পানি ও পয়ঃবিলের ৩ হাজার ২২১ কোটি টাকা, ঢাকা ওয়াসা কর্মচারী বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেডের ৬২১ কোটি টাকা।
তারা বলেন, ছাত্র-জনতার আন্দোলনে বিতাড়িত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আত্মীয় বলে তিনি আইনের তোয়াক্কা না করে যা খুশি তাই করেছেন। অন্যায়ভাবে অনেককে চাকরিচ্যুত করেছেন। উচ্চ আদালতের নির্দেশনা দিলেও অনেককে স্বাভাবিক কার্যক্রম করতে দেননি। কয়েকদিন ধরে ঢাকা ওয়াসার কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা তাকে গ্রেফতারের দাবিতে আন্দোলন করছেন। জনরোষে পড়ার ভয়ে নিজ বাসায় না থেকে তিনি এখন হোটেল সোনারগাঁওয়ে অবস্থান করছেন। সেখান থেকে অনলাইনে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নির্দেশ দিচ্ছেন।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা ওয়াসা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান প্রকৌশলী ড. গোলাম মোস্তফা যুগান্তরকে বলেন, অতিষ্ঠ হয়ে ২০২৩ সালের ১৭ মে স্থানীয় সরকার বিভাগে প্রকৌশলী তাকসিমের অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ে চিঠি লিখেছিলাম। মন্ত্রণালয় তার তদন্ত না করে উপরন্তু চার দিনের মাথায় আমাকে সরিয়ে দেয়। দুর্নীতির টাকার জোরে তিনি ধরাকে সরাজ্ঞান করেছেন। পাশাপাশি তাকে রাজনৈতিকভাবে সহায়তা করা হয়েছে।
তিনি বলেন, ঢাকা ওয়াসায় প্রকৌশলী তাকসিমের সময়ে ভয়াবহ অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে; তা খুবই পরিষ্কার। পদ্মা (যশলদিয়া), দাশেরকান্দি পয়ঃশোধনাগার প্রকল্পে সঠিক তদন্ত করলে তা পরিষ্কার হয়ে যাবে। এছাড়া আরও যেসব প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে, সেগুলোও সরকার তদন্ত করতে পারে। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) একবার তদন্ত শুরু করে রহস্যজনক কারণে থেমে যায়। মন্ত্রণালয়কে তিনি নিজ হাতের পুতুলে পরিণত করেছেন।
তিনি জানান, এখন পরিবর্তিত সময়; মন্ত্রণালয় বা দুদক চাইলে সঠিক তদন্ত করতে পারবে। এক্ষেত্রে বর্তমান সরকারকে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। ঢাকা ওয়াসা থেকে এই জগদ্দল পাথরকে না সরালে রাজধানীবাসীকে পানি ও পয়ঃসেবা পেতে বহুগুণ বেশি অর্থ গুনতে হবে। পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ এই নগর সংস্থাটি আরও ধ্বংস হয়ে যাবে। এজন্য বর্তমান সরকারের সংশ্লিষ্টদের তার দুর্নীতির বিষয়গুলো নিখুঁতভাবে তদন্ত করে দেখার অনুরোধ জানাব। জনরোষের ভয়ে তিনি এখন বাসায় না থেকে পাঁচতারকা হোটেল সোনারগাঁওয়ে অবস্থান করছেন বলে জানতে পেরেছি।
ঢাকা ওয়াসা কর্মকর্তা-কর্মচারী ঐক্যপরিষদ বিগত সময়ে ঢাকা ওয়াসায় সংঘটিত অনিয়ম ও দুর্নীতির একটি হিসাব কষেছেন। তাদের হিসাব অনুযায়ী-প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত দাশেরকান্দি পয়ঃশোধনাগার প্রকল্প নির্মাণে নিুমানের যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে কমপক্ষে ৬০০ কোটি টাকার দুর্নীতি করেছেন। এছাড়া এ প্রকল্পের নেটওয়ার্ক না করে মূল প্রকল্প বাস্তবায়ন করায় সেখান থেকে কোনো সুফল মিলছে না। এতে সেখানে কোনো বাসা-বাড়ির বর্জ্য যেমন শোধন করা যাচ্ছে না, তেমনি কোনো রাজস্বও আদায় হচ্ছে না।
শোধনাগারের প্ল্যান্ট চালু রাখতে হাতিরঝিলের ময়লা পানি সেখানে নিয়ে শোধন করা হচ্ছে। এতে ঢাকা ওয়াসার বছরে গচ্চা যাচ্ছে ৫১২ কোটি টাকা; ২০২৭ সালে ঋণের কিস্তি পরিশোধ শুরু হলে বছরে ক্ষতির পরিমাণ বেড়ে দাঁড়াবে প্রায় ৮২৫ কোটি টাকা। ২ বছর আগে প্রকল্প চালু হলেও এখন পর্যন্ত কোনো সঞ্চালন লাইন (নেটওয়ার্ক) প্রকল্প প্রস্তাব করেনি। এই মুহূর্তে সঞ্চালন লাইনের প্রক্রিয়া শুরু করলেও বাস্তবায়নে অন্তত ১০ বছর সময় লাগবে। ততদিনে পয়ঃশোধনাগারের যন্ত্রপাতি অকেজো হয়ে পড়বে।
একই চিত্র পদ্মা-যশলদিয়া পানি শোধনাগার প্রকল্পেও। মূল সঞ্চালন লাইনে নির্মাণে নিুমানের পানি ও যন্ত্রপাতি ব্যবহারে আত্মসাৎ হয়েছে প্রায় ৫০০ কোটি টাকা। এ প্রকল্পে সরবরাহ লাইন তৈরি না করে প্রকল্প চালু করায় দৈনিক ৪৫ কোটি লিটার পানি উৎপাদন হওয়ার কথা থাকলেও অর্ধেকেরও কম উৎপাদন হচ্ছে। ফলে ২০১৯-২০ অর্থবছর থেকে ঢাকা ওয়াসার গচ্চা গেছে ১৪২ কোটি টাকা। আর ঋণের কিস্তি পরিশোধ শুরু হওয়ায় চলতি অর্থবছর থেকে গচ্চা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৫০ কোটি টাকা। এ প্রকল্পের পদে পদে দুর্নীতি হয়েছে; ওয়ারেন্টি পিরিয়ডের মধ্যেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হয়েছে ১০৫ কোটি টাকা। ঢাকা ওয়াসার ফান্ডে টাকা থাকলেও বহস্যজনক কারণে এই প্রকল্পের সরবরাহ রাইন করা হচ্ছে না।
ঐক্যপরিষদের নেতাদের হিসাব মতে, ২০১৪-২০১৫ অর্থবছর থেকে ২০২২-২০২৩ অর্থবছর পর্যন্ত সময়ে ঢাকা ওয়াসার ৩ হাজার ২২১ কোটি টাকা খোয়া গেছে। পানির দাম ও গ্রাহক সংখ্যা বৃদ্ধি, বিলিং পদ্ধতি ডিজিটাইজেশন হওয়ার পরও সংস্থার দায়িত্বপ্রাপ্তদের চুরি, অবহেলা ও অদক্ষতার কারণে এই বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আদায় থেকে সংস্থা বঞ্চিত হচ্ছে। ২০০৯-২০১০ অর্থবছরে সংস্থার সিস্টেম লস ছিল ৩৪.৮২ শতাংশ এবং বর্তমানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৪.৮২ শতাংশ; অথচ ঢাকা ওয়াসার বর্তমান প্রশাসন দাবি করছে ঢাকা ওয়াসার সিস্টেম লস ২০ শতাংশ।
তারা বলেন, সমবায় আইন অমান্য করে ঢাকা ওয়াসা কর্মচারী বহুমুখী সমবায় সমিতি থেকে ৬২১ কোটি টাকা লোপাট হয়েছে। এছাড়া সমিতির মালামাল বিক্রি করা হয়েছে। তার আনুমানিক মূল্যও প্রায় শতকোটি টাকা। ২০১০ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে সমবায় অধিদপ্তরের তদন্তে ৩৩২ কোটি ৫২ লাখ টাকা লোপাটের প্রতিবেদন এসেছে। এরপর বাকি টাকা লোপাট হয়েছে। প্রকৌশলী তাকসিম এ খানের ছত্রছায়ায় দুর্নীতি হওয়ায় তাদের কারও বিরুদ্ধে কোনো ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি।
তারা জানান, প্রকৌশলী তাকসিম এ খানের ১৫ বছরে রাজধানীবাসীকে ন্যূনতম সেবা না দিয়ে অর্থ আদায়েরও নানা উদাহরণ রয়েছে। নগরীতে পয়ঃসেবা না থাকলেও বছরে এ খাতে নগরবাসীর কাছ থেকে ৪০০ কোটি টাকা আদায় করা হয়েছে। ঢাকা ওয়াসার এমডির প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ২০২৪ সালে ভূ-উপরিস্থ উৎস থেকে ৭০ শতাংশ এবং ভূগর্ভস্থ উৎস থেকে ৩০ শতাংশ পানি উৎপাদনের ঘোষণা ছিল। বাস্তবে তার ধারেকাছেও যেতে পারেনি। এখনো ঢাকা ওয়াসার মোটর পানির ৭৬ শতাংশ ভূগর্ভস্থ উৎস থেকে উত্তোলন করা হচ্ছে। আর ভূ-উপরিস্থ উৎস থেকে নেওয়া হচ্ছে ২৪ শতাংশ।
তারা আরও জানান, ঢাকা ওয়াসায় পদোন্নতিতে তার সময়ে জ্যেষ্ঠতা মানা হয়নি। অবৈধ অর্থের লেনদেন পাকাপোক্ত করতে সিনিয়রদের ডিঙিয়ে জুনিয়রদের পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। তার কাজে যারা সহযোগিতা করেছেন, তাদের আর্থিকভাবে লাভবান করার পাশাপাশি বিদেশ ভ্রমণেরও সুযোগ করে দিয়েছেন। তার সময়ে অর্ধশত কর্মকর্তা-কর্মচারীর সমন্বয়ে সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন। লোপাট নির্বিঘ্ন করতে তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন তারা।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা ওয়াসা কর্মকর্তা-কর্মচারী ঐক্যপরিষদের সভাপতি প্রকৌশলী মো. মোজাম্মেল হক যুগান্তরকে বলেন, প্রকৌশলী তাকসিম এ খানের সময়ে ঢাকা ওয়াসায় ভয়াবহ অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে। তার একটি হিসাবও আমরা করেছি। সেটা স্থানীয় সরকার উপদেষ্টার কাছে আগামীকাল জমা দেওয়া হবে।
তিনি বলেন, প্রকল্প বাস্তবায়ন ও পানি ও পয়ঃবিলে টাকা থেকে ৫ হাজার কোটি টাকার বেশি দুর্নীতি করেছে। এতে করে প্রকল্পগুলো রুগ্ণ হয়ে পড়েছে। যেখানে এখন শত শত কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হচ্ছে ঢাকা ওয়াসাকে। বৈদেশিক সহায়তা নিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন করে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা ঋণগ্রস্ত করে ফেলেছে সংস্থাকে। এই দুর্নীতিবাজ এমডিকে আমরা আর চাই না।
তিনি জানান, জনরোষের ভয়ে প্রকৌশলী তাকসিম বাসা ছেড়ে হোটেল সোনারগাঁওয়ে অবস্থান করছে বলে জানতে পেরেছি। বর্তমান সরকারের কাছে দাবি জানাব, সে যেখানে থাকুক সেখান থেকে তাকে গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনা হোক। তিনি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ভয়ে অফিসে না এলেও দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেটের সঙ্গে জুমে মিটিং করছে বলে শোনা গেছে। সব দুর্নীতিবাজকে আইনের আওতায় আনতে হবে।
এ বিষয়ে ঢাকা ওয়াসার উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. সৈয়দ মোহাম্মদ গোলাম ইয়াজদানী যুগান্তরকে বলেন, প্রকৌশলী তাকসিম এ খানের অন্যায় নির্দেশ না মানায় সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে আমাকে বরখাস্ত করা হয়। উচ্চ আদালত ২০২৩ সালের ১০ জুন তা বাতিল করলেও তাকে তিনি কাজে যোগদান করতে দেননি।
তিনি বলেন, প্রকৌশলী তাকসিম এ খানের অনিয়ম ও দুর্নীতির শত শত প্রমাণ রয়েছে। বর্তমান সরকারকে অনুরোধ জানাব সেসব অনুসন্ধান করে তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে। আর তিনি যাতে কোনোভাবে পালিয়ে যেতে না পারেন সেদিকেও সংশ্লিষ্টদের খেয়াল রাখার অনুরোধ জানাব। তিনি আমেরিকার পাসপোর্টধারী, তার পরিবারের সদস্যরা সেখানে থাকেন, যে কোনো সময় তিনি পালিয়েও যেতে পারেন।