সমন্বয়কদের খাওয়ানোর ছবি প্রসঙ্গে রাষ্ট্রপক্ষকে হাইকোর্ট
জাতির সঙ্গে মশকরা করবেন না
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ৩০ জুলাই ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ছবি সংগৃহীত
কোটা সংস্কার আন্দোলনের ছয় সমন্বয়ককে ডিবি কার্যালয়ে তুলে নিয়ে গিয়ে তাদের খাওয়ানোর ছবি প্রকাশ করাকে জাতির সঙ্গে মশকরা বলে মন্তব্য করেছেন হাইকোর্ট। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছয় সমন্বয়ককে অবিলম্বে মুক্তি ও আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি না চালানোর নির্দেশনা চেয়ে রিটের শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষের উদ্দেশে হাইকোর্ট এ কথা বলেন।
সোমবার বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি এসএম মাসুদ হোসাইন দোলনের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চে ওই রিটের ওপর শুনানি হয়।
শুনানি নিয়ে আদালত আজ মঙ্গলবার পরবর্তী শুনানি ও আদেশের জন্য ধার্য করেছেন। এর আগে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ‘কথিত আটক’ ছয় সমন্বয়ককে অবিলম্বে মুক্তি দিতে এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি না চালাতেও নির্দেশনা চেয়ে রিট করেন দুই আইনজীবী। তারা হলেন আইনজীবী মানজুর-আল-মতিন ও আইনুন্নাহার সিদ্দিকা।
আইন সচিব, স্বরাষ্ট্র সচিব, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান, পুলিশের মহাপরিচালকসহ সংশ্লিষ্টদের রিটে বিবাদী করা হয়। আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে সরাসরি তাজা গুলির ব্যবহার কেন আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না এবং তাজা গুলি ব্যবহার না করার নির্দেশ কেন দেওয়া হবে না, জানতে রুল চাওয়া হয়েছে রিটে। সেই সঙ্গে তথাকথিত নিরাপত্তার নামে হেফাজতে নেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের দ্রুত মুক্তি দিতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, রিটে সে মর্মেও রুল চাওয়া হয়।
আদালতে রিটের পক্ষে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না ও ব্যারিস্টার সারা হোসেন, আইনজীবী অনীক আর হক এবং আইনজীবী মানজুর-আল-মতিন শুনানি করেন। রাষ্ট্রপক্ষে অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল শেখ মোহাম্মদ মোরশেদ, অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মোহাম্মদ মেহেদী হাছান চৌধুরী শুনানিতে অংশ নেন; সঙ্গে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল তুষার কান্তি রায়। এ সময় সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি জয়নুল আবেদীন, বর্তমান সভাপতি ব্যারিস্টার এএম মাহবুব উদ্দিন খোকনসহ বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা আদালতে উপস্থিত ছিলেন।
এর আগে নিরাপত্তার কথা বলে গত শুক্রবার আন্দোলনের তিন সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ ও আবু বাকের মজুমদারকে হাসপাতাল থেকে ডিবি কার্যালয়ে নেওয়া হয়। পরদিন সারজিস আলম, হাসনাত আব্দুল্লাহ ও নুসরাত তাবাসসুমকেও ডিবি হেফাজতে নেওয়া হয়।
শুনানিতে রিটের পক্ষে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না বলেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নাম দিয়ে যে কার্যকলাপ হচ্ছে, তা মেনে নেওয়া যায় না। ১৯৭১ সালে দেখেছি পাকিস্তানি হানাদাররা রাতের বেলা ব্লকরেড দিয়ে খোঁজা হতো মুক্তিবাহিনী আছে কি না। যে দেশটা আমরা ৩০ লাখ শহিদের রক্তের বিনিময়ে স্বাধীন করেছি, ২০২৪ সালে সেই দেশে রাত ২টা-৩টায় ব্লকরেড দিয়ে বাসায় ছাত্র আছে কি না খোঁজা হচ্ছে। যদি ছাত্র থাকে, তাহলে তাদের মোবাইল ফোন চেক করা হয়। রাস্তাঘাটেও ছাত্রদের ফোন চেক করা হয়। আমার প্রশ্ন হচ্ছে কোন আইন বলে? কোন অধিকারের বলে? ব্যক্তিগত মোবাইল ফোন চেক করার অধিকার কারও নেই।
এ সময় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা জেড আই খান পান্নার বক্তব্যে আপত্তি তোলেন। পান্না তাদের উদ্দেশে বলেন, আমি রাজাকারগিরি করিনি। রাষ্ট্রপক্ষের এক আইনজীবী তখন বলেন, আপনি রাজাকারগিরি করেছেন। এরপর জেড আই খান পান্না আদালতের উদ্দেশে বলেন, এই তো সরকারের অবস্থা। বাইরে কী হবে, কোর্টের ভেতরের অবস্থা এই। বাইরে কী করে এরা, এটা আর আমি বলতে চাই না। ব্লকরেড দিয়ে যে আটক করছে, এটা কি আইনসম্মত? মোটেই না।
এ পর্যায়ে অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মোহাম্মদ মেহেদী হাছান চৌধুরী বলেন, ওনারা কি নিশ্চিত করে বলতে পারবেন বিটিভি ভবন, মেট্রোরেল, সেতু ভবনে আর হামলা হবে না। শত শত গাড়ি পুড়াবে না। নরসিংদীতে কারাগারে যে হামলা হলো, কয়েদিরা পালিয়ে গেল, এমন ঘটনা আর ঘটবে না। ছাত্র মারা যাওয়ার ঘটনায় বিচারবিভাগীয় তদন্ত কমিশন কাজ করছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কাজ করছে, অবশ্যই অপরাধে জড়িতদের আইনের আওতায় আনা হবে, শাস্তি হবে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আশ্বস্ত করেছেন প্রতিটি ঘটনায় জড়িতদের আইনের আওতায় আনা হবে। মেহেদী হাছান চৌধুরী বলেন, তারা যে আবেদন করেছেন, সেটা বিধিসম্মত না, এ ধরনের আবেদনে রুল ইস্যু করা যায় না।
মেহেদী হাছান চৌধুরী আদালতে আরও বলেন, গতকাল (রোববার) আমরা টিভিতে দেখেছি ডিবিতে এই ছয়জন ছাত্র কাঁটা চামচ দিয়ে ডিনার করছেন। এ সময় আদালত বলেন, এগুলো করতে কে বলেছে? কেন করলেন এগুলো? জাতিকে নিয়ে মশকরা করবেন না। যাকে নেন ধরে, একটি খাবার টেবিলে বসিয়ে দেন।’
তখন উপস্থিত অধিকাংশ আইনজীবী শেইম, শেইম বলে চিৎকার করতে থাকেন। শুনানিতে রিটের পক্ষে ব্যারিস্টার সারা হোসেন বলেন, আমরা এসেছি আন্দোলনকারী ছাত্র-ছাত্রীদের ওপর গুলি না করার জন্য। আমরা বিবেকের তাগিদে হাইকোর্টে এসেছি। তাদেরকে (ছয় ছাত্র) যেন মুক্তি দেওয়া হয়। সারা হোসেন বলেন, ছয়জন সমন্বয়ককে তুলে নেওয়া হয়েছে। কাউকে নিরাপত্তার স্বার্থে তুলে নেওয়া যায় না। একজনকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে নিরাপত্তার নামে তুলে নিয়ে রাখা যাবে, এটা কোথায় আছে। কাউকে যদি আইনি ক্ষমতা ছাড়া বা বেআইনিভাবে হেফাজতে রাখা হয়, এটা নিয়ে আদালত নির্দেশ দিতে পারবেন তাকে সেখান থেকে মুক্ত করার জন্য। আমরা সেই আদেশটি চেয়েছি। এখানে ডিবি থেকে শুনেছি, তারা গণমাধ্যমে বলেছেন, হেফাজতে এই ছয়জন ছাত্র আছেন। তাদের সঙ্গে খাওয়াদাওয়া করছেন, এটাও তারা দেখিয়েছেন। তাদের (ছাত্রদের) সম্মতি নিয়ে ডিবি হেফাজতে নিয়েছে, এটা তারা (ডিবি) বলছেন; কিন্ত আমরা কোথাও সেই তথ্য পাচ্ছি না। ছাত্রদের পরিবার, শিক্ষকরা তাদের সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করেছেন; কিন্তু দেখা করতে দেওয়া হয়নি। ডিবির একজন কর্মকর্তা বের হয়ে বলেছেন, তারা দেখা করতে পারবেন না। তারা যদি ওইখানে স্বেচ্ছায় যায়, তাদের যদি আটক না রাখা হয়, তাহলে কেন তাদের (ছাত্র) কারও কথা বলতে ও দেখা করতে দেওয়া হচ্ছে না।
তিনি আরও বলেন, সংবিধানে বলা আছে, হেফাজতে রাখা বেআইনি। এ নিয়ে উচ্চ আদালতের অনেক নির্দেশনা আছে। এই আদালত নির্দেশ দিতে পারেন। ডিবি বলেছে, ছয়জন তাদের হেফাজতে আছে। এখন প্রশ্ন হলো তাদের সম্মতি নিয়ে হেফাজতে রাখা হয়েছে কি না। এ বিষয়ে যে কোনো ব্যক্তি আদালতে যেতে পারেন। আমরা বিবেকের তাগিদে হাইকোর্টে এসেছি। তাদেরকে যেন মুক্তি দেওয়া হয় বা কোর্টে প্রডিউস করা হয়।
শুনানি শেষে আদালত আজ পরবর্তী শুনানি ও আদেশের জন্য রাখেন। ভারপ্রাপ্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এসএম মুনির সাংবাদিকদের বলেন, মঙ্গলবার রিট খারিজের আবেদন করা হবে। তিনি বলেন, তারা যে আবেদন করেছেন তাতে কোনো বাহিনী সুনির্দিষ্ট কাউকে মেরেছে বা গুলি করেছে, এমন কোনো অভিযোগ উল্লেখ নেই।