সন্ত্রাসবিরোধী আইনে নির্বাহী আদেশে প্রজ্ঞাপন জারি
নিষিদ্ধ হলো জামায়াত-শিবির
শিক্ষার্থীদের চলমান কোটা সংস্কার আন্দোলনে সরকারের বিভিন্ন স্থাপনায় হামলার ঘটনায় দোষী সাব্যস্ত করে স্বাধীনতাবিরোধী ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করেছে সরকার। একই সঙ্গে নিষিদ্ধ করা হয় দলটির ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরকেও। বৃহস্পতিবার বিকালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। এতে সই করেছেন মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সচিব জাহাংগীর আলম। এর মধ্য দিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতাকারী দলটির রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ হলো।
সরকারের নির্বাহী আদেশে সন্ত্রাসবিরোধী আইনের ১৮(১) ধারা অনুযায়ী বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ছাত্রশিবির এবং তাদের অন্যান্য অঙ্গসংগঠনকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এর আগে নিষিদ্ধ করার বিষয়ে আইনি মতামত দিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ফাইল পাঠায় আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়। গত মঙ্গলবার আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন বুধবারের মধ্যে জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ করা হচ্ছে। যদিও প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে কিছুটা সময় লাগায় বুধবার প্রজ্ঞাপন জারি হয়নি।
এরপর বৃহস্পতিবার দুপুরে আইনমন্ত্রী সাংবাদিকদের জানান, জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধের প্রস্তাব লেজিসলেটিভ বিভাগ ভেটিং (আইনি মতামত) করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ফেরত পাঠিয়েছে, কিছুক্ষণের মধ্যেই সেখান থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে। তার এই বক্তব্যের পরপরই প্রজ্ঞাপনটি জারি করা হয়। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, ‘যেহেতু, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক প্রদত্ত কয়েকটি মামলার রায়ে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী (পূর্বনাম জামায়াত-ই-ইসলামী/জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ) এবং তার অঙ্গসংগঠন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির (পূর্বনাম ইসলামী ছাত্রসংঘ)-কে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালে সংঘটিত গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধে দায়ী হিসাবে গণ্য করা হইয়াছে; এবং যেহেতু, বাংলাদেশের সুপ্রিমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ রিট পিটিশন নং-৬৩০/২০০৯-এ ১ আগস্ট ২০১৩ তারিখের প্রদত্ত রায়ে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর রাজনৈতিক দল হিসাবে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন কর্তৃক প্রদত্ত/প্রাপ্ত নিবন্ধন বাতিল করিয়া দিয়াছে এবং বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ, হাইকোর্ট বিভাগের ওই রায়কে বহাল রাখিয়াছে; এবং যেহেতু, সরকারের নিকট যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ রহিয়াছে যে, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এবং তার অঙ্গসংগঠন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির সাম্প্রতিককালে সংঘটিত হত্যাযজ্ঞ, ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে সরাসরি এবং উসকানির মাধ্যমে জড়িত ছিল।’
প্রজ্ঞাপনে আরও বলা হয়েছে, ‘যেহেতু সরকার বিশ্বাস করে যে, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এবং বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরসহ তার সব অঙ্গসংগঠন সন্ত্রাসী কার্যকলাপের সহিত জড়িত রহিয়াছে সেহেতু, সরকার সন্ত্রাসবিরোধী আইন-২০০৯ এর ধারা ১৮(১)-এ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এবং বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরসহ তার সব অঙ্গসংগঠনকে রাজনৈতিক দল ও সংগঠন হিসাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করিল এবং উক্ত আইনের তফশিল-২ এ বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরসহ তার সব অঙ্গসংগঠনকে নিষিদ্ধ সত্ত্বা হিসাবে তালিকাভুক্ত করিল। ইহা অবিলম্বে কার্যকর হইবে।’
নির্বাহী আদেশে যে আইনের ক্ষমতাবলে জামায়াত-শিবিরকে সরকার নিষিদ্ধ করেছে, সেই সন্ত্রাসবিরোধী আইনের চতুর্থ অধ্যায়ে ১৮ ধারার (১)-এ বলা আছে, এই আইনের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে সরকার কোনো সংগঠনকে সন্ত্রাসী কাজের সঙ্গে জড়িত রয়েছে বলে যুক্তিসংগত কারণের ভিত্তিতে, আদেশ দ্বারা তফশিলে তালিকাভুক্ত করে নিষিদ্ধ করতে পারে। একই ১৮ ধারার (২)-এ বলা আছে, সরকার আদেশ দ্বারা যে কোনো সংগঠনকে তফশিলে সংযোজন বা তফশিল থেকে বাদ দিতে অথবা অন্য কোনোভাবে তফশিল সংশোধন করতে পারবে।
দল ও সংগঠন হিসাবে নিষিদ্ধ ঘোষণার পর সরকার জামায়াত-শিবিরের কার্যালয় বন্ধ, নেতাদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা, তাদের সম্পদ জব্দ করাসহ আরও বেশকিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারবে একই আইনের ক্ষমতাবলে। এই আইনের ২০(১)এ বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি বা সংগঠন ধারা ১৮ এর বিধান অনুসারে নিষিদ্ধ করা হয়, তা হলে এই আইনে বর্ণিত অন্যান্য ব্যবস্থা গ্রহণ ছাড়াও সরকার প্রযোজ্য ক্ষেত্রে, নিুবর্ণিত যে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারবে।
যেমন-কার্যালয় বন্ধ, ব্যাংক এবং অন্যান্য হিসাবসহ সকল সম্পত্তি জব্দ, দলের সদস্যদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা। সব ধরনের প্রচারপত্র, পোস্টার, ব্যানার অথবা মুদ্রিত, ইলেকট্রনিক, ডিজিটাল বা অন্যান্য উপকরণ বাজেয়াপ্ত, প্রেস বিবৃতির প্রকাশনা, মুদ্রণ বা প্রচারণা, সংবাদ সম্মেলন বা জনসম্মুখে বক্তৃতা প্রদান নিষিদ্ধ করতে পারবে সরকার।
এছাড়া সদস্যদের আয় ও ব্যয়ের হিসাব সরকার কর্তৃক মনোনীত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছে দাখিল করা, তাদের আয়ের সব উৎস প্রকাশ করা এবং যদি প্রমাণিত হয় নিষিদ্ধ সংগঠনের সম্পত্তি অবৈধভাবে অর্জিত এবং এই অর্থ কোনো অপরাধ সংঘটনে ব্যবহৃত হয়েছে, তাহলে তা রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করা।
বৃহস্পতিবার প্রজ্ঞাপন জারির পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সাংবাদিকদের বলেন, আমরা তো ১৯৭১ সাল থেকেই জামায়াতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে আসছি। তিনি আরও বলেন, জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করার ঘটনায় কেউ যদি নাশকতা চালায়, সেটা সরকার মোকাবিলা করবে। সেই সক্ষমতা সরকারের রয়েছে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, রাজনৈতিক দল হিসাবে জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধের প্রজ্ঞাপন জারি করে গেজেট প্রকাশ করা হয়েছে। জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ করে তাদের মধ্যে যারা গত কয়েকদিনের সহিংস সংঘর্ষে সুনিশ্চিতভাবে জড়িত ছিল, তাদের বিচারের আওতায় আনা হবে। এছাড়া যেহেতু জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধের রাজনৈতিক নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে, সেহেতু তা বাস্তবায়ন করা হবে।
এর আগে জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধের ফাইলে সই করেন আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক।
প্রজ্ঞাপন জারির আগে দুপুরে সচিবালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে এক প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক বলেন, নিষিদ্ধ করা হলে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও দলটির ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরকে মোকাবিলার প্রস্তুতি সরকারের রয়েছে। নিষিদ্ধ করা হলে জামায়াত-শিবির আন্ডারগ্রাউন্ডে (গোপনে গিয়ে কার্যক্রম চালানো) চলে যাবে কি না-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘তারা আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যেতে পারে। আন্ডারগ্রাউন্ডে অনেক দল গেছে, অনেক দলের কী হয়েছে, সেটা আপনারা জানেন। তবে সেটাকে মোকাবিলা করার প্রস্তুতি আমাদের আছে।’
এ সময় জামায়াতে ইসলামীর বিচার করা সম্পর্কিত আরেক প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনও আমরা সংশোধন করার ব্যবস্থা করেছি। নিষিদ্ধ করার পরও তাকে শাস্তি দেওয়া যাবে না এমনটি নয়। হয়তো নিষিদ্ধ করার বিষয়টি আর সাজার মধ্যে আসবে না। নিষিদ্ধ করার পর দলটির সম্পদের কী হবে-এমন প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক বলেন, সেগুলোরও ব্যবস্থা হবে। সেটা আইনে আছে।
দলের যারা সদস্য তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে কি না-জানতে চাইলে তিনি বলেন, এই দলের অধীনে তারা রাজনীতি করতে পারবে না। বাংলাদেশের কোনো আইনে তারা অপরাধ করলে সেটার বিচার হবে। আপনারা যদি বলেন গণহারে যারা জামায়াতে ইসলামীর নতুন কর্মী রয়েছেন, ১৯৭১ সালের পর যারা জন্ম নিয়েছেন তাদের বিচার করা হবে-এ রকম গণহারে বিচার করা হবে না।
রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের অপব্যবহারের অপরাধে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালে জামায়াতে ইসলামীকে প্রথমবার নিষিদ্ধ করেন। আর এবার তাদের নিষিদ্ধ করা হলো জননিরাপত্তার জন্য হুমকি বিবেচনা করে। এর মধ্য দিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের পক্ষে অস্ত্র ধরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর নিষিদ্ধ হওয়া জামায়াতে ইসলামী অর্ধশতক পর দেশের রাজনীতির ময়দানে দ্বিতীয় দফায় নিষিদ্ধ হলো। প্রজ্ঞাপনের পরপরই ঢাকায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। যে কোনো ধরনের সন্ত্রাস-নাশকতা মোকাবিলা করতে প্রস্তুত রয়েছে বলে জানিয়েছে ঢাকা মহানগর (ডিএমপি) পুলিশ।
আওয়ামী লীগসহ ১৪ দলীয় জোটের শরিকরা, সেক্টরস কমান্ডার ফোরাম, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটসহ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী অসাম্প্রদায়িক-গণতান্ত্রিক-প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল, ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনসহ সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে। বিএনপিসহ তাদের ঘরানার দল ও সংগঠন বাদে দেশে সক্রিয় বাম ঘরানা এবং ধর্মভিত্তিক ইসলামি ঘরানার রাজনৈতিক দলগুলো এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়েছে।
জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধের বিষয় নিয়ে দলীয় ফোরামে আলোচনার পর আনুষ্ঠানিকভাবে দলের পক্ষ থেকে প্রতিক্রিয়া জানানো হবে বলে জানিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টির মহাসচিব মো. মুজিবুল হক চুন্নু এমপি বলেছেন, যে উদ্দেশ্যে সরকার জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করেছে, তাতে লাভ হবে বলে মনে হয় না।
প্রজ্ঞাপনের পর বৃহস্পতিবার গণমাধ্যমে পাঠানো বিবৃতিতে সদ্য নিষিদ্ধ দলটির আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেন, সরকার নিজেদের অপকর্ম ঢাকার জন্য বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরকে নির্বাহী আদেশবলে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে চলমান আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে চাচ্ছে।
প্রসঙ্গত, সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের শাসনামলে রাজনীতি করার অধিকার ফিরে পাওয়া জামায়াতকে নিষিদ্ধের দাবি ওঠে সেই নব্বইয়ের দশকেই। শহিদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা ঘাতক-দালালসহ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আন্দোলন থেকে। ২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরু হওয়ার পর থেকে জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধের দাবি আরও জোরালো হতে থাকে। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের দায়ে জামায়াতে ইসলামীর তখনকার আমির গোলাম আযমকে ২০১৩ সালে ৯০ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছিল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। ওই রায়ের পর্যবেক্ষণে জামায়াতে ইসলামীকে ‘সন্ত্রাসী দল’ আখ্যায়িত করে আদালত।
ওই বছরই আগস্টে গোলাম আযমের সর্বোচ্চ শাস্তি চেয়ে সর্বোচ্চ আদালতে আপিল করে রাষ্ট্রপক্ষ। সেখানে একাত্তরের ভূমিকার জন্য দলটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণারও আবেদন করা হয়। কিন্তু মামলাটি বিচারাধীন অবস্থায় কারাগারে মারা যান জামায়াতগুরু গোলাম আযম। ফলে সুপ্রিমকোর্টে ওই আপিল কার্যকারিতা হারায়, জামায়াত নিষিদ্ধের আবেদনটিও আর এগোয়নি। ১৫ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা বিভিন্ন সময়ে একাত্তরের ভূমিকার জন্য জামায়াত নিষিদ্ধের পক্ষে মত দিয়েছেন। কিন্তু দলটিকে নিষিদ্ধ করার দাবি অপূর্ণই থেকে গেছে এতদিন।
উচ্চ আদালতের রায়ে নিবন্ধন খুইয়ে নির্বাচন করার পথ বন্ধ হলেও দল হিসাবে জামায়াতে ইসলামী দেশের রাজনীতিতে ছিল সক্রিয় ও সরব। গত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেও দলীয়ভাবে তাদের মিছিল-সমাবেশ করতে দেখা গেছে। শেষ পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ব্যবহার করে ব্যাপক সহিংসতা সৃষ্টির অভিযোগে জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করল সরকার। একই সঙ্গে দলটির ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরকেও নিষিদ্ধ করা হয়।
জামায়াত-শিবিরসহ এ পর্যন্ত বাংলাদেশে মোট ১০টি রাজনৈতিক দল ও সংগঠন নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়েছে। দেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঘোষিত নিষিদ্ধ বাকি সংগঠনগুলো হলো-শাহাদত-ই-আল হিকমা, হরকাতুল জিহাদ বাংলাদেশ (হুজি-বি), জাগ্রত মুসলিম জনতা বাংলাদেশ (জেএমজেবি), জামায়াতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি), হিজবুত তাহরীর, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম, আনসার আল ইসলাম, আল্লাহর দল এবং জামায়াতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া।
এর আগে সোমবার রাতে প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় দলের বৈঠকে জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করার বিষয়ে ঐকমত্য হয়। এরপর মঙ্গলবার আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেন, জামায়াতকে কীভাবে নিষিদ্ধ করা হবে, সে সিদ্ধান্ত বুধবারের মধ্যেই চূড়ান্ত হবে। তিনি স্পষ্ট করেছেন, জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা হবে সাম্প্রতিক কোটা আন্দোলনের মধ্যে ‘সহিংসতার জন্য’। আর সেটা করা হবে সরকারের নির্বাহী আদেশে।
জামায়াতের জন্ম ও উত্থান যেভাবে : বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী সৈয়দ আবুল আলা মওদুদীর হাতে গড়া একটি বিতর্কিত রাজনৈতিক সংগঠন। প্রতিষ্ঠাকালে এর নাম ছিল জামায়াতে ইসলামী হিন্দ। ১৯৪১ সালের ২৬ আগস্ট দলটি প্রতিষ্ঠিত হয়। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় উসকানির অভিযোগে ১৯৫৯ সালে প্রথমবারের মতো পাকিস্তানে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা হয়। ১৯৬২ সালে আইয়ুব খান প্রণীত মুসলিম পরিবার আইনের বিরোধিতার কারণে ১৯৬৪ সালে দ্বিতীয় দফায় নিষিদ্ধ হয় জামায়াতে ইসলামী। ওই সময় দলটির প্রধান সৈয়দ আবুল আলা মওদুদীসহ জামায়াতের ৬০ শীর্ষ নেতাকে গ্রেফতার করা হয়। এদের মধ্যে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ১৩ জন জামায়াত নেতা ছিলেন, যাদের অন্যতম ছিলেন গোলাম আযম।
বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি বিরোধিতায় নামে জামায়াতে ইসলামী ও তাদের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘ (পরে ছাত্রশিবির)। আর জামায়াতের পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে তোলা হয় রাজাকার, আলবদর, আলশামস নামের বিভিন্ন হত্যাকারী বাহিনী। এসব বাহিনীর নেতৃত্বে থাকে জামায়াতের নেতারাই। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে মিলে জামায়াতে ইসলামীর সদস্যরা হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট, সংখ্যালঘু নির্যাতন, হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনকে জোরপূর্বক ইসলাম ধর্ম গ্রহণে বাধ্য করা ছাড়াও স্বাধীনের ঠিক আগমুহূর্তে ১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকাসহ বিভিন্ন মানবতাবিরোধী অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে ব্যাপকভাবে অংশ নেয়। দেশ স্বাধীন হলে গোলাম আযম পাকিস্তানে আশ্রয় নেন। অন্যদের কেউ কেউ দেশ ছেড়ে পালান আর বাকিদের দালাল আইনে গ্রেফতার করা হয়। আদালতে ঘোষিত যুদ্ধাপরাধ মামলার বিভিন্ন রায়ে জামায়াতের নেতাদের অপরাধের এ বিষয়গুলো উঠে আসে।
স্বাধীনতার পরপরই অধ্যাদেশের মাধ্যমে দেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়। এই বিবেচনায় জামায়াতে ইসলামীও রাজনীতির অধিকার হারায়। ১৯৭২ সালে সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী বাংলাদেশে নিষিদ্ধ হয় জামায়াতে ইসলামী। এছাড়া দালাল আইনে বিচার শুরু হয় স্বাধীনতাবিরোধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধীদের। হত্যা, খুন, গুম, ধর্ষণসহ নানা অপরাধে প্রায় ৩৭ হাজার দণ্ডপ্রাপ্ত হন। এদের বড় অংশই ছিল জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মী। রাজনৈতিকভাবে নিষিদ্ধ হয়ে অস্তিত্বহারা হয়ে পড়ে জামায়াতের নেতাকর্মীরা। আর দালাল আইনে দণ্ড হয় অসংখ্য নেতাকর্মীর। গ্রেফতার হয়ে জেলে ঢোকেন অনেকে। দণ্ড মাথায় পলাতক হয়ে যায় বহু। স্বাধীন বাংলাদেশে জামায়াতের অস্তিত্ব কার্যত প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যায়। কিন্তু সেখান থেকে জামায়াত নেতা ও যুদ্ধাপরাধীদের ফিরতে খুব বেশি সময় লাগেনি। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পরই দৃশ্যপট দ্রুত পালটাতে শুরু করে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নৃশংসভাবে নিহত হন। এরপর ১৯৭৬ সালের ৩ মে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি এএসএম সায়েম একটি অধ্যাদেশ জারি করেন। আর এর মাধ্যমে সংবিধানের ৩৮ নম্বর অনুচ্ছেদ বাতিল করে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়। আর এই সিদ্ধান্তের পরই বাংলাদেশের রাজনৈতিক চিত্রপট বদলে যেতে থাকে।
প্রথমে ইসলামিক ডেমোক্রেটিক পার্টি নামের একটি দলের ছত্রছায়ায় জামায়াতে ইসলামী স্বাধীন বাংলাদেশে নতুন করে প্রকাশ্যে কর্মকাণ্ড পরিচালনা শুরু করে। ১৯৭৬ সালের ২৪ আগস্ট কয়েকটি ধর্মভিত্তিক দলের সঙ্গে জামায়াতে ইসলামী মিশে গঠন করে ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লীগ (আইডিএল)। কারাগার থেকে বেরিয়ে নিষিদ্ধ জামায়াত নেতারা জড়ো হতে থাকেন এই আইডিএলের ঢালে। আত্মগোপন থেকে জড়ো হতে থাকেন অনেকে। আর এই অবস্থার মধ্যে ১৯৭৯ সালের নির্বাচনে আইডিএলের ব্যানারে নির্বাচনে অংশ নেয় বেশ কয়েকজন জামায়াত নেতা। সেই নির্বাচনে ছয়জন জামায়াত নেতা ভোটে জিতে প্রথমবারের মতো স্বাধীন বাংলাদেশের সংসদে যান।
এরপরই স্বাধীন বাংলাদেশে ঘাঁটি গাড়তে শুরু করে জামায়াত। ওই বছরই ঢাকায় একটি কনভেনশন অনুষ্ঠিত হয়। সেই কনভেনশনে পাকিস্তানে বসবাসরত দলের শীর্ষ নেতা গোলাম আযমের ভাষণ পড়ে শোনানো হয়। সেখানেই অনুমোদন দেওয়া হয় নতুন গঠনতন্ত্র। এরপরই চার দফা কর্মসূচি নিয়ে প্রকাশ্যে মাঠে নেমে পড়ে জামায়াতে ইসলামী। জিয়াউর রহমানের সময় অনুমতি পাওয়ার পরই আগ্রাসীভাবে রাজনীতির ময়দানে নামেনি জামায়াত। বরং তারা নেয় কৌশলী ভূমিকা। তারা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ওপর ভর করে। এক পর্যায়ে জিয়াউর রহমান গোলাম আযমকে পাকিস্তান থেকে দেশে ফেরার অনুমতি দেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম আলোচিত ঘটনা হলো একাত্তরের স্বাধীনতাবিরোধী দল জামায়াতে ইসলামীর পুনরায় রাজনীতিতে ফিরে আসা। যে দল স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছে, সেই দলই কয়েক বছরের মধ্যে স্বাধীন দেশের রাজনীতি ও রাষ্ট্রক্ষমতায় ফিরেছে এমন ঘটনা বিশ্বে আর নেই। তবে তা ঘটেছিল বাংলাদেশে। সামরিক শাসকগোষ্ঠীর মদদ পেয়ে নিষিদ্ধ দল জামায়াতে ইসলামী শুধু যে প্রকাশ্যে রাজনীতি করার অধিকারই পেয়েছিল তাই নয়, দলটির নেতারা, যারা পরে সরাসরি যুদ্ধাপরাধের দায়ে দণ্ডিত হয়েছেন, এমন বেশ কয়েকজন হয়েছিলেন সংসদ সদস্য ও মন্ত্রী।
তথ্য সূত্রে দেখা গেছে, জামায়াতে ইসলামী ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে ১০টি আসন পায়। তবে জামায়াত ফুলেফেঁপে ওঠে ১৯৯১ সালের নির্বাচনে। ওই নির্বাচনে তারা ১৩ শতাংশ ভোট পায় এবং ১৮টি সংসদীয় আসনে বিজয়ী হয়। সে সময় খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপির সরকার গঠনে সমর্থন দেয় জামায়াতে ইসলামী। আর এই সময়ই স্বাধীনতার পর পাকিস্তানে পলাতক থাকা জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষনেতা মানবতাবিরোধী অপরাধী গোলাম আযম (১৯৯১ সালে) দলটির আমিরের দায়িত্ব নেন। পরের নির্বাচনে ১৯৯৬ সালে ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ যখন পুনরায় ক্ষমতায় ফেরে তখন দাপট হারিয়ে ফেলে স্বাধীনতাবিরোধী দলটি। মাত্র আট শতাংশ ভোট পেয়ে তিনটি সংসদীয় আসনে জয় পায়।
তবে পরিস্থিতি আবার ঘুরে যায় ২০০১ সালের নির্বাচনে। এবার বিএনপির সঙ্গে সরাসরি জোট বেঁধে ভোটে নামে দলটি। পুনরায় মোটাতাজা হয়ে ওঠে জামায়াত নেতারা। বিএনপির জোটসঙ্গী হয়ে সেবার ১৭টি আসন পায় জামায়াত। খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর জামায়াতের দুই শীর্ষ নেতা মতিউর রহমান নিজামী ও আলী আহসান মো. মুজাহিদকে মন্ত্রী বানানো হয়। পরে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এই দুজনকেই মৃত্যুদণ্ড দেয়। আদালতের রায় অনুযায়ী তাদের ফাঁসি কার্যকর করে সরকার। ২০০৮ সালের নির্বাচনেও জামায়াতের সঙ্গে জোট বাঁধে বিএনপি। কিন্তু এই নির্বাচনে তেমন সুবিধা করতে পারে না। মাত্র দুটি আসন পায়। এরপর নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধন হারানোর পর ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচনে অংশ নিতে পারেনি জামায়াতে ইসলামী।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের মধ্যে আরও রয়েছেন-দলটির নায়েবে আমির আব্দুস সোবহান, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লা, মো. কামারুজ্জামান, শূরা সদস্য মীর কাসেম আলী। মুক্তিযুদ্ধের সময় জামায়াতের আমিরের দায়িত্বে থাকা গোলাম আযম এবং নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। দুজনই কারাগারে মারা যান।
সর্বশেষ গত ১৬ জুলাই থেকে দেশে যে নৃশংসতা চালানো হয়েছে, কোটাবিরোধী আন্দোলনের ওপর ভর করে যে সহিংসতা চালানো হয়েছে; তার পেছনেও জামায়াত-শিবির সরাসরি জড়িত বলে অভিযোগ করেন সরকারের নীতিনির্ধারকরা। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে সাত মন্ত্রী, চার সচিব ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকেও জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধের বিষয়টি উঠে আসে। পরে এ প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সাংবাদিকদের বলেন, জামায়াত নিষিদ্ধের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে। এখন আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে যা সময় লাগে। সেক্ষেত্রে এক ঘণ্টাও লাগতে পারে আবার একদিনও লাগতে পারে।