বেনজীর-মতিউর পরিবারের দুর্নীতি : সম্পদের হিসাব চেয়েছে দুদক

যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ০৩ জুলাই ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ, তার স্ত্রী ও দুই কন্যার বিরুদ্ধে প্রাথমিক অনুসন্ধানে বিপুল অবৈধ সম্পদের তথ্য-প্রমাণ পেয়েছে দুদক। প্রাপ্ত তথ্য যাচাই-বাছাই করতে ২১ কর্মদিবসের মধ্যে তাদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের হিসাব জমা দিতে নোটিশ দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
এছাড়া জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সদ্য সাবেক সদস্য মো. মতিউর রহমানের দুর্নীতির মাধ্যমে দেশে-বিদেশে অবৈধ সম্পদ অর্জনসহ বিদেশে অর্থ পাচারের তথ্য পেয়েছে দুদক। হুন্ডির পাশাপাশি আন্ডার ও ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে বিদেশে বিপুল অর্থ পাচারের তথ্যও পাওয়া গেছে। এসব তথ্য নিশ্চিত হতে মতিউর রহমান, তার দুই স্ত্রী ও প্রথম পক্ষের ছেলেমেয়ের সম্পদের হিসাব চেয়েছেন অনুসন্ধান কর্মকর্তা। মঙ্গলবার সংস্থার প্রধান কার্যালয় থেকে বেনজীর ও মতিউর পরিবারের সদস্যদের নামে এ নোটিশ পাঠানো হয়েছে।
এ বিষয়ে মঙ্গলবার বিকালে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে দুদক সচিব খোরশেদা ইয়াসমীন বলেন, অনুসন্ধান টিমের সদস্যরা বেনজীর আহমেদ ও মতিউর রহমানের অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধান করছেন। প্রাথমিক অনুসন্ধান শেষে টিমের সদস্যদের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে কমিশন বেনজীর আহমেদ, তার স্ত্রী জীসান মির্জা, দুই মেয়ে ফারহীন রিসতা বিনতে বেনজীর ও তাহসীন রাইসা বিনতে বেনজীরের নামে জ্ঞাতআয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন করার প্রাথমিক তথ্য পেয়েছে। ফলে তাদের বিরুদ্ধে পৃথক পৃথক সম্পদ বিবরণী দাখিলের নোটিশ জারি করা হয়েছে। পৃথক আরেক ঘটনায় এনবিআর সদস্য মতিউর রহমান, তার প্রথম স্ত্রী লায়লা কানিজ, প্রথম পক্ষের সন্তান আহমেদ তৌফিকুর রহমান অর্ণব, মেয়ে ফারজানা রহমান ইপ্সিতা ও দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী শাম্মী আখতার শিভলীর নামেও সম্পদ বিবরণী নোটিশ জারি করা হয়েছে।
বেনজীর ও মতিউরকে দেওয়া নোটিশে প্রায় একই ধরনের ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে। নোটিশে বলা হয়েছে, প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে অনুসন্ধান করে দুদকের স্থির বিশ্বাস জন্মেছে যে, আপনারা জ্ঞাতআয়বহির্ভূত স্বনামে-বেনামে বিপুল পরিমাণ সম্পদ/সম্পত্তির মালিক হয়েছেন। নিজ ও আপনাদের ওপর নির্ভরশীল ব্যক্তির নামে-বেনামে অর্জিত যাবতীয় স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ, দায়দেনা, আয়ের উৎস ও তা অর্জনের বিস্তারিত বিবরণী কমিশনে দাখিল করবেন। এ আদেশ পাওয়ার ২১ কার্যদিবসের মধ্যে নির্ধারিত ছকে সম্পদ বিবরণী দাখিলে ব্যর্থ হলে কিংবা মিথ্যা সম্পদ বিবরণী দাখিল করলে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪ এর ৫(২) ধারা অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে নোটিশে উল্লেখ করা হয়েছে।
দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিপুল সম্পদ গড়ার তথ্য সম্প্রতি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলে নতুন করে আলোচিত হন সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ। এরপর ২২ এপ্রিল তার বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধানে কমিটি গঠন করে দুদক। অনুসন্ধান পর্যায়ে ২৩ মে বেনজীর আহমেদের ৮৩টি দলিলের সম্পত্তি ও ৩৩টি ব্যাংক হিসাব জব্দের নির্দেশ দেন আদালত। এরপর ২৬ মে আদালত বেনজীর ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে থাকা আরও ১১৯টি জমির দলিল, ২৩টি কোম্পানির শেয়ার ও গুলশানের চারটি ফ্ল্যাট জব্দের আদেশ দেন। এই ধারবাহিকতায় বেনজীর আহমেদ ও তার স্ত্রী-সন্তানদের স্থাবর সম্পদ ক্রোক এবং ব্যাংক হিসাব জব্দের কার্যক্রম চলমান আছে। ইতোমধ্যে তাদের সম্পত্তি দেখভালে নিয়োগ করা হয়েছে রিসিভার কমিটি।
অনুসন্ধানকালে বেনজীর ও তার স্ত্রী সন্তানকে ২৩ ও ২৪ জুন দুদকে হাজির হতে নির্দেশও দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তারা হাজির না হয়ে আইনজীবীর মাধ্যমে অভিযোগের লিখিত বক্তব্য জমা দেন। এর আগে প্রথম দফায় বেনজীরকে ৬ জুন এবং স্ত্রী জিসান মীর্জা ও দুই মেয়েকে ৯ জুন জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করে দুদক। তখন তারা সময় চান। পরে ২৩ ও ২৪ জুন হাজির হতে বলা হয়। বেনজীর আহমেদ সপরিবারে বিদেশে রয়েছেন বলে জানা গেছে।
এদিকে, দুদকের অবৈধ সম্পদ অনুসন্ধান চলাকালে ‘পাসপোর্ট করতে বেনজীরের নজিরবিহীন জালিয়াতি; মিথ্যা পরিচয়ে বিশ্বভ্রমণ’ শিরোনামে যুগান্তরে সংবাদ প্রকাশিত হলে দেশজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। এই পাসপোর্ট জালিয়াতির একটি অভিযোগও দুদকে অনুসন্ধান চলমান। ২৫ জুন এ বিষয়ে যাচাই-বাছাই করতে পাসপোর্ট অধিদপ্তরের দুই অতিরিক্ত মহাপরিচালক ও দুই পরিচালকসহ ১৫ কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।
অন্যদিকে, ছাগলকাণ্ডে আলোচিত হন এনবিআরের সদ্য সাবেক সদস্য মতিউর রহমান। ঈদুল আজহার আগে মোহাম্মদপুরের বিতর্কিত সাদিক অ্যাগ্রো থেকে ১৫ লাখ টাকায় ছাগল কেনেন ধানমন্ডির তরুণ মুশফিকুর রহমান ইফাত। তার ছাগল কেনার ছবি সামাজিক যোগযোগমাধ্যমে ভাইরাল হলে পারিবারিক পরিচয় ও অর্থের উৎস নিয়ে প্রশ্ন উঠে। ইফাতের বাবা হিসাবে সামনে আসে এনবিআর সদস্য মতিউরের নাম। কিন্তু তিনি দৃশ্যপটে এসে সন্তানের পরিচয় অস্বীকার করলে হইচই পড়ে যায়। এরপর গণমাধ্যমে মতিউর ও তার পরিবারের সদস্যদের কয়েক হাজার কোটি টাকার সম্পদের তথ্য প্রকাশিত হয়। সামনে আসে মতিউরের দুই পরিবারের কেচ্ছা। একই সঙ্গে কানাডায় তার প্রথম স্ত্রীর সন্তান ইপ্সিতার বিলাসবহুল গাড়ি-বাড়ির ছবিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়। এরপরই মতিউরের অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধানে টিম গঠন করে দুদক। তবে জানা যায়, এর আগেও মতিউরের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অনুসন্ধান করতে চার দফা টিম গঠন করেছিল সংস্থাটি। প্রতিবারই অবৈধ প্রভাবের কাছে বশ মেনে দুদক তার বিরুদ্ধে অভিযোগ পরিসমাপ্তি করে।
শুনানিতে আইনজীবী সুবীর নন্দী দাস বলেন, সাবেক পুলিশ প্রধান বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। এই বেনজীর-মতিউরদের মতো শীর্ষ পদধারীদের বিরুদ্ধে যখন দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে তখন আমাদের সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে পড়ে। এ রকম ব্যক্তিরা শীর্ষ পদে থাকলে তারা রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করবেন না তাদের সম্পদ রক্ষা করবেন। স্বাভাবিকভাবেই রাষ্ট্র, জনগণ, সার্বভৌমত্ব রক্ষা না করে তারা তাদের নিজেদের সম্পদই রক্ষা করবেন।
শুনানিতে হাইকোর্ট বলেন, দুর্নীতি-অর্থ পাচার সুশাসন ও উন্নয়নের অন্তরায়। তাই যে কোনো মূল্যে দুর্নীতি-অর্থ পাচার বন্ধ করতে হবে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু বলেছেন, সোনার বাংলা গড়তে হলে সোনার মানুষ গড়তে হবে।
হাইকোর্ট আরও বলেন, ঘুস-দুর্নীতি-অর্থ পাচার দিয়ে সোনার মানুষ গড়া যায় না। এর জন্য সবাইকে নিজ নিজ জায়গা থেকে কাজ করতে হবে। আইনজীবী, সাংবাদিকসহ সমাজের সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। শুধু সরকারের ওপর নির্ভর করলে চলবে না। একে আন্দোলনে পরিণত করতে হবে। সবাইকে নিয়ে আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
আদালত আরও বলেন, ভারতে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্পদ বিবরণী সংক্রান্ত আইন আছে। সরকারি চাকরিতে যোগ দেওয়ার সময় তাদের সম্পদের হিসাব দিতে হয়। আবার অবসরে যাওয়ার আগেও দিতে হয়। দুই হিসাবের মধ্যে ১০ শতাংশের বেশি হেরফের হলেই ধরা হয়। আমাদের দেশে আইন আছে। কিন্তু প্রয়োগ নেই।
ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল একেএম আমিন উদ্দিন মানিক শুনানিতে বলেন, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে দুর্নীতি সূচকে বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। তখন জোট সরকার জরিমানা দিয়ে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দিয়েছিল, যা দুর্নীতিকে উৎসাহিত করেছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা করেছিলেন। এই সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা করেছে।