Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

সড়কে লাখো মানুষের মিছিল

রাজপথে ছাত্র-জনতার বিজয়োল্লাস, বৈষম্যহীন দেশগড়ার প্রত্যয়

Icon

যুগান্তর প্রতিবেদন

প্রকাশ: ০৬ আগস্ট ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

রাজপথে ছাত্র-জনতার বিজয়োল্লাস, বৈষম্যহীন দেশগড়ার প্রত্যয়

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের খবরে বিজয়োল্লাসে ফেটে পড়েন লাখ লাখ ছাত্র-জনতা। শিক্ষার্থীদের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে রাস্তায় নামেন শিক্ষক-অভিভাবকসহ জনতা। ছাত্র-জনতার দাবির পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশছাড়ার খবর প্রকাশ হলে বিজয়োল্লাসে রাজপথে মানুষের ঢল নামে। বিকাল ৪টায় টেলিভিশনে সেনাপ্রধানের বক্তব্যের পর প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের বিষয়ে মানুষ নিশ্চিত হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের বিজয় মিছিলে কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে ওঠে রাজপথ। রাজধানীর মূল সড়কসহ প্রতিটি অলিগলিতে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে দলে দলে যোগ দেন আপামর জনতা। দেশের গুরুত্বপূর্ণ সড়ক-মহাসড়কগুলোও কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায়। শিক্ষার্থীরা বলছেন, স্বৈরাচার সরকারের পতনে সাধারণ মানুষ দেড় দশকের নির্যাতন-নিপীড়নের হাত থেকে মুক্তি পেয়েছে। এখন হাতে হাত রেখে বৈষম্যহীন দেশগড়ার প্রত্যয় তাদের।

সরেজমিন দেখা যায়, বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ ও দেশত্যাগের খবরে রাজপথে নেমে আসে সর্বস্তরের ছাত্র-জনতা। তারা স্লোগান দেন, ‘এই মুহূর্তে খবর এলো শেখ হাসিনার পতন হলো’, ‘হই হই রই রই, হাসিনা গেল কই’, ‘আমার ভাইয়ের রক্ত বৃথা যেতে দেব না’-এমন নানা স্লোগান দিতে থাকেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, শাহবাগ, সায়েন্সল্যাব, মিরপুর, বাড্ডা, রামপুরাসহ নগরীর সব মোড়ে মোড়ে ছিল বিজয় মিছিল।

এর আগে সরকার পতনের এক দফা দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ‘লংমার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচির ডাকে সাড়া দিয়ে সকাল থেকে দেশের বিভিন্ন সড়কে অবস্থান নেওয়ার চেষ্টা করেন তারা। সোমবার সকাল ১০টায় রাজধানীর শাহবাগ চত্বরে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর কড়া অবস্থান দেখা যায়। একপর্যায়ে কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে শিক্ষার্থীরা জড়ো হন। সকাল ১০টার দিকে ৬-৭টি সাঁজোয়া যানসহ কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে উপস্থিত হয় একদল পুলিশ। এ সময় শহিদ মিনারে জড়ো হওয়া লোকজনকে সেখান থেকে সরে যাওয়ার কোনো সুযোগ না দিয়েই গুলি চালানো হয়। পাশাপাশি টিয়ার গ্যাস ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করা হয়। পরে ছত্রভঙ্গ হয়ে শিক্ষার্থীরা চানখারপুলের দিকে আশ্রয় নেন। কিছু শিক্ষার্থী ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও পলাশীর দিকে চলে যান।

বেলা ১১টার দিকে ঢাবির রাজু ভাস্কর্যে কারফিউ ভেঙে সংহতি সমাবেশ করে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের সংগঠন ইউনিভার্সিটি টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইউট্যাব)। তাদের সমাবেশে বাধা দেয় পুলিশ। কেড়ে নেওয়া হয় তাদের ব্যানার। এ সময় সাধারণ শিক্ষার্থীরা যোগ দিলে তাদের নিয়ে ঢাবির ভিসি চত্বরের দিকে চলে যান শিক্ষকরা। এরপর বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ছোট ছোট দল নিয়ে শাহবাগ মোড়ে জড়ো হন আন্দোলনকরীরা। ছাত্র-জনতার উপস্থিতি বৃদ্ধি পাওয়ায় পুলিশ-সেনাবাহিনী তাদের অবস্থান নমনীয় করে ফেলে। সাড়ে ১১টার দিকে শাহবাগ এলাকা আন্দোলনকারীদের দখলে চলে যায়।

শাহবাগ দখলের খবর শুনে রাজধানীর আশপাশের মানুষও শহবাগের দিকে রওয়ানা দেন। এরপর থেকে দলে দলে মিছিল নিয়ে মতিঝিল, পল্টন, ধানমন্ডি, মিরপুর, মালিবাগ, শনির আখড়া, আজিমপুর ও পুরান ঢাকার বিভিন্ন স্থান থেকে ছাত্র-জনতা শাহবাগ আসতে থাকে। তাদের অনেকের হাতে পতাকা, কারও হাতে লাঠি দেখা গেছে। কাউকে আবার ‘ভি’ চিহ্ন দেখিয়ে বিজয়োল্লাস করতে দেখা যায়। অনেক শিক্ষার্থীকে সোনাবাহিনীর সঙ্গে হাত মেলাতে, কোলাকুলি করতেও দেখা গেছে। অনেককে ‘এই মুহূর্তে দরকার, সেনাবাহিনী সরকার’, ‘দফা এক দাবি এক, শেখ হাসিনার পদত্যাগ’, ‘এক দুই তিন চার, শেখ হাসিনা গদি ছাড়’, ‘আমার ভাইয়ের রক্ত বৃথা যেতে দেব না’, ‘রক্তের বন্যায় ভেসে যাবে অন্যায়’ ইত্যাদি স্লোগান দিতেও দেখা গেছে।

বিকাল ৪টা নাগাদ শাহবাগ চত্বর, টিএসসি, শহিদ মিনার, ভিসি চত্বর, দোয়েল চত্বর, হাইকোর্ট এলাকা, বাংলামোটর এলাকায় লাখ লাখ লোক জমায়েত হয়। বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে ঢাবি ভিসির বাসভবনে একদল শিক্ষার্থী ভাঙচুর চালায়। তবে ঢাবি শিক্ষার্থীদের বাধার কারণে বাসভবনে তেমন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। এ সময় টিএসসি থেকে চ্যানেল টুয়েন্টিফোরের একটি গাড়ি নীলক্ষেতের দিকে যেতে চাইলে পথে আটকে গাড়ি ভাঙচুর ও সাংবাদিকদের মারধর করেন আন্দোলনকারীরা।

এ সময় রাজধানীর হলিক্রস স্কুলের শিক্ষার্থী আয়শ সিদ্দীকা যুগান্তরকে বলেন, আমরা এতদিন আমার ভাই-বোনদের মৃত্যু দেখেছি আর অশ্রু বিসর্জন দিয়েছি। আজ আমাদের আনন্দের দিন স্বৈরাচারী সরকারের পতন হয়েছে।

প্রাইম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষর্থী মিজানুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, আজ আমরা আবার স্বাধীনতার স্বাদ পেয়েছি। স্বৈরাচারের কাছ থেকে মুক্তি পেয়েছি। একাত্তর দেখিনি, চব্বিশ দেখেছি। সব ক্ষমতার উৎস জনগণ, সেটা আবারও প্রমাণিত হয়েছে। এখন আমাদের পুনরায় পাওয়া স্বাধীনতাকে রক্ষা করতে হবে। কারণ, স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে রক্ষা করা কঠিন।

মোহাম্মদপুর থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে আসা এনজিওকর্মী কাজী ফারহানা তাসনিম রাহা যুগান্তরকে বলেন, প্রকৃত অর্থে এখন স্বাধীনতার স্বাদ অনুভব করছি। পরিশেষে নিজেকে দেশের মালিক বলে মনে হচ্ছে। এটা আবারও প্রমাণিত হলো-বাঙালি স্বাধীনতায় বিশ্বাসী।

সোমবার সন্ধ্যা ৭টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস এলাকায় সরেজমিন দেখা যায়, লাখো জনতার কারণে শাহবাগ ও ঢাবির টিএসসি এলাকায় দাঁড়ানোর ঠাই নেই। কারও হাতে পতাকা, কারও হাতে বাঁশি। উল্লাসে অনেক শিক্ষার্থী ঢোল নিয়ে আসছেন। বাঁশি ও ঢোলের তালে তালে অনেক শিক্ষার্থীকে নাচতে দেখা গেছে। তৃষ্ণার্ত আন্দোলনকারীদের পানি দিয়ে সহায়তা করছেন অনেকে। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের এ সফলতা দেখাতে স্ত্রী-সন্তানকেও নিয়ে এসেছেন অনেক অভিভাবক।

রাজধানীর রামপুরা ব্রিজ এলাকায় আনন্দ-উল্লাস করেছেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। তারা সেনাসদস্যদের উদ্দেশ করে থ্যাংক ইউ, থ্যাংক ইউ বলে স্লোগান দেন। একই সঙ্গে তারা কর্তব্যরত সেনাবাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে কোলাকুলি করেন। মার্চ টু ঢাকা কর্মসূচিতে যোগ দিতে সকাল থেকে বাড্ডা, রামপুরা এলাকায় উপস্থিত ছিলেন ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি, ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি, ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি, আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, সাউথ ইস্ট ইউনিভার্সিটি, আহ্ছানউল্লাহ ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটি, ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অব স্কলার্স, ভিকারুননিসা কলেজ, ইম্পেরিয়াল কলেজ এবং রামপুরার আশপাশের অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা।

বিজয়োল্লসিত শিক্ষার্থীরা বলেন, বাংলাদেশে ছাত্র-জনতার রক্ত কখনো বৃথা যেতে পারে না। এবারও স্বৈরাচারের হাত থেকে এদেশের ছাত্র-জনতা বাংলাদেশকে মুক্ত করে ছাড়ল। তারা বলেন, এবার শান্তিপূর্ণভাবে দেশ গঠন করতে হবে।

প্রধানমন্ত্রীর দেশত্যাগের খবরে রাজধানীর রামপুরা ও বাড্ডায় অবস্থান নিয়ে লাখো ছাত্র-জনতা বিজয়োল্লাসে মেতে উঠেন। সোমবার দুপুরে পুলিশ ও সেনাবাহিনী তাদের অবস্থান থেকে সরে যাওয়ায় বিজয়োল্লাস করেন।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের গণ-অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার খবরে রাজধানীর উত্তরায় রাজপথ থেকে শুরু করে সেক্টরের অলিগলিতে আনন্দ মিছিল-বিজয়োল্লাস করেছে বিপ্লবী ছাত্র-জনতা।

সোমবার দুপুর আড়াইটার পর থেকে উত্তরার বিএনএস সেন্টারসংলগ্ন ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক থেকে এ বিজয়োল্লাস ছড়িয়ে পড়ে আজমপুর, জসীমউদ্দীন, রাজলক্ষ্মী, আব্দুল্লাহপুর, এয়ারপোর্টসহ সবকটি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে। এ সময় কারফিউ ভেঙে রাজপথে নেমে আসেন লাখ লাখ মানুষ।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম