মতিউরের শুটিং স্পট প্লট-ফ্ল্যাট ব্যাংক হিসাব জব্দের নির্দেশ
মহিউদ্দিন খান রিফাত
প্রকাশ: ১২ জুলাই ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
এনবিআরের সাবেক সদস্য মো. মতিউর রহমান ও তার পরিবারের সদস্যের নামে থাকা গাজীপুরে শুটিং স্পট জব্দের (ক্রোক) আদেশ দিয়েছেন আদালত। পাশাপাশি তাদের আরও ২৩.৬৭ একর জমি, ১১৬টি ব্যাংক হিসাবে থাকা সাড়ে ১৩ কোটি টাকা ও ৪টি ফ্ল্যাটসহ অন্যান্য সম্পত্তিও জব্দের আদেশ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া জব্দ করা হয়েছে শেয়ারবাজারে তাদের ১২টি প্রতিষ্ঠানের ২৩টি বিও অ্যাকাউন্ট।
বৃহস্পতিবার দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এসব সম্পত্তি জব্দের আদেশ দেন ঢাকা মহানগর জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ মোহাম্মদ আসসামছ জগলুল হোসেন। দুদকের আদালত পরিদর্শক আমীর হোসেন যুগান্তরকে এ তথ্য নিশ্চিত করেন।
তিনি জানান, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এসব সম্পত্তি জব্দের আবেদন করে। এ বিষয়ে শুনানি শেষে আবেদন মঞ্জুর করে আদেশ দেন আদালত। জব্দের আদেশ দেওয়া স্থাবর সম্পত্তির মধ্যে সাভার, ময়মনসিংহ, গাজীপুর, নরসিংদী ও নাটোরের বিভিন্ন জায়গায় থাকা ২৩.৬৭ একর জমি এবং রাজধানীর মিরপুরে থাকা ৪টি ফ্ল্যাট রয়েছে। প্রসঙ্গত, গত ৪ জুলাই মতিউর রহমান ও তার পরিবারের সদস্যের নামে থাকা ১০ একর ১৯ শতাংশ জমি ও ৪টি ফ্ল্যাট জব্দের (ক্রোক) আদেশ দেন আদালত।
কার নামে কত জমি : জব্দ হওয়া জমির মধ্যে সবচেয়ে বেশি পরিমাণ জমি রয়েছে মতিউরের ভাই এমএ কাইউম হাওলাদারের নামে। মেসার্স গ্লোবাল সুজ লিমিটেডের পক্ষে তার নামে রয়েছে ৮৯২ শতাংশ জমি।
এছাড়া মতিউর-লায়লা দম্পতির ছেলে আহমেদ তৌফিকুর রহমান অর্ণবের নামে রয়েছে ৫১৫.৮৩ শতাংশ (৫.১৬ একর) জমি। এ দম্পতির মেয়ে ফারজানা রহমান ঈপ্সিতার নামে পাওয়া গেছে ১৮৮.৪৯ শতাংশ জমি। মতিউরের আপন ভুবন শুটিং স্পটের ম্যানেজিং ডিরেক্টর মনোয়ার হোসেনের নামে ১৬৬.৭২ শতাংশ জমি।
এছাড়া মতিউরের নামে থাকা ১৫২ ও স্ত্রী লায়লা কানিজের নামে থাকা ২৩৯.১৩ শতাংশ জমি রয়েছে জব্দের তালিকায়। এদিকে মতিউর-লায়লার নামে যৌথভাবে থাকা ৪৮.১৬ শতাংশ এবং মতিউর-লায়লা-অর্ণবের নামে যৌথভাবে থাকা আরও ৪৫.১৬ শতাংশ জমিও রয়েছে জব্দের আদেশ হওয়া স্থাবর সম্পত্তির তালিকায়।
কোথায় কত জমি : মতিউর ও তার পরিবারের সদস্য ও তাদের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের নামে ঢাকার সাভারে ২৬.৬১ শতাংশ, ময়মনসিংহের ভালুকায় ১ হাজার ৬২ শতাংশ, গাজীপুরে ৮৭৫.৯৫ শতাংশ, নরসিংদীর শিবপুরে ২৩৬ শতাংশ এবং নাটোরের সিংড়ায় ১৬৬ শতাংশ জমি রয়েছে।
জব্দ আবেদনের নথি সূত্রে আরও জানা যায়, মতিউর ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে গাজীপুরে রয়েছে একটি শুটিং স্পট। আপন ভুবন নামের এ শুটিং স্পটটি ৬৩৬.৩৬ শতাংশ বা ৬.৩৬ একর জমির ওপর অবস্থিত। এসব জমির মধ্যে ১৫২ শতাংশ জমি খোদ শুটিং স্পটের নামে দলিল করা। শুটিং স্পটের বাকি ৪৮৪.৩৬ শতাংশ জমি মতিউর পরিবারের সদস্যের নামে।
এছাড়া ময়মনসিংহ জেলার ভালুকা উপজেলার হবিরবাড়ী মৌজায় রয়েছে মেসার্স গ্লোবাল সুজ লিমিটেড নামে জুতার কোম্পানি। এ কোম্পানির নামে রয়েছে ৬৬ শতাংশ জমি এবং কোম্পানির পক্ষে মতিউরের ভাই এমএ কাইউম হাওলাদারের নামে রয়েছে ৮৯২ শতাংশ বা ৮.৯২ একর জমি।
মিরপুরে একই ভবনে স্ত্রীর ৪ ফ্ল্যাট জব্দ : রাজধানীর মিরপুরের মাজার রোডের শেলটেক বিথীকা টাওয়ারে মতিউরের স্ত্রী লায়লা কানিজের নামে থাকা চারটি ফ্ল্যাট ও গাড়ি পার্কিং স্পেস রয়েছে জব্দের খাতায়। এ চারটি ফ্ল্যাটের প্রতিটির আয়তন ১৮১২ বর্গফুট।
১১৬ ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ও ২৩ বিও অ্যাকাউন্ট : এসব স্থাবর সম্পত্তি ছাড়াও শেয়ারবাজারে মতিউর ও তার পরিবার সদস্যের ১২টি প্রতিষ্ঠানে ২৩টি বিও অ্যাকাউন্ট এবং ২৪টি ব্যাংকে ১১৬টি হিসাবে ১৩ কোটি ৪৪ লাখ ৩৬ হাজার ৪৭১ টাকা ফ্রিজের আদেশ দিয়েছেন আদালত।
বিভিন্ন ব্যাংকে ১১৬টি অ্যাকাউন্টের মধ্যে সোনালী ব্যাংকে রয়েছে ৬টি অ্যাকাউন্ট, এনআরবিসি ব্যাংকে ২টি, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকে ১২টি, জনতা ব্যাংকে ১টি, ব্র্যাক ব্যাংকে ৬টি, এসসিবি ব্যাংকে ২টি, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকে ১টি, মার্কেন্টাইল ব্যাংকে ২টি, আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংকে ৬টি, কমিউনিটি ব্যাংকে ১টি, ডাচ্-বাংলা ব্যাংক ২টি, সাউথইস্ট ব্যাংকে ১টি, মিডল্যান্ড ব্যাংকে ১টি, ইউসিবি ব্যাংকে ১টি, ফাস্ট সিকিউরিটি ব্যাংকে ১৫টি, বিকাশ ৩টি, ওয়ান ব্যাংকে ৩৯টি, ইউনিয়ন ব্যাংকে ২টি, এসবিএসি ব্যাংকে ১টি, এক্সিম ব্যাংকে ১টি, অগ্রণী ব্যাংকে ৪টি, মধুমতি ব্যাংকে ২টি, ঢাকা ব্যাংকে ৪টি, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকে ১টি অ্যাকাউন্ট।
এছাড়া ১২টি প্রতিষ্ঠানে ২৩টি বিও অ্যাকাউন্টের মধ্যে আইল্যান্ড সিকিউরিটিজ লিমিটেডে ৪টি, রূপালী ব্যাংক সিকিউরিটিজ লিমিটেডে ১টি, শাহজালাল ইকুইটি ম্যানেজমেন্ট লিমিটেডে ২টি, আইসিবি ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট লিমিটেডে ২টি, ইমতিয়াজ হোসাইন সিকিউরিটিজ লিমিটেডে ৪টি, শান্তা সিকিউরিটিজ লিমিটেডে ৩টি, বাংলাদেশ ফাইন্যান্স সিকিউরিটিজ লিমিটেডে ২টি, ইবিএল সিকিউরিটিজ লিমিটেডে ১টি, সিটি ব্রোকারেজ লিমিটেডে ১টি, লঙ্কা বাংলা সিকিউরিটিজ লিমিটেডে ১টি, এআইবিএল ক্যাপিটাল মার্কেট সার্ভিস লিমিটেডে ১টি, সোনালী সিকিউরিটিজ লিমিটেডে ১টি রয়েছে।
দুদকের আবেদনে যা বলা হয়েছে : দুদকের আবেদনে অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা উপপরিচালক আনোয়ার হোসেন বলেন, মতিউর রহমান দুর্নীতির মাধ্যমে দেশে ও বিদেশে নিজ নামে বা অন্যান্য ব্যক্তির নামে অবৈধ সম্পদ অর্জনসহ হুন্ডি ও আন্ডারইনভয়েসিং বা ওভারইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে অর্থ পাচার করে শত শত কোটি টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ করা হয়েছে।
অনুসন্ধানকালে বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যাচ্ছে, মতিউর রহমান ও তার পরিবারের সদস্যরা তাদের মালিকানাধীন স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি হস্তান্তরের চেষ্টা করছেন যা করতে পারলে অনুসন্ধানের ধারাবাহিকতায় মামলা দায়ের, আদালতে চার্জশিট দাখিল, আদালত কর্তৃক বিচার শেষে সাজার অংশ হিসাবে অপরাধলব্ধ আয় থেকে অর্জিত সম্পত্তি সরকারের অনুকূলে বাজেয়াপ্তকরণসহ সব উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হবে।
তাই অনুসন্ধান শেষে মামলা দায়ের ও তদন্ত সম্পন্ন করে আদালতে চার্জশিট দাখিলের পর আদালত কর্তৃক বিচার শেষে সরকারের অনুকূলে সম্পত্তি বাজেয়াপ্তের সুবিধার্থে সুষ্ঠু অনুসন্ধান ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার স্বার্থে এসব স্থাবর সম্পত্তি ক্রোক ও অস্থাবর সম্পত্তি অবরুদ্ধ করা একান্ত প্রয়োজন।
যাদের নামে সম্পত্তি : জব্দের আদেশ দেওয়া সম্পত্তিগুলোর মধ্যে রয়েছে-বরিশালে মুলাদী উপজেলায় মতিউরের নামে ১১৪ শতাংশ জমি। তার প্রথম স্ত্রী লায়লা কানিজের নামে নরসিংদী জেলার রায়পুরা উপজেলার মারজাল ইউনিয়নের ২৬টি সম্পত্তির ৫২২.৫২ শতাংশ জমি ও রাজধানীর বসুন্ধরায় ডি ব্লকের ২৪৪৫ বর্গফুটের ফ্ল্যাট। মতিউরের ছেলে আহম্মেদ তৌফিকুর রহমান অর্ণবের নামে ১৯টি সম্পত্তির ২৭৫.৮৫ শতাংশ জমি। নরসিংদীর রায়পুরায় মতিউর-লায়লা দম্পতির মেয়ে ফারজানা রহমান ঈপ্সিতার নামে ৫টি সম্পত্তির ১০৬.৫৬ শতাংশ জমি ও ঢাকার বসুন্ধরায় ডি ব্লকের এক নাম্বার রোডে ৫ কাঠা জমির ওপর বহুতল ভবন। মতিউরের দ্বিতীয় স্ত্রী শাম্মী আখতার শিভলীর নামে থাকা ধানমন্ডির জিগাতলার একটি প্লট (০.০০৮৯৯ শতাংশ) এবং বসুন্ধরার এন ব্লকে ৫ কাঠা জমি আছে।
গত ২৪ জুন দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকার জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ মোহাম্মদ আসসামছ জগলুল হোসেন মতিউর রহমান, তার স্ত্রী লায়লা কানিজ ও তাদের পুত্র আহম্মেদ তৌফিকুর রহমান অর্ণবকে (ইফাত) বিদেশ গমনে নিষেধাজ্ঞা দেন আদালত। এরপর ৩০ জুন এ বিদেশযাত্রা প্রত্যাহার চেয়ে আদালতে আবেদন করেন লায়লা কানিজ। আগামী ২৮ জুলাই এ বিষয়ে আদালতে শুনানি হওয়ার জন্য দিন ধার্য রয়েছে।
ছাগলকাণ্ডে আলোচিত ইফাতের বাবা জাতীয় রাজস্ব রোর্ডের সাবেক সদস্য মো. মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে চারবার অনুসন্ধান করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। প্রতিবারই অনুসন্ধান পর্যায় থেকে শেষ হয়েছে কার্যক্রম। সম্প্রতি মতিউরের বিরুদ্ধে ফের অনুসন্ধান শুরু করেছে দুদক। এদিকে এরই মধ্যে মতিউর রহমান দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন বলে খবর ছড়িয়েছে।