নেতৃত্ব নির্বাচনে ত্যাগ-দক্ষতাকে প্রাধান্য বিএনপির
ঢাকাকে আন্দোলনমুখী করাই বড় চ্যালেঞ্জ
তারিকুল ইসলাম
প্রকাশ: ০৯ জুলাই ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বিএনপির চার মহানগরের নতুন আংশিক আহ্বায়ক কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে ত্যাগ ও সাংগঠনিক দক্ষতা প্রাধান্য পেয়েছে। বিশেষ করে ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ নিয়ে আলাদা পরিকল্পনা থেকে তারুণ্যনির্ভর নেতৃত্ব দিয়েছে দলটির হাইকমান্ড। অতীতের আন্দোলনে ব্যর্থতার পুরো দায় পড়েছে এই দুই মহানগরের ওপর। তাই আগামী দিনে ঢাকা মহানগরকে গতিশীল ও আন্দোলনমুখী করাই বড় চ্যালেঞ্জ হিসাবে দেখছেন নতুন নেতৃত্ব।
তবে মাঠের পরীক্ষিত নেতাদের মূল্যায়ন করতে গিয়ে অনেক হেভিওয়েট নেতা বাদ পড়েছেন। তাদের বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটিতে গুরুত্বপূর্ণ পদ দিয়ে মূল্যায়ন করা হচ্ছে। শিগগিরই দ্বিতীয়বারের মতো কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটিতে বড় রদবদলের কথা রয়েছে। সেখানে চট্টগ্রামের ডা. শাহাদাত হোসেনকে যুগ্ম মহাসচিব করা হতে পারে। এমন তালিকায় আছেন ঢাকা মহানগরের নবীউল্লাহ নবী, চট্টগ্রামের আবুল হাসেম বক্করসহ চার মহানগরের বেশ কয়েকজন সিনিয়র নেতা। দলটির একাধিক নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে এমন তথ্য।
চার মহানগরের কমিটি দিলেও ঢাকা মহানগরের নতুন নেতৃত্ব নিয়ে বেশি আগ্রহ নেতাকর্মীদের। তারা জানান, যেসব নেতা আলোচনায় বেশি ছিলেন, তাদের দিয়েই কমিটি হয়েছে। তাদের যোগ্যতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। এখন দেখার বিষয় ঝিমিয়ে পড়া ঢাকা মহানগরকে ফের চাঙা ও আন্দোলনমুখী করার ক্ষেত্রে কমিটির নেতারা কতটা সফল হন।
সূত্র জানিয়েছে, চার মহানগর কমিটিতে শীর্ষ পদে নিজেদের লোক বসাতে বড় একটি সিন্ডিকেট সক্রিয় ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওই সিন্ডিকেট সফল হয়নি। পদ পাওয়া নেতাদের অতীত কর্মকাণ্ড এবং মাঠের ভূমিকার তথ্য ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান নিজেই বিভিন্ন মাধ্যমে নেন। তাদের সঙ্গে কয়েক দফা কথাও বলেন এবং পরে কমিটি দেন। মহানগরের পূর্ণাঙ্গ কমিটিও দ্রুত সময়ের মধ্যে দেওয়া হবে। সেখানেও মূল্যায়ন করা হবে মাঠের নেতাদের। নিষ্ক্রিয়, সুবিধাবাদী ও বিতর্কিত নেতাদের পদ না দেওয়ার বিষয়ে নির্দেশনা দিয়েছেন হাইকমান্ড। ৫১ সদস্য করে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণের আহ্বায়ক কমিটি গঠন করতে চান মহানগর বিএনপির নতুন নেতৃত্ব। এজন্য তারা ২ সপ্তাহ সময় চেয়েছেন। চট্টগ্রাম ও বরিশাল মহানগরেও পূর্ণাঙ্গ আহ্বায়ক কমিটির পরিধিও একই করার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হবে।
নতুন কমিটি সম্পর্কে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, ‘রাজপথের কর্মীদের আস্থার প্রতিফলন ঘটেছে, মাঠের নেতাদের উপযুক্ত মূল্যায়ন হয়েছে। যারা দায়িত্ব পেয়েছেন তারা দলের লক্ষ্য অর্জন এবং নেতাকর্মীদের প্রত্যাশা পূরণে ভূমিকা রাখবেন বলে বিশ্বাস করি।’
২০২১ সালের ২ আগস্ট আমানউল্লাহ আমানকে আহ্বায়ক ও আমিনুল হককে সদস্য সচিব এবং দক্ষিণে আবদুস সালামকে আহ্বায়ক ও রফিকুল আলম মজনুকে সদস্য সচিব করে আহ্বায়ক কমিটি করা হয়। যদিও গত বছরের ২৮ অক্টেবর ঢাকায় সমাবেশ পণ্ড হওয়ার পর আন্দোলন শুরু হলে আমানউল্লাহ আমানকে গ্রেফতার করা হলে ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়কের দায়িত্ব পান অধ্যাপক ডা. ফরহাদ হালিম ডোনার। এই কমিটি ১৩ জুন রাতে বিলুপ্ত ঘোষণা করে বিএনপি। ২৩ দিন পর রোববার উত্তরে কেন্দ্রীয় যুবদলের সাবেক সভাপতি সাইফুল আলম নিরবকে আহ্বায়ক এবং বিলুপ্ত কমিটির আমিনুল হককে পুনরায় সদস্য সচিব করা হয়। অন্যদিকে বিলুপ্ত কমিটির সদস্য সচিব রফিকুল আলম মজনুকে আহ্বায়ক এবং যুগ্ম আহ্বায়ক তানভীর আহমেদ রবিনকে সদস্য সচিব করে মহানগর দক্ষিণের কমিটি ঘোষণা করা হয়। সোমবার নতুন কমিটির নেতারা মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এ সময় তাদের নানা দিকনির্দেশনা দেন মহাসচিব।
বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সদ্য সাবেক আহ্বায়ক আব্দুস সালাম আশা করেন, নতুন কমিটি সক্রিয়ভাবে কাজ করবে এবং সফল হবে। তিনি বলেন, ‘দল পুনর্গঠনের অংশ হিসাবে নতুন কমিটি হয়েছে। আমার টিমের দুজন তরুণ সদস্য, যাদের একজন সদস্য সচিব ও আরেকজন ভারপ্রাপ্ত সদস্য সচিব হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন, আজ তাদের ওপর ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান সম্পূর্ণ আস্থা রেখেছেন। আমি তো এখানেই সফল’। গত আন্দোলনেও মহানগর ব্যর্থ হয়েছে বলে অনেকের অভিযোগ প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের উত্তরে সাবেক এই আহ্বায়ক বলেন, ‘এখন যদি কেউ মনে করে মহানগরে যাদের দায়িত্ব দেওয়া হবে তারা সরকারকে ক্ষমতা থেকে নামাবে। এটা তো সম্ভব নয়। জনগণের মধ্যে একটা জনভিত্তি গড়ে তুলবে তারা। পাশাপাশি আওয়ামী লীগের ফ্যাসিবাদী চরিত্রকে উন্মোচন করে জনবিচ্ছিন্ন করবে। আমরা তো তা করতে সক্ষম হয়েছি। নির্বাচনে জনগণ অংশগ্রহণ করেনি, বর্জন করেছে। এটাই তো আন্দোলনের সফলতা। মাঠের আন্দোলনে ব্যর্থতা যারা বলেন, তারা ভুল বলেন। বিএনপি একটি গণতান্ত্রিক দল। এই দলের নেতাকর্মীরা কি মাঠে অস্ত্র নিয়ে নামবে নাকি। গণতান্ত্রিকভাবে যে আন্দোলন করার কথা তা করবে, করেছে। শত শত মামলা, জেল খেটেছেন, বহু নেতাকর্মী পঙ্গু, অনেকে মারা গেছেন। এটাও বাস্তবতা।’
ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির সদ্য সাবেক ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক অধ্যাপক ডা. ফরহাদ হালিম ডোনার যুগান্তরকে বলেন, ‘উত্তরের কমিটি ভালো হয়েছে। একজন তো ত্যাগী ও অভিজ্ঞ আছেনই; আরেকজন নতুন, কিন্তু পরিশ্রমী। মূল চ্যালেঞ্জ হলো যদি সুষ্ঠুভাবে কমিটিগুলো করতে পারে, যারা ত্যাগী তাদের যদি ঠিকমতো মূল্যায়ন করতে পারে তাহলে অনেক কিছুই করা সম্ভব। যারা সুবিধাবাদী তাদের দিয়ে যদি দল হয়, তাহলে তো সেই দল এগোবে না।’ সংগঠনকে গতিশীল করে আন্দোলনমুখী করাই মূল্য উদ্দেশ্য থাকবে বলে প্রত্যাশা করেন তিনি।
মহানগর নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, উত্তরে আমান-আমিনুল এবং দক্ষিণে সালাম-মজনু কমিটি ঘোষণার সময় উভয় মহানগরের অনেক যোগ্য নেতা বাদ পড়েছিলেন। এই কমিটি ১৩ জুন বিলুপ্ত করা হলে ওই সময়ে বাদ পড়া নেতারা ঐক্যবদ্ধ হন এবং দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে তাদের মহানগর কমিটিতে মূল্যায়নের জন্য অনুরোধ জানান। এই অবস্থায় নিরব-আমিনুল এবং মজনু-রবিন কমিটি ঘোষণা করা হলে আগের কমিটিতে স্থান না হওয়া নেতারাও তাদের শুভেচ্ছা জানাতে কেউ নয়াপল্টনে আবার কেউ নেতাদের বাসায় যান। তবে, দলের পরীক্ষিত ও ত্যাগীদের মূল্যায়ন করতে গেলে বিলুপ্ত কমিটিরও অনেক নেতা নতুন কমিটি থেকে বাদ পড়বেন। এই অবস্থায় নতুন নেতৃত্বকে বড় ধরনের একটি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। ঢাকা মহানগর উত্তরের আহ্বায়ক সাইফুল আলম নিরব যুগান্তরকে বলেন, ‘কমিটি গঠনে কোনো ব্যক্তি পছন্দ-অপছন্দে নয়; দলের জন্য নিবেদিত, পরীক্ষিত এবং রাজপথে সক্রিয় এবং মেধাবী-এমন নেতা স্বয়ংক্রিয়ভাবে কমিটিতে স্থান পাবেন। সেখানে অনেক তরুণ নেতাদের স্থান হতে পারে।
দলের গুরুত্বপূর্ণ এক নেতা জানান, নিষ্ক্রিয় বা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের জন্য কেউ যদি বাদ পড়েন সেখানে ক্ষোভ প্রকাশ করার সুযোগ কম থাকবে। তারপরও পূর্ণাঙ্গ কমিটি চূড়ান্ত করার আগে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশনা অনুযায়ী মহানগর রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের পরামর্শ নেওয়া হবে। যাতে করে কমিট গঠনে ভুল কম হয়।
যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনা করেছেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণের নতুন সদস্য সচিব তানভীর আহমেদ রবিন। এই নেতা শ্যামপুর ইউনিয়ন বিএনপির সদস্য থেকে সাধারণ সম্পাদক এবং পরে মির্জা আব্বাস নেতৃত্বাধীন মহানগর কমিটির সদস্য, পরের কমিটির (মহানগর দক্ষিণ বিএনপি) সাংগঠনিক সম্পাদক ও সর্বশেষ ছিলেন যুগ্ম আহ্বায়ক। রবিন যুগান্তরকে বলেন, ‘সবার সঙ্গে আলোচনা করে যত দ্রুত সম্ভব আন্দোলনমুখী নেতৃত্ব বাছাই করব। মহানগর দক্ষিণ বিএনপি হবে দলের অতন্দ্র প্রহরী।’