Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

মিন্টুকে ডিবি হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদ

মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে দেশ ছেড়েছে শাহীন

Icon

সিরাজুল ইসলাম

প্রকাশ: ১৩ জুন ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে দেশ ছেড়েছে শাহীন

ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ-সদস্য (এমপি) আনোয়ারুল আজিম আনার হত্যাকাণ্ডের পর মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে আমেরিকায় পালিয়েছে আক্তারুজ্জামান শাহীন। ১৭ মে ফরিদপুরের ভাঙার একটি স্থানে হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনাকারী এবং মিশন বাস্তবায়নকারীদের সঙ্গে তার বৈঠক হয়। সেখানেই ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক কাজী কামাল আহম্মেদ ওরফে গ্যাস বাবুর কাছ থেকে টাকা নেয় শাহীন। এর আগে আনারের লাশের ছবি দেখে নিশ্চিত হয় বাবু। কিন্তু সেই টাকা কিলারদের দেওয়া হয়নি। এরই মধ্যে ২০ মে শাহীন দেশ ছাড়ে। দেশ ছাড়ার পরও সে হত্যা মিশন বাস্তবায়নকারীদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছে। তদন্তসংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য। 

এদিকে এমপি আনারের মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন বলেছেন, অপরাধীদের বাঁচাতে অনেক বড় জায়গা থেকে ফোন আসছে। কোনো তদবির বা চাপের কারণে তিনি যেন ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত না হন, সেই দাবি জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের কাছে। অপরদিকে এমপি আনার হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও ঝিনাইদহ সদর পৌরসভার সাবেক মেয়র সাইদুল করিম মিন্টুকে বুধবার ডিবি হেফাজতে দ্বিতীয় দিনের মতো জিজ্ঞাসাবাদ করছে ডিবি। এর আগে মঙ্গলবার ধানমন্ডি এলাকা থেকে তাকে আটক করে ডিবির ওয়ারী বিভাগ। অপরদিকে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ জানিয়েছেন, এমপি আনার হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় কাটআউট পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে। 

তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, রিমান্ডে বাবুকে নিবিড়ভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করছে ডিবি। আটককৃত আওয়ামী লীগ নেতা মিন্টুর কাছ থেকে তথ্য বের করতে কৌশলী অবস্থানে থেকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে ডিবি। রিমান্ডপ্রাপ্ত বাবু এবং আটক মিন্টুর কাছ থেকে যেসব বক্তব্য পাওয়া যাচ্ছে সেগুলো ক্রস চেক করা হচ্ছে। দুজনের বক্তব্যে যেসব বিষয়ে ভিন্নতা এসছে সেসব বিষয় যাচাই করতে দুজনকে এরই মধ্যে মুখোমুখি করা হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদে কোনো বিষয় তারা অস্বীকার করলে তাদের সামনে প্রযুক্তিগত প্রমাণও হাজির করা হচ্ছে। জিজ্ঞাসাবাদে এই দুজনের কাছ থেকে চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেলেও তদন্তের স্বার্থে এই মুহূর্তে তা প্রকাশ করা যাচ্ছে না বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।

সূত্র জানায়, চাঞ্চল্যকর এ খুনের সমন্বয়ক আমানুল্লাহ ওরফে শিমুল ভূঁইয়ার সঙ্গেই বেশি যোগাযোগ হয় পলাতক শাহীনের। দেশ ছাড়ার পর টাকার জন্য সে শিমুল ভূঁইয়াকে ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক কাজী কামাল আহম্মেদ ওরফে গ্যাস বাবুর সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলে। আরও জানায়, বাবু তাকে (শিমুল ভূঁইয়া) দুই কোটি টাকা দেবে। সে অনুযায়ী শিমুল ভূঁইয়া যোগাযোগ করে বাবুর সঙ্গে। বাবুও টাকা দিতে রাজি হয় শিমুলকে। এজন্য সময় নির্ধারণ করা হয় ২৩ মে। বলা হয় ২৩ মে কোনো কারণে টাকা দিতে না পারলে ওই টাকা দেওয়া হবে ২৬ মে। কারণ, ২৩ মে বৃহস্পতিবার। ওই দিন না হলে ব্যাংক বন্ধ থাকার কারণে ২৪ ও ২৫ মে (শুক্র ও শনিবার) টাকা লেনদেন করা সম্ভব হবে না। এদিকে ২২ মে হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি ফাঁস হয়ে যাওয়ার পর ঘাতকরা আত্মগোপনে চলে যায়। এ কারণে ওই দুই কোটি টাকা লেনদেন করা সম্ভব হয়নি। 

বুধবার সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সঙ্গে সাক্ষাতের পর এমপি আনারের মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন সাংবাদিকদের বলেন, অপরাধীদের বাঁচাতে অনেক বড় জায়গা থেকে তদবির হচ্ছে। কোনো তদবিরের চাপে বাবা হত্যার বিচার যাতে বন্ধ না হয়। যেন আটককৃতদের ছেড়ে দেওয়া না হয়। ডরিন বলেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে বলেছি যে, আমার বাবা হত্যাকাণ্ডের শিকার, সেটার যাতে সঠিক বিচার হয়, সঠিক বিচারটা যাতে আমাকে নিশ্চিত করা হয়, সেই দাবি জানিয়েছি। চাপের মুখে যাতে সঠিক তদন্ত বন্ধ করা না হয়, সেই দাবি জানিয়েছি। ডরিন বলেন, গ্যাস বাবু নামে যাকে আটক করা হয়েছ, তিনি বাবার প্রতিপক্ষ না। আমাদের সঙ্গে তার কোনো শত্রুতাও নেই। আমার মনে অনেক প্রশ্ন জাগছে। ১৭ তারিখে ঘাতকদের সঙ্গে তার দেখা হয়েছে ভাঙ্গায়। সেখানে একটা লেনদেনের কথা উঠেছে, যা আমি খবরে শুনেছি। 
আমার কথা হলো, এ টাকার জোগানদাতা কে? কেন তারা এটা করিয়েছে? আপনারা দেখেছেন, তাকে আটকের আগে তিনি নিজেই থানায় জিডি করেছেন। জিডিতে বলেছেন, তার তিনটি ফোন হারিয়ে গেছে। একই দিনে একজন মানুষের তিনটি ফোন কীভাবে হারিয়ে যায়, সেটাও আমার প্রশ্ন। এগুলো কী পরিকল্পিতভাবে করা হয়েছে? বাবু তো আমার বাবার শত্রু না। এই কাজগুলো কে করাচ্ছে, সেটা আমি বারবার বলেছি।

তিনি বলেন, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম মিন্টুকেও জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডিবি কার্যালয়ে নেওয়া হয়েছে। অবশ্যই তাদের কাছে সত্যিকারের কোনো তথ্যপ্রমাণ আছে, সেটা আমি নিজেও জানি। সেই প্রমাণ সাপেক্ষেই তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তিনি আরও বলেন, সঠিক বিচারের আশ্বাস দিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, এক্ষেত্রে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। যেটা আইনে আসবে, যেটা সত্য, সেটা উঠে আসবে। আমি বাবা হত্যার ন্যায়বিচার চাই।

বুধবার বিকালে রাজধানীর মিন্টু রোডে নিজ কার্যালয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, এমপি আনারকে হত্যায় খুনিরা কাট-আউট পদ্ধতি ব্যবহার করেছে। হত্যাকারীদের উদ্দেশ্য ছিল মরদেহ গুম করা। যাতে কোনো দিন মরদেহ খুঁজে না পাওয়া যায়। তিনি বলেন, আমরা এমপি আনার হত্যায় ডিজিটাল এভিডেন্স পেয়েছি। বিভিন্ন ঘটনাস্থল আমরা পরিদর্শন করেছি। তারা যে ঠান্ডা মাথায় হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। পৈশাচিক কায়দায় নৃশংসভাবে এই লাশটা গুম করার চেষ্টা করা হয়। উদ্দেশ্য ছিল, যাতে কোনোদিন মরদেহের কোনো অংশ না পাওয়া যায়। এজন্য তারা জিহাদ ও সিয়ামকে ব্যবহার করেছে। 

এক প্রশ্নের জবাবে মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, এমপি আনার হত্যাকাণ্ড নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম মিন্টুকে ডিবি কার্যালয়ে আনা হয়েছে। তিনি বলেন, মূল ঘাতক শিমুল ভূঁইয়াসহ তিনজনের দেওয়া জবানবন্দিতে নাম এসেছে ‘গ্যাস বাবুর’। গ্যাস বাবুকের গ্রেফতারের পর তার দেওয়া তথ্যে নাম আসে ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মিন্টুর। তথ্য-উপাত্ত বিচার বিশ্লেষণের জন্যই তাকে ডাকা হয়েছে। তদন্ত কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদে সদুত্তর দিতে পারলে মিন্টুকে ছেড়ে দেওয়া হবে। আর না পারলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। গোয়েন্দা কর্মকর্তা হারুন বলেন, আনার হত্যাকাণ্ড নিয়ে আরও অনেকের তথ্যপ্রমাণ রয়েছে। যাদের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যাবে তাদের কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। গোয়েন্দা পুলিশ সব সময় স্বাধীনভাবে মামলা তদন্ত করে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কোনো চাপ থাকে না।

১২ মে ভারতে যান এমপি আনার। পরদিন ১৩ মে কলকাতার নিউটাউন এলাকার সঞ্জীবা গার্ডেনের একটি ফ্ল্যাটে খুন হন তিনি। ঘটনাটি প্রকাশ্যে আসে ২২ মে। ওইদিন রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় আনারের মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন (২৪) বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে অপহরণ মামলা করেন। এছাড়া ভারতে চলছে হত্যা মামলার তদন্ত।

২৪ ঘণ্টার মধ্যে মিন্টুকে ফিরিয়ে দেওয়ার দাবিতে ঝিনাইদহে বিক্ষোভ : ঝিনাইদহ প্রতিনিধি জানান, এমপি আনোয়ারুল আজিম আনার হত্যার ঘটনায় আটক জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম মিন্টুকে জনতার মাঝে ফিরিয়ে দেওয়ার দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল ও মানববন্ধন হয়েছে। জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ, শ্রমিক লীগ, কৃষক লীগসহ বিভিন্ন অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী, সমর্থক নারী পুরুষ এ কর্মসূচিতে অংশ নেন। বুধবার বেলা ১১টার দিকে জেলা শহরে বিক্ষোভ মিছিল শেষে স্থানীয় পায়রা চত্বরে অনুষ্ঠিত হয় মানববন্ধন। এক ঘণ্টাব্যাপী চলা এ মানববন্ধনে বক্তব্য রাখেন জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি শাহরিয়ার করিম রাসেল, সাধারণ সম্পাদক রানা হামিদ, কৃষক লীগের সাধারণ সম্পাদক আশরাফুল ইসলাম, জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আল এমরানসহ অনেকে।

বক্তারা বলেন এমপি আনোয়ারুল আজিম আনার হত্যার ঘটনায় ষড়যন্ত্রমূলক ভাবে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে সাইদুল করিম মিন্টুকে ফাঁসানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। এমপি আনার হত্যার ঘটনার মোড় ভিন্ন দিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য সাইদুল করিম মিন্টুকে আটক করা হয়েছে। প্রকৃত পক্ষে যারা জড়িত তাদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনার দাবি জানান তারা। মানববন্ধন থেকে আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আটক মিন্টুকে ছেড়ে দেওয়ার আলটিমেটাম দেওয়া হয়েছে। অন্যথায় আরও বড় ধরনের আন্দোলন কর্মসূচি দেওয়া হবে বলে ঘোষণা দেন নেতারা। 

কালীগঞ্জে এমপি আনারের অনুসারীদের বিক্ষোভ মিছিল : কালীগঞ্জ (ঝিনাইদহ) প্রতিনিধি জানান, এমপি আনোয়ারুল আজিম আনার হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় জড়িতদের দ্রুত শাস্তির দাবিতে বিক্ষোভ করেছেন তার অনুসারীরা। বুধবার বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে শহরের ভূষণ স্কুল সড়কের দলীয় কার্যালয় থেকে মিছিল বের হয়। মিছিলটি প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ শেষে আবার একই স্থানে গিয়ে সংক্ষিপ্ত সমাবেশে মিলিত হয়। এ সময় উপস্থিত ছিলেন পৌরসভার মেয়র আশরাফুল আলম, ভাইস চেয়ারম্যান শফিকুজ্জামান রাসেল, যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর হোসেন সোহেলহ অন্যান্যরা। সংক্ষিপ্ত সমাবেশে কালীগঞ্জ পৌরসভার মেয়র আশরাফুল আলম বলেন, এমপি আনার হত্যার সঙ্গে অনেক পরিকল্পনাকারীর নাম আসছে। ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদককে কে বা কারা নিয়ে গেছে আমরা জানি না। 
গোয়েন্দা সংস্থা কোনো তথ্য-উপাত্ত ছাড়া কাউকে নেন না। যদি তিনি গোয়েন্দা সংস্থার কাছে সদুত্তর দিতে পারেন তাহলে উনাকে সম্মানের সঙ্গে ছেড়ে দেবে এটা আমরাও চাই। আর যদি উনি এ হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকেন তাহলে তার ফাঁসি ও দল থেকে বহিষ্কারের দাবি জানান তিনি। 

এদিকে এমপি আনারের মেয়ে ডরিন এক ফেসবুক পোস্টে মিন্টুর ফাঁসি চেয়েছেন। তিনি লিখেছেন, ‘আমি সাইদুল করিম মিন্টুর ফাঁসি চাই। কিডা কি বড় নেতা আমার দেখার বিষয় না। আমি আমার বাবার হত্যার বিচার চাই। আর যারা এগুলোর পক্ষ নিতেছেন আমি বিশ্বাস করি আমার বাবার নির্মমভাবে হত্যার সঙ্গে আপনারা জড়িত। তাদেরকেও আমি আইনের আওতায় নিয়ে আসতে চাই।’
 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম