Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

নয়াপল্টনের সমাবেশে ভিডিও বক্তব্যে খালেদা জিয়া

প্রতিহিংসা নয়, শান্তির সমাজ চাই

নিরাপত্তাহীন মানুষের পাশে ঢাল হিসাবে দাঁড়ান -তারেক রহমান * ৩ মাসের মধ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নির্বাচন করবে : মির্জা ফখরুল

Icon

যুগান্তর প্রতিবেদন

প্রকাশ: ০৮ আগস্ট ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

প্রতিহিংসা নয়, শান্তির সমাজ চাই

ছবি: সংগৃহীত

ধ্বংস, প্রতিশোধ, প্রতিহিংসা নয়; ভালোবাসা, শান্তি ও জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। তিনি বলেন, তরুণরা যে স্বপ্ন নিয়ে বুকের রক্ত ঢেলে দিয়েছেন-সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে মেধা, যোগ্যতা ও জ্ঞানভিত্তিক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হবে। মানবাধিকার, সামাজিক ন্যায়বিচার ও সাম্যের ভিত্তিতে নির্মাণ করতে হবে শোষণহীন সমৃদ্ধ বাংলাদেশ। বুধবার বিকালে রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে এক সমাবেশে সংক্ষিপ্ত ভিডিও বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। সাড়ে ৬ বছর পর দলের সমাবেশে বক্তব্য দেন সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী। এর একদিন আগে মঙ্গলবার নির্বাহী আদেশে দণ্ডাদেশ মওকুফ করে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়। রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ভিডিও বার্তায় দেশবাসীর উদ্দেশে কথা বলেন তিনি।

অনেকদিন পর দলীয় প্রধানের বক্তব্য শুনে সমাবেশে উপস্থিত নেতাকর্মীরা আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর প্রথমবারের মতো ঢাকায় এই সমাবেশে বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী অংশ নেন। এমনকি অসংখ্য সাধারণ মানুষ খালেদা জিয়ার বক্তব্য শোনার জন্য সমাবেশের আশপাশে ভিড় করেন।

খালেদা জিয়া বলেন, ‘দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকার পর আপনাদের সামনে কথা বলতে পারার জন্য আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করছি। আমার কারাবন্দি অবস্থায়, আপনারা আমার রোগ মুক্তি ও কারামুক্তির জন্য সংগ্রাম করেছেন, দোয়া করেছেন, সেজন্য আমি আপনাদের সবাইকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।’

সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রাম ও ত্যাগের বিনিময়ে আমরা ফ্যাসিবাদী অবৈধ সরকারের কাছ থেকে মুক্তি পেয়েছি। আমি আন্তরিক ধন্যবাদ জানাতে চাই আমাদের বীর সন্তানদের, যারা মরণপণ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এই অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন। শত শত শহিদের প্রতি জানাই শ্রদ্ধা। এই বিজয় আমাদের জন্য নতুন সম্ভাবনা নিয়ে এসেছে।’

সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তুলতে কাজ করার আহ্বান জানিয়ে খালেদা জিয়া বলেন, ‘দীর্ঘদিনের নজিরবিহীন দুর্নীতি, গণতন্ত্রের ধ্বংসস্তূপের মধ্য থেকে আমাদের নির্মাণ করতে হবে এক সমৃদ্ধ বাংলাদেশ। ছাত্র-তরুণরাই আমাদের ভবিষ্যৎ। তরুণরা যে স্বপ্ন নিয়ে বুকের রক্ত ঢেলে দিয়েছে, সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে মেধা, যোগ্যতা ও জ্ঞানভিত্তিক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হবে। সব ধর্মের, গোত্রের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। শান্তি, প্রগতি আর সাম্যের ভিত্তিতে আধুনিক বাংলাদেশ নির্মাণে আসুন আমরা তরুণদের হাত শক্তিশালী করি। ধ্বংস নয়, প্রতিশোধ নয়, প্রতিহিংসা নয়, ভালোবাসা, শান্তি ও জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গড়ে তুলি।’

এর আগে ভার্চুয়ালি প্রধান অতিথির বক্তব্য দেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। শুরুতেই তিনি বিপ্লবের জন্য ছাত্র-জনতাকে বীরোচিত অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, পুরো বাংলাদেশ আজ কারামুক্ত। বিগত ১৫ বছর ধরে দেশটিকে বন্দি করা ফেলা হয়েছিল। আয়নাঘরমুক্ত আজ দেশ। আজ উন্মুক্ত হয়েছে বাংলাদেশের দ্বার। মুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশ।

ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, রাজনৈতিক ও রাষ্ট্র পরিচালনায় গুণগত পরিবর্তন আনতে না পারলে এই বিপ্লবে কাঙ্ক্ষিত ফল মিলবে না। সাড়ে ১২ কোটি ভোটের অধিকার কেড়ে নিয়েছিল স্বৈরাচার শেখ হাসিনা। স্বৈরাচার ও গণহত্যাকারী হাসিনার পতনের মধ্য দিয়ে হাজারো শহিদের রক্তে রঞ্জিত বিপ্লবের প্রথম ধাপ সফল হয়েছে মাত্র। ছাত্র-জনতার এ বিপ্লবের চূড়ান্ত লক্ষ্য একটি বৈষম্যহীন গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ। তাই বিপ্লবের লক্ষ্য বাস্তবায়নে দ্রুততম সময়ের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে হবে। দ্রুত সময়ের মধ্যে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। স্বৈরাচার হাসিনা সরকারের পতনে রক্তে রঞ্জিত বিপ্লবকে সার্থক এবং সফল করে আসুন দেশের নাগরিক হিসাবে আমরা আরও দায়িত্বশীল আচরণ করি। বিভেদ, বিরোধ, হিংসা, প্রতিহিংসা নয়, আসুন সবাই মিলে রাষ্ট্র এবং সমাজে মুক্তিযুদ্ধের মূলমন্ত্র সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠা করি। নতুন প্রজন্মের জন্য দুর্নীতিমুক্ত এবং জবাবদিহিমূলক একটি নিরাপদ গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ে তুলতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করি।

তারেক রহমান বলেন, হাজারো শহিদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার গৌরবকে কালিমালিপ্ত করার ষড়যন্ত্র এর মধ্যে আবার শুরু হয়েছে। দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করতে সারা দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টির ষড়যন্ত্র স্পষ্ট হয়ে উঠছে। প্রশাসনের প্রতি আহ্বান, শক্ত হাতে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ করুন। প্রতিটি মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করুন। ধর্ম, বর্ণের পরিচয়ের কারণে কেউ যেন নিরাপত্তাহীনতায় না থাকেন সবার আগে সেটি নিশ্চিত করতে হবে। ষড়যন্ত্রকারীদের এই নৈরাজ্যের কাছে আমরা হার মানতে পারি না। এই মুহূর্তে সবচেয় বড় ও জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল হিসাবে সারা দেশের বিএনপির সর্বস্তরের নেতাকর্মীর প্রতি আহ্বান রেখে বলতে চাই, আপনারা যে যেখানে বসবাস করেন, সেখানেই আপনার বন্ধু কিংবা পাড়া-প্রতিবেশী তিনি মুসলমান, বৌদ্ধ, হিন্দু, খ্রিষ্টান ধর্মীয় পরিচয় যাই হোক না কেন, বিশ্বাস যাই হোক না কেন তার নিরাপত্তায় আপনি ঢাল হিসাবে দাঁড়িয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করুন। আমাদের মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশে ভূখণ্ডে বসবাসকারী প্রত্যেকটি মানুষের একটিই পরিচয়, আমরা বাংলাদেশি।

ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আরও বলেন, আরেকটি বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই, একটি সভ্য ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পুলিশ অপরিহার্য। পুলিশ জনগণের শত্রু নয়। গণহত্যাকারী হাসিনা বিনা ভোটে ক্ষমতায় থাকার জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জনগণের শত্রু হিসাবে দাঁড় করিয়েছে। তবে বিএনপি বিশ্বাস করে, দেশের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলোরও বিশ্বাস, পুলিশের ভেতরে একটি চক্র ছাড়া অধিকাংশ পুলিশ কর্মকর্তা এবং সদস্য চাকরিবিধি ও দেশের আইনকানুন মেনেই দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করছেন। হাসিনা পালানোর পর বর্তমানে সুকৌশলে একটি চক্র পুলিশের মনোবল ভেঙে দেওয়ার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে। পুলিশকে অকার্যকর করে দেওয়া গেলে তাদের পক্ষে দেশকে অস্থিতিশীল করা সহজ হবে। ধর্মীয় সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর মনে নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি করাও সহজ হবে। তাই এই মুহূর্ত থেকে হামলা কিংবা নৈরাজ্য বন্ধ করতে হবে। এমনকি কেউ বিএনপির নাম ব্যবহার করে কোনো অপকর্ম করতে চাইলে তাকে ধরে আইনের হাতে তুলে দিন। পুলিশের বিরুদ্ধে কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে যথানিয়মে অভিযোগ দায়ের করুন। দেশবাসীর প্রতি বিনীত আহ্বান-কেউ দয়া করে নিজের হাতে আইন তুলে নেবেন না। দয়া করে প্রতিহিংসা, প্রতিশোধে লিপ্ত হবেন না। বিচারের ভার নিজের হাতে তুলে নেবেন না। শুধু দৃষ্টান্ত অনুসরণ নয়, নিজেই দায়িত্বশীলতা এবং মানবাধিকারের দৃষ্টান্ত স্থাপন করুন।

সভাপতির বক্তব্যে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর রাষ্ট্রপতির কাছে আহ্বান জানিয়ে বলেন, অনতিবিলম্বে সবার দাবি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করুন। বিলম্ব না করে সেই সরকার ৩ মাসের মধ্যে নির্বাচন করবে। সেই ব্যবস্থা তারা (অন্তর্বর্তীকালীন সরকার) করবেন। সেজন্য জনগণ ও আমরা সব ধরনের সহযোগিতা করব।

আন্দোলনে শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তিনি বলেন, ছাত্র-জনতার আন্দোলনে যে বিজয় হয়েছে, সেই বিজয়কে সুসংহত করা আমাদের কাজ। আমাদের নেতাকর্মীদের বারবার আহ্বান করেছি যে, আপনারা সবাই শান্ত থাকবেন। কেউ যেন ষড়যন্ত্র করে এই বিজয় ছিনিয়ে নিতে না পারে। বিভিন্ন শহর, বন্দরে যারা ভাঙচুর, লুটপাট করছে, তারা কেউ আমাদের দলের (বিএনপি) নয়। তারা ছাত্রদলের কিংবা ছাত্র-জনতার আন্দোলনের কেউ নয়। তারা দুর্বৃত্ত, দুষ্কৃতকারী। যারা এই দেশের গণতন্ত্র ধ্বংস করতে চায় তারা তাদেরই লোক। বারবার আমাদের বিজয় ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। এই বিজয় যেন ছিনিয়ে নিতে না পারে সেজন্য সবাই সজাগ ও সাবধান থাকবেন।

স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, অত্যাচার-অনাচার করার জন্য যারা শেখ হাসিনাকে সহযোগিতা করেছেন তাদের কাউকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে নেওয়া যাবে না।

স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেন, যারা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে, বিভিন্ন এলাকায় গণ্ডগোল করার চেষ্টা করছে, তারা হুঁশিয়ার হয়ে যান।

স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, শেখ হাসিনা পালিয়েছে, তবে তার প্রেতাত্মা এখনো দেশে রয়েছে। তাদের হাত থেকে সাবধান। আমাদের দাবি দ্রুত সময়ের মধ্যে জনগণের নির্বাচনে নির্বাচিত সরকারের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করা।

স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, আজকে নতুন যে বাংলাদেশ হয়েছে, তা বিনষ্ট করার জন্য ষড়যন্ত্র চলছে। এজন্য সবাইকে সজাগ থাকতে হবে। গণতন্ত্র, অর্থনীতি, রাজনীতি ও সাংবিধানিক অধিকার সব নাগরিকের জন্য নিশ্চিত করতে হবে।

বিএনপির প্রচার সম্পাদক সুলতান সালাউদ্দিন টুকুর সঞ্চালনায় সমাবেশে আরও ছিলেন-স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান, সেলিমা রহমান, ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শাজাহান, বরকতউল্লাহ বুলু, নিতাই রায় চৌধুরী, আব্দুল আউয়াল মিন্টু, অধ্যাপক এজেডএম জাহিদ হোসেন, ড. আসাদুজ্জামান রিপন, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমানউল্লাহ আমান, সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবির খোকন, হাবিব উন নবী খান সোহেল, শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি, আব্দুস সালাম আজাদ, ঢাকা মহানগর উত্তরের সাইফুল আলম নীরব, আমিনুল হক, দক্ষিণের রফিকুল আলম মজনু, তানভীর আহমেদ রবীনসহ কেন্দ্রয় ও অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের শীর্ষ নেতারা।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম