Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

বিসিএস পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস

পিএসসির তিন কর্মকর্তাসহ ১৭ জন গ্রেফতার

প্রশ্নফাঁসের চাঞ্চল্যকর তথ্য দেন অফিস সহায়ক সাজেদুল * প্রশ্নফাঁসের টাকায় পিএসসি চেয়ারম্যানের সাবেক গাড়িচালক আবেদ আলী অঢেল সম্পদের মালিক

Icon

ইকবাল হাসান ফরিদ, ঢাকা ও এইচএম মিলন, কালকিনি প্রতিনিধি

প্রকাশ: ০৯ জুলাই ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

পিএসসির তিন কর্মকর্তাসহ ১৭ জন গ্রেফতার

বিসিএস পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসে জড়িত সরকারি কর্ম কমিশন-পিএসসির দুই উপপরিচালক মো. আবু জাফর ও জাহাঙ্গীর আলম, সহকারী পরিচালক মো. আলমগীর কবিরসহ ১৭ জনকে গ্রেফতার করেছে সিআইডি। এ তালিকায় পিএসসির চেয়ারম্যানের সাবেক গাড়িচালক ভাইরাল হওয়া সৈয়দ আবেদ আলী জীবন ও তার ছেলে সোহানুর রহমান সিয়ামও রয়েছেন।

গ্রেফতার হওয়া পিএসসির অফিস সহায়ক সাজেদুল ইসলাম বলেন, ‘উপপরিচালক মো. আবু জাফরের মাধ্যমে ২ কোটি টাকার বিনিময়ে ৫ জুলাই অনুষ্ঠিত রেলওয়ের উপসহকারী প্রকৌশলী নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস করা হয়। তিনি বড় কর্মকর্তাদের ট্রাঙ্ক থেকে পরীক্ষার আগের দিন আমাকে প্রশ্ন সরবরাহ করেন।’

পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) সোমবার দিনভর রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেফতার করে। গ্রেফতার অন্য অভিযুক্তরা হলেন পিএসসির ডেসপ্যাচ রাইটার খলিলুর রহমান, অফিস সহায়ক সাজেদুল ইসলাম, অডিটর প্রিয়নাথ রায়, নোমান সিদ্দিকী, আবু সোলায়মান মো. সোহেল, মো. মামুনুর রশিদ, সাখাওয়াত হোসেন, সায়েম হোসেন, লিটন সরকার মো. জাহিদুল ইসলাম, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিকেল টেকনিশিয়ান মো. নিয়ামুল হাসান এবং নারায়ণগঞ্জ আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের নিরাপত্তা প্রহরী শাহাদাত হোসেন। তাদের গ্রেফতারের বিষয়টি যুগান্তরকে নিশ্চিত করেছে সিআইডি।

১২ বছরে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসসহ (বিসিএস) ৩০টি নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসের অভিযোগ উঠে বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) ছয় কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে। অভিযুক্ত পিএসসির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা হলেন উপপরিচালক মো. আবু জাফর, উপপরিচালক জাহাঙ্গীর আলম, সহকারী পরিচালক এসএম আলমগীর কবির, সহকারী পরিচালক নিখিল চন্দ্র রায়, চেয়ারম্যানের সাবেক গাড়িচালক সৈয়দ আবেদ আলী জীবন ও অফিস সহায়ক খলিলুর রহমান। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে কোনো শক্ত প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছিল না। সম্প্রতি সিআইডি বিভিন্ন মাধ্যম থেকে চক্রটির বিষয়ে তথ্য পায়। গোপনে তাদের বিষয়ে অনুসন্ধানও শুরু করে।

এরই ধারাবাহিকতায় চক্রের ১৭ জনের বিষয়ে নিশ্চিত তথ্য পেয়ে অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেফতার করা হয়। তাদের মধ্যে বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) চেয়ারম্যানের সাবেক গাড়িচালক সৈয়দ আবেদ আলী জীবনের আলিশান জীবনের চাঞ্চল্যকর অনেক তথ্য সামনে আসছে। এমনকি বাবার টাকায় ছেলে সিয়ামের রাজকীয় জীবনের গল্প সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘুরছে। বাবা-ছেলের জীবন যেন উপন্যাসকেও হার মানায়। বাকি ১৫ জনের বিষয়ে যুগান্তরের পক্ষ থেকে তথ্য-উপাথ্য সংগ্রহ চলছে।

কে এই আবেদ আলী জীবন: এক যুগ আগেও অর্থকষ্টে দিন কাটত গাড়ি চালক আবেদ পরিবারের। হঠাৎই পালটে যায় সবকিছু। আবেদ বনে যান অঢেল সম্পদের মালিক। মাদারীপুরের ডাসার উপজেলার বোতলা গ্রামে গড়ে তুলেন আলিশান বাড়ি। এছাড়া ঢাকায় একাধিক বাড়িম ফ্ল্যাটসহ নামে-বেনামে বিপুল সম্পদ রয়েছে তার। তিনি আওয়ামী লীগের নেতা দাবি করে মাদারীপুরের ডাসার উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থী হিসাবে প্রচারণাও চালান। তার ছেলে সৈয়দ সোহানুর রহমান সিয়াম ঢাকা উত্তর ছাত্রলীগের ত্রাণবিষয়ক সম্পাদক। বাবার অবৈধ টাকায় তারও রয়েছে রাজকীয় জীবন। দানদখিনা করে এলাকায় সোহানও এখন পরিচিত মুখ। তবে জনমনে প্রশ্ন ছিল বাপ-বেটার এই বিপুল অর্থকড়ির উৎস কোথায়।

সম্প্রতি পিএসসির প্রশ্নফাঁসচক্রের বিষয়টি সামনে আসে। ছয় কর্মকর্তা-কর্মচারীর ওই চক্রের অন্যতম প্রধান সাবেক গাড়িচালক সৈয়দ আবেদ আলী জীবন। অভিযোগ উঠেছে, গাড়িচালক আবেদ আলী জীবন বছরের পর বছর পিএসসির প্রশ্নফাঁসের টাকায়ই গড়ে তুলেছেন অঢেল সম্পদ। তার অঢেল সম্পদের তথ্য ভাসছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও। সৈয়দ আবেদ আলী জীবন নিজের ফেসবুক পেজে একটি হোটেলের তথ্য তুলে ধরেন নিজেই। ১৮ মে এক পোস্টে তিনি লিখেন, ‘আমাদের নতুন হোটেলের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করলাম আজ। হোটেল সান মেরিনা, কুয়াকাটা।’

এদিকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচিত হচ্ছেন আবেদ আলীর ছেলে সৈয়দ সোহানুর রহমান সিয়ামও। তিনিও সোমবার সিআইডির হাতে গ্রেফতার হয়েছেন। মানুষকে সাহায্য করে সেই ভিডিও প্রচার করেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। চড়েন একাধিক দামি গাড়িতে। পড়াশোনা করেছেন দেশের বাইরে। তার ফেসবুকে দুটি গাড়ির ছবি পোস্ট করেছেন, যার বাজারমূল্য প্রায় ১ কোটি ১০ লাখ টাকা। ফেসবুকে তার বাবার একটি নামাজের ছবি দিয়ে বলেন, ‘আব্বু কুয়াকাটা গিয়েছিল একটা ব্যবসায়িক সফরে, সেখানে স্থানীয় এক ছোট ভাই ছবিটি তুলে ইনবক্সে দিল। সাধারণত আব্বু কোনো ওয়াক্তের নামাজ অবহেলা করে না, যখন যেখানে থাকে, তখন সেখানেই পাকপবিত্র জায়গা খুঁজে নামাজ আদায় করে নেয়। খুব সম্ভবত সৃষ্টিকর্তার প্রতি গভীর ভালোবাসা না থাকলে এটা সম্ভব নয়। আল্লাহ আমার বাবাকে কবুল করুক।’

আরেকটি পোস্টে সৈয়দ সোহানুর রহমান সিয়াম লিখেন, আমার বাবা ছোটবেলায় বলত, আমি কুরবানির সময় অনেক কষ্ট পেতাম। কারণ, আমি কুরবানি দিতে পারতাম না। মানুষের কাছে মাংস চাইতাম। এখন আল্লাহর রহমতে আমি অনেক পশু কুরবানি দিতে পারি। আমি চাই অন্তত আমার উপজেলায় কুরবানি দিতে না পারার জন্য যেত কাউকে গরুর মাংস খাওয়া থেকে বিরত থাকতে না হয়। যারা বাড়িতে এসেছে, সবাইকে মাংস দিয়েছি। অনেক কর্মব্যস্ততার জন্য যারা বাড়িতে আসতে পারেনি, তাদের ঘুরে ঘুরে নিজে মাংস পৌঁছে দিলাম। বাবার স্বপ্নটা পূরণ করার চেষ্টা করলাম।

সৈয়দ আবেদ আলী জীবনের বিষয়ে খোঁজ নিয়ে আরও জানা যায়, ডাসার উপজেলার বালিগ্রাম ইউনিয়নের পশ্চিম বোতলা গ্রামের মৃত জবেহ আলী মীরের ছেলে তিনি। প্রায় এক যুগ আগেও অর্থকষ্টে দিন কাটত তার। এখন গ্রামের বাড়িতে আলিশান বাড়ি। বাড়ির পাশেই সরকারি জমি দখল করে গড়েছেন গরুর ফার্ম। গৌরনদীর খাঞ্জাপুরেও রয়েছে তার বাড়ি। সমুদ্রসৈকত কুয়াকাটায় তৈরি করেছেন সান মেরিন নামে বিলাসবহুল থ্রি-স্টার হোটেল। ছেলে সৈয়দ সোহানেরও দৃশ্যমান কোনো আয় নেই। তিনি দেখাশোনা করেন বাবার ব্যবসা।

সূত্র জানায়, সৈয়দ আবেদ আলী জীবন বিসিএস পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসসহ বিভিন্ন দপ্তরে করতেন দালালি। দেশের স্বনামধন্য রাজনৈতিক ব্যক্তিসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে ছবি তুলে নিজ ফেসবুক আইডিতে পোস্ট করে প্রচার করতেন। সেসব ছবি বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তাদের দেখিয়ে সুবিধা নেন তিনি।

এ বিষয়ে সৈয়দ আবেদ আলী জীবন এবং ছেলে সৈয়দ সোহানুর রহমানের গ্রামের বাড়িতে গিয়ে দরজা তালাবদ্ধ পাওয়া যায়।

জানা যায়, পিএসসির কোনো নিয়োগ পরীক্ষা এলেই প্রশ্নফাঁস করে মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার কারসাজিতে মেতে উঠত গ্রেফতার হওয়া চক্রটি। এসব তথ্য নিশ্চিত করতে দেশের একটি গণমাধ্যম গেল ৫ জুলাই শুক্রবার অনুষ্ঠিত রেলওয়ের উপসহকারী প্রকৌশলীর নিয়োগ পরীক্ষাটি বেছে নেয়। প্রস্তুতি শেষে ছদ্মবেশী প্রার্থীকে তুলে দেয় চক্রের সদস্যদের হাতে। এরপর ৫ জুলাই শুক্রবার সকাল ১০টা থেকে ১২টা পর্যন্ত যে প্রশ্নে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়, হোয়াটসঅ্যাপে তার একটা কপি পাঠানো হয় অন্তত ১ ঘণ্টা আগে। আর অজ্ঞাত স্থানে রেখে চুক্তিবদ্ধ শিক্ষার্থীদের তা পড়ানো হয় আগের রাতেই। পুরো চক্রটিকে ধরতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একাধিক সংস্থা ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছে।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম