প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর বন্ধুত্বে বিকশিত হোক
সাইফুল আলম
প্রকাশ: ২১ জুন ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর
১.
‘পৃথিবীতে স্থায়ী শত্রুতা বা স্থায়ী বন্ধুত্ব বলে কিছু নেই, যা আছে তা হলো স্থায়ী স্বার্থ।’
-উথান্ট, জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর বিশ্বে উনিশ শতকের বাস্তবতায় এই উক্তি সত্য ছিল সন্দেহ নেই। কিন্তু একুশ শতকে এই মাইন্ডসেট সম্পূর্ণ অগ্রহণীয় এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। নতুন শতকে পালটে গেছে বাস্তবতা, পালটে যাচ্ছে পৃথিবী। দেশ, মহাদেশের বাইরে আমরা হয়ে উঠছি এক পৃথিবীর বাসিন্দা। ক্ষণস্থায়ী শত্রুতা আর ক্ষণস্থায়ী বন্ধুত্বের অবসান ঘটিয়ে চিরস্থায়ী বন্ধুত্বই একুশ শতকের সত্যিকার বাস্তবতা।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনুসৃত ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে শত্রুতা নয়’-রাষ্ট্র হিসাবে স্বাধীন বাংলাদেশের এই পররাষ্ট্রনীতি প্রচলিত জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রনীতির মাইন্ডসেটের ব্যতিক্রম। সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের অভ্যুদয় এক ঐতিহাসিক অধ্যায়। স্বাধীন দেশের পররাষ্ট্রনীতি আমাদের সেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় রচিত। স্বাভাবিকভাবেই যা পুরোনো মানসিকতার বাইরে। এই যুদ্ধে আমরা যেমন আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্রের অকুণ্ঠ সাহায্য, সহযোগিতা, সক্রিয় সমর্থন পেয়েছি, তেমনি একইভাবে সারা বিশ্ব ছিল আমাদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের সঙ্গে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ছিল এক অভূতপূর্ব সংগ্রাম-যাতে শামিল ছিলেন বিশ্বের সব মানবতাবাদী মানুষ। তাই আমাদের পথচলা সবার সঙ্গে-কারও বিরুদ্ধে নয়। কারও প্রতি বৈরিতা নয়।
২.
টানা তৃতীয় দফায় নির্বাচিত ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আমন্ত্রণে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ শুক্রবার ভারত সফরে যাচ্ছেন। দুদিনের সফরে দুই নেতার মধ্যে শনিবার অনুষ্ঠেয় শীর্ষ বৈঠক হবে নানাভাবে ঐতিহাসিক।
৩.
বাংলাদেশ ও ভারত, দুদেশের সম্পর্ক এখন বন্ধুত্বপূর্ণ, বহুমাত্রিক, উজ্জ্বল ও পরীক্ষিত। গত এক দশকে দুদেশের মধ্যে বিরাজমান অনেক সমস্যার সমাধান করেছেন উভয় দেশের নেতৃত্ব। বহু চড়াই-উতরাই পেরিয়ে তিনবিঘা সমস্যার সমাধান, সমুদ্রসীমা নির্ধারণ, ছিটমহল চুক্তি সম্পন্ন করা সম্ভব হয়েছে। যোগাযোগ ও বিদ্যুৎ খাতে ব্যাপক সহযোগিতা সম্প্রসারিত হয়েছে। ভারতের সঙ্গে আমাদের বাণিজ্য ঘাটতি দ্বিগুণ কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে রপ্তানি বেড়েছে ৬-৭ বিলিয়ন থেকে ১০ বিলিয়নে। এই সফরের মধ্য দিয়ে দুদেশের বহুমাত্রিক সম্পর্কের আরও সম্প্রসারণ ঘটবে।
ভারত আমাদের প্রায় চতুর্দিক বেষ্টন করে থাকা এক প্রতিবেশী। স্বাভাবিক কারণেই আমাদের সম্পর্ক শত্রুতায় নয়, বন্ধুত্বের জমিনেই স্থাপিত এবং বিকশিত হতে হবে। ঐতিহাসিকভাবে আমরা ভারতবর্ষের সন্তান। সিন্ধু সভ্যতা, হরপ্পা-মহেঞ্জদারোর সভ্যতা আমাদের গর্ব ও গৌরবের ঐতিহ্য। আমরা এ উপমহাদেশের মানুষ পরস্পর পরস্পরের মিত্র বৈ শত্রু নয়। তাই এ অঞ্চলের মানুষের ভেতরকার সম্পর্কের টানাপোড়েনকে পেরিয়ে আমাদের বহুমাত্রিক ঐক্যের শক্তিকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। তাই বর্তমানে যেসব সমস্যা পীড়িত করে সেসব সমস্যা সমাধানে আমাদের সব সময় সক্রিয় থাকতে হবে। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত হত্যার সম্পূর্ণ সমাধান করতে হবে। তিস্তা নদীর পানিবণ্টনের সমস্যার অবসান ঘটাতে হবে।
১৯৭১-এ আমাদের মুক্তিযুদ্ধে আমরা যেমন ভারতের অকুণ্ঠ সাহায্য-সহযোগিতা পেয়েছি, তেমনি বর্তমানের অর্থনৈতিক উন্নয়নের কর্মকাণ্ডেও সে সহযোগিতা-সমর্থন কাম্য স্বাভাবিকভাবেই। অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়ন, বিনিয়োগ ও বিনির্মাণে দুদেশের নেতৃত্বের দৃষ্টিভঙ্গি যেন ঝাপসা না হয় সেটাই সব সময় কাম্য। দুদেশের সম্পর্ক শুধু বন্ধুত্বের ভেতর দিয়েই বিকশিত হতে পারে, পরস্পর পরস্পরকে মর্যাদাদানের মধ্য দিয়ে-এ কথা যেন আমরা না ভুলি।
৪.
দুদেশের প্রধানমন্ত্রী পর্যায়ের শীর্ষ বৈঠক শুধু ভারত-বাংলাদেশই নয়, উপমহাদেশের সব প্রতিবেশীর কল্যাণের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে-এটাই আমরা বিশ্বাস করি দৃঢ়চিত্তে। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, যার রচনা আমাদের উভয় দেশের জাতীয় সংগীত, তার আকাঙ্ক্ষার কথা স্মরণ করছি, তারই পঙ্ক্তিমালায়-
‘হে মোর চিত্ত, পূর্ণ তীর্থ জাগোরে ধীরে
এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে।
কেহ নাহি জানে কার আহ্বানে কত মানুষের ধারা
দুর্বার স্রোতে এল কোথা হতে সমুদ্রে হল হারা।
হেথায় আর্য, হেথা অনার্য হেথায় দ্রাবিড়, চীন-
শক-হুন-দল পাঠান মোগল এক দেহে হল লীন।
দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে যাবে না ফিরে,
এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে।’
-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
সাইফুল আলম : সম্পাদক দৈনিক যুগান্তর, সাবেক সভাপতি, জাতীয় প্রেস ক্লাব, ঢাকা
saifulalam.editorjugantor@gmail.com