নৌমন্ত্রণালয়ের উচ্চপর্যায়ের তদন্ত প্রতিবেদন
২০ প্রকল্পে অতিরিক্ত ব্যয় ৯৩৭৫ কোটি টাকা
চলমান ৩২ প্রকল্পের মধ্যে ২৪টির মেয়াদ বেড়েছে ৬৮ বছর বা গড়ে ২ বছর ১০ মাস * সঠিকভাবে সম্ভাব্যতা যাচাই না করা, ডিপিপি তৈরিতে দুর্বলতাসহ ১৪ কারণ চিহ্নিত * মূল প্রকল্পের সঙ্গে লিংক প্রকল্প গ্রহণ বা বাস্তবায়ন না হওয়ায় কাঙ্ক্ষিত সুফল ও সেবা পাওয়া যায় না -কমিটির পর্যবেক্ষণ
কাজী জেবেল
প্রকাশ: ২০ জুন ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে বাস্তবায়নাধীন ৩২টি প্রকল্পের মধ্যে ২৪টি নির্ধারিত ব্যয় ও সময়ের মধ্যে শেষ হয়নি। এর মধ্যে ২০টি প্রকল্পের জন্য নির্ধারিত যে ব্যয় ধরা ছিল, তার চেয়ে অতিরিক্ত ৯ হাজার ৩৭৫ কোটি টাকা ব্যয় বেড়েছে। ২৪টি প্রকল্পের মেয়াদ বেড়েছে মোট ৬৮ বছর। এই হিসাবে একেকটি প্রকল্প বাস্তবায়নে গড়ে ২.৮৫ বছর বেশি সময় লাগছে। একটি প্রকল্পে মেয়াদ বেড়েছে সর্বোচ্চ ৮ বছর। ওই প্রকল্পটি ৩ বছরে বাস্তবায়নের লক্ষ্য ছিল। খোদ নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়ের উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে নির্দিষ্ট সময় ও ব্যয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন না হওয়ার এমন চিত্র উঠে এসেছে। ঈদুল আজহার আগে নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবের কাছে ৯ জুন এ প্রতিবেদন জমা দিয়েছে তিন সদস্যের উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি। তবে ওই প্রতিবেদনে যেসব প্রকল্পের ব্যয় ও মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব এখনো সরকার অনুমোদন দেয়নি, সেগুলো উল্লেখ করা হয়নি। সেগুলো ধরা হলে বাড়তি ব্যয় ও মেয়াদ আরও বাড়বে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
আরও জানা গেছে, ওই তদন্ত প্রতিবেদনে নির্ধারিত ব্যয় ও মেয়াদে প্রকল্প বাস্তবায়ন না হওয়ার ১৪টি কারণ উল্লেখ করা হয়েছে। সঠিকভাবে সম্ভাব্যতা যাচাই না করে প্রকল্প নেওয়া, ডিজাইন-স্ট্রাকচার পরিবর্তন, ডিপিপি (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) প্রণয়নে দুর্বলতাসহ ১৪টি কারণ উল্লেখ করা হয়েছে। এতে নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থা ও প্রকল্প পরিচালকদের ত্রুটিও উঠে এসেছে। কমিটি তাদের সার্বিক পর্যালোচনায় প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বিশেষ করে সম্ভাব্যতা যাচাই, ডিপিপি প্রণয়ন, পরামর্শক নিয়োগ, ডিজাইন ও ড্রয়িং প্রস্তুত, প্রকিউরমেন্ট কাজের অগ্রগতি মনিটরিংয়ে প্রকল্প পরিচালক, সংস্থা প্রধান ও পিআইসির (প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি) ভূমিকা অধিক ফলপ্রসূ নয় বলে উল্লেখ করেছে। কমিটি তাদের পর্যবেক্ষণে বলেছে, মূল প্রকল্পের সঙ্গে লিংক প্রকল্প গ্রহণ বা বাস্তবায়ন না হওয়ায় কাঙ্ক্ষিত সুফল ও সেবা পাওয়া যায় না। প্রতিবেদনে প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই সঠিকভাবে করা, পরামর্শক প্রতিষ্ঠান একই কাজের একাধিকবার সংশোধনের সুপারিশ করলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া, প্রকল্প পরিচালকদের অদক্ষতার প্রমাণ পেলে ব্যবস্থা নেওয়াসহ ১৩ দফা সুপারিশ করেছে।
প্রতিবেদনের বিষয়ে জানতে চাইলে নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. মোস্তফা কামাল বুধবার বিকালে যুগান্তরকে বলেন, তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন পেয়েছি। ওই প্রতিবেদন উপস্থাপন করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বলা হয়েছে। প্রতিবেদনে যেসব বিষয় এসেছে সেগুলো অবশ্যই আমরা দেখব।
৩ এপ্রিল ‘প্রকল্প বাস্তবায়নে নৌমন্ত্রণালয়ের ব্যর্থতা : বাড়তি ১০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের বোঝা’ শীর্ষক সংবাদ প্রকাশ করে যুগান্তর। এর পরদিনই ৪ এপ্রিল মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব ড. মো. রফিকুল ইসলাম খানকে প্রধান করে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। কমিটিতে আরেক যুগ্মসচিব মো. গোলাম রাব্বীকে সদস্য এবং উপসচিব মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম মিঞাকে সদস্য সচিব করা হয়। কমিটিকে ১০ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়। কিন্তু কমিটির প্রতিবেদন দিতে সময় লেগেছে ২ মাস।
যুগান্তরে প্রকাশিত ওই সংবাদে বলা হয়, ‘অন্তত ১৫টি প্রকল্পের ব্যয় বেড়েছে ৬ হাজার ২০০ কোটি টাকা। আরও কিছু প্রকল্প সংশোধন হচ্ছে। সেসব প্রকল্পেও ব্যয় বাড়তে পারে সাড়ে তিন থেকে চার হাজার কোটি টাকা। ফলে বাড়তি ১০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের বোঝা চাপছে সরকারের কাঁধে।’ তদন্ত কমিটি তাদের প্রতিবেদনে ২০টি প্রকল্পে ইতোমধ্যে ৯ হাজার ৩৭৫ কোটি ৪৭ লাখ টাকা অতিরিক্ত ব্যয় বেড়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। যেসব প্রকল্পের ব্যয় ও মেয়াদ বাড়ার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে-সেসব বিষয়ে উল্লেখ করেনি।
এছাড়া টেন্ডার প্রক্রিয়ায় অনিয়ম, প্রাক্কলনের চেয়ে বেশি দরে ঠিকাদার নিয়োগ এবং প্রকল্প বাস্তবায়নে গাফিলতি ও অদূরদর্শিতা চিহ্নিত করা এবং এ বিষয়ে করণীয় নিয়ে মতামত দেয়নি কমিটি। কমিটির একজন সদস্য বলেন, কয়েকটি প্রকল্পের ব্যয় ও মেয়াদ বাড়ার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। সেগুলো কত টাকা ব্যয় বাড়বে তা কমিটি নিশ্চিত না হওয়ায় তা উল্লেখ করা হয়নি।
জানা গেছে, প্রতিবেদনের সঙ্গে যেসব প্রকল্পের মেয়াদ ও ব্যয় বেড়েছে সেগুলোর তালিকা, কত টাকা ও কত বছর মেয়াদ বেড়েছে তা সংযুক্ত করে দিয়েছে তদন্ত কমিটি। নথিপত্র পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহণ কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ), পায়রা বন্দর, মোংলা বন্দর, চট্টগ্রাম বন্দর ও বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের প্রকল্পগুলোর ব্যয় বাড়ার হার তুলনামূলক বেশি। টাকার অঙ্ক হিসাবে যেসব প্রকল্পের ব্যয় বেশি বেড়েছে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে মাতারবাড়ী বন্দর উন্নয়ন প্রকল্প (চবক অংশ)।
বিআইডব্লিউটিএর মোংলা বন্দর থেকে চাঁদপুর-মাওয়া-গোয়ালন্দ হয়ে পাকশী পর্যন্ত নৌ-রুটের নাব্য উন্নয়ন প্রকল্পে ৩৩৪ কোটি টাকা বাড়তি ব্যয় বেড়েছে। আশুগঞ্জ অভ্যন্তরীণ কনটেইনার নদী বন্দর স্থাপন প্রকল্পে বেড়েছে ৪৫৮ কোটি টাকা। পায়রা বন্দরের কার্যক্রম পরিচালনার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো সুবিধাদি উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যয় বেড়েছে তিন হাজার ২৪৬ কোটি টাকা। পায়রা বন্দরের প্রথম টার্মিনাল এবং আনুষঙ্গিক সুবিধাদি নির্মাণ প্রকল্পে ব্যয় বেড়েছে ৫৩৪ কোটি ৬৫ লাখ টাকা।
বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, শীতলক্ষ্যা ও বালু নদীর তীরভূমিতে পিলার স্থাপন, তীররক্ষা, ওয়াকওয়ে ও জেটিসহ আনুষঙ্গিক অবকাঠামো নির্মাণ (২ পর্যায়) প্রকল্পের ব্যয় ৩৩২ কোটি ৫৫ লাখ টাকা ও মেয়াদ ২ বছর বেড়েছে। আরও ৯৪ কোটি ৮৫ লাখ টাকা এবং মেয়াদ ১ বছর বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। ওই প্রস্তাব অনুমোদন পেলে প্রকল্পের ব্যয় দাঁড়াবে এক হাজার ২৭৫ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। নৌপরিবহণ অধিদপ্তরের জিএমডিএস প্রকল্পের ব্যয় ৪৪৭ কোটি ৮৬ লাখ টাকা এবং মেয়াদ ৮ বছর বেড়েছে। বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের বাংলাদেশ রিজিওনাল কানেক্টিভিটি প্রজেক্ট-১ প্রকল্পে ২৭৩ কোটি ১২ লাখ টাকা এবং চার বছর মেয়াদ বেড়েছে। মোংলা বন্দরের চারটি প্রকল্পের প্রত্যেকটিতে ১০০ কোটি টাকার বেশি হারে বেড়েছে। একইভাবে অন্যান্য প্রকল্পেরও ব্যয় ও মেয়াদ বাড়ার কথা উল্লেখ করেছে কমিটি।
ব্যয় ও মেয়াদ বাড়ার যেসব কারণ : প্রকল্পের মেয়াদ ও ব্যয় বাড়ার জন্য ১৪টি কারণ চিহ্নিত করেছে তদন্ত কমিটি। এর মধ্যে ব্যয় বাড়ার জন্য আটটি এবং মেয়াদ বাড়ার জন্য ছয়টি কারণ উল্লেখ করেছে। বাড়তি ব্যয়ের বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সঠিকভাবে প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই না করায় প্রকল্পের ব্যয় বাড়ছে। পরামর্শক প্রতিষ্ঠান প্রকল্পের বিভিন্ন অঙ্গ পরিবর্তন ও সংশোধন করায় মেয়াদ বাড়ছে। এর ফলে ব্যয়ও বাড়ছে। আবার প্রকল্পের বিভিন্ন অঙ্গ যুক্ত করা বা বাদ দেওয়ার কারণেও ব্যয় বাড়ছে। দরপত্র প্রাক্কলনে মেয়াদ বাড়ানোর কারণে সময়ের ব্যাপ্তিতে রেট শিডিউল পরিবর্তন হওয়ায় মূল্য বাড়ছে। ভূমি অধিগ্রহণে ক্ষতিপূরণের হার সময়ের ব্যাপ্তিতে দ্বিগুণ থেকে তিনগুণ হওয়ার কারণেও খরচ বাড়ছে। ড্রেজিং প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ার কারণে সংরক্ষণ ড্রেজিংয়ের পরিমাণ বাড়ছে। এর ফলেও প্রকল্পের ব্যয় বাড়ছে। ডিপিপি প্রণয়নের সময়ে বিমা এবং এলসি চার্জ বা সিডি, এসডি, ভ্যাট ও এআইটি ডিপিপিতে না থাকায় এবং সেগুলোর পরবর্তীতে অন্তর্ভুক্ত করতে গিয়ে প্রকল্পের ব্যয় বাড়ছে। নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা জানান, প্রকল্প গ্রহণের আগে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের নিয়ম রয়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কাগজে-কলমে সম্ভাব্যতা যাচাই দেখানো হয়। ওই প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে নানা ধরনের জটিলতা তৈরি হয়।
প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ার কারণ হিসাবে বলা হয়েছে-জমি অধিগ্রহণ ও হস্তান্তর জটিলতা, ডিপিপি প্রাক্কলনে দুর্বলতা, প্রকল্পের ডিজাইন-স্ট্রাকচার পরিবর্তন, এলসি খুলতে বিলম্ব, সীমান্তে অবকাঠামো নির্মাণে জটিলতা এবং ড্রেজিং সামগ্রীর ব্যবস্থাপনায় সমস্যা।
কমিটির সুপারিশ : প্রতিবেদনে নির্দিষ্ট ব্যয় ও সময়ের মধ্যে প্রকল্প শেষ করতে ১৩টি সুপারিশ করা হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য সুপারিশ হচ্ছে-প্রকল্প নেওয়ার আগে সম্ভাব্যতা যাচাই কার্যক্রম সঠিকভাবে অনুসরণ করতে হবে। সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়া কোনো প্রকল্প যাতে গ্রহণ না করা হয়, তা সংস্থা প্রধান নিশ্চিত করবেন।
পরামর্শক প্রতিষ্ঠান কোনো অঙ্গের একাধিকবার সংশোধন সুপারিশ করলে ওই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অদক্ষতার জন্য আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে। নিজ দায়িত্বের অতিরিক্ত হিসাবে প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্ব দেওয়া যথাসম্ভব পরিহার করা যেতে পারে। প্রকল্প পরিচালকদের অদক্ষতার প্রমাণ পাওয়া গেলে তাদের বিরুদ্ধে বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া। পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের বিল পরিশোধ প্রচলিত মেয়াদ ভিত্তিকের পরিবর্তে কাজ বাস্তবায়ন হার অনুযায়ী পরিশোধ করা যেতে পারে। সংস্থা প্রধানদের পিআইসি (প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি) সভা ফলপ্রসূ করতে হবে। বার্ষিক কর্মসম্পাদন অগ্রগতির ভিত্তিতে প্রকল্প পরিচালকদের মূল্যায়নের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।