কাগুজে টাকাবিহীন সমাজ, লেনদেন রাত-দিন ২৪ ঘণ্টা
ডিজিটাল লেনদেনে সহজ জীবন
গ্রামে টাকা পাঠানো, গ্যাস-বিদ্যুতের বিল পরিশোধ, কেনাকাটা, ঋণ সবকিছুই এখন ব্যাংক কার্ড ও মোবাইল ফোনে
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ১২ জুন ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ব্যাংকে গিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে বিদ্যুৎ বিল পরিশোধের সেই ভোগান্তির কথা ভুলে যাননি সরকারি চাকরিজীবী শরিফুল হাসান খান। তিনি বলেন, ‘ব্যাংকে গিয়ে দেখতাম ২০ থেকে ৩০ জন মানুষ লাইনে। ওদিকে অফিসে যাওয়ার তাড়া।’ শরিফুল এখন মোবাইল ফোনেই বিদ্যুৎ বিল দেন। মোবাইল ফোনে টাকা ভরতেও তিনি দোকানে যান না। মোবাইলে আর্থিক সেবার (এমএফএস) অ্যাপ থেকে টাকাটা ভরে নেন। অ্যাপে টাকা ভরা যায় ব্যাংকের কার্ড দিয়ে। পবিত্র ঈদুল আজহার কেনাকাটা, আত্মীয়স্বজনের জন্য গ্রামে টাকা পাঠানো-সবকিছুই শরিফুল করছেন এমএফএস অ্যাপ ও ব্যাংকের কার্ড ব্যবহার করে। তিনি বলেন, ‘ব্যাংকে গিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার কথা এখন আর ভাবতেও পারি না।’
শরিফুল হাসান খান একজন সচ্ছল মানুষ। ডাব বিক্রেতা নাঈম হোসেন অসচ্ছল। তবে তার জীবনও সহজ করেছে ডিজিটাল লেনদেন। নাঈমের বাড়ি বরিশাল জেলার প্রত্যন্ত গ্রামে। স্ত্রী ও তিন ছেলেমেয়ে সেখানে থাকে। তিনি দীর্ঘদিন ধরে ঢাকায় ভ্যানে ডাব বিক্রি করেন।
নাঈম হোসেন বলেন, ‘আগে টাকা পাঠাতে হলে খোঁজ রাখতে হতো কে বাড়ি যাবে। আমি থাকতাম এমন লোকের খোঁজে। আর স্ত্রী থাকত টাকার অপেক্ষায়।’ তিনি বলেন, এমনও হয়েছে, যে লোকের কাছে তিনি টাকা পাঠিয়েছেন, তিনি টাকা পৌঁছে না দিয়ে খরচ করে ফেলেছেন।
নাঈম এখন স্ত্রীর মোবাইল ফোনে যখন-তখন টাকা পাঠিয়ে দেন। টাকা পাঠানোর পর স্ত্রীর ফোন আসে। সঙ্গে সঙ্গে জেনে যান স্ত্রী টাকা পেয়েছেন। ছেলেমেয়েদের খোঁজও নেওয়া হয়। নাঈমের কাছে জানতে চাইলাম, জীবন কি সহজ হয়েছে? ডাবে কোপ দিয়ে মুচকি হেসে উত্তর দিলেন, ‘হইছে তো।’
ঢাকা থেকে প্রত্যন্ত গ্রামে যেমন ক্ষণিকের মধ্যেই টাকা চলে যাচ্ছে, তেমনি দূরের দেশ থেকে এখন টাকা চলে আসছে বাংলাদেশে, যাকে বলা হয় রেমিট্যান্স। মানুষ কেনাকাটা করছেন, বিল পরিশোধ করছেন; প্রতিষ্ঠান সেই টাকা পেয়ে প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের বেতন দিচ্ছে। পুরো প্রক্রিয়াটি হচ্ছে ডিজিটাল ব্যবস্থায় ব্যাংকের কার্ড, অ্যাপ ও মুঠোফোনের মাধ্যমে। মাসে এ ব্যবস্থায় লেনদেনের অঙ্ক প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকা।
ডিজিটাল লেনদেন হচ্ছে নানামুখী ব্যবস্থায় ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ড; বিকাশ, রকেট, নগদ ও উপায়ের মতো এমএফএস; ইন্টারনেট ব্যাংকিং, অ্যাপে লেনদেন, ডিজিটাল ব্যবস্থায় তহবিল স্থানান্তর (ইলেকট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফার), তাৎক্ষণিক লেনদেন সম্পন্ন করা বা রিয়েল টাইম গ্রস সেটেলমেন্ট ইত্যাদি। কার্ডের বদলে অ্যাপস ও কিউআর কোডের ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। মোবাইল ফোনই হয়ে উঠছে লেনদেনের বড় মাধ্যম।
বাংলাদেশ ব্যাংকও ২০২৫ সালের মধ্যে দেশের সব লেনদেনের ৩০ শতাংশ ‘ক্যাশলেস’, তথা ডিজিটাল মাধ্যমে আনার লক্ষ্য ঠিক করেছে।
এ প্রসঙ্গে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মুহাম্মদ মুনিরুল মওলা যুগান্তরকে বলেন, ডিজিটাল ব্যাংক লেনদেনে ইসলামী ব্যাংক অনন্য সফলতা অর্জন করেছে। বর্তমানে এ ব্যাংকে দৈনিক প্রায় ২ লাখ ৯৫ হাজার ডিজিটাল লেনদেন সম্পাদিত হয়, যা টাকার হিসাবে প্রায় ১ হাজার ১০৮ কোটি টাকা। শুধু সেলফিনের মাধ্যমে দৈনিক প্রায় ২ লাখ ৫০ হাজার লেনদেন হয়, যা টাকার হিসাবে প্রায় ৭০০ কোটি টাকা। এছাড়া আই-ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে দৈনিক লেনদেন হয় ৪৫ হাজার, যা টাকার হিসাবে প্রায় চারশ কোটি টাকার বেশি। এ লেনদেন বৃদ্ধিতে কাজ করে যাচ্ছি। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলোকে আরও গ্রাহকবান্ধব ও সময়োপযোগী করে তুলছি। বিকাশের হেড অব করপোরেট কমিউনিকেশনস অ্যান্ড পিআর শামসুদ্দিন হায়দার ডালিম যুগান্তরকে বলেন, ঈদের মতো বড় উৎসবে লেনদেনে বড় উল্লম্ফন দেখা যায়। যার অন্যতম কারণ বেতন-বোনাস, বিদেশ থেকে আসা রেমিট্যান্স, ঈদ কেনাকাটা, রেস্টুরেন্টে খাওয়া, ভ্রমণ, প্রিয়জনকে টাকা পাঠানোসহ বিভিন্ন কারণে। আর উৎসবকে কেন্দ্র করে গ্রাহকদের কেনাকাটাকে আনন্দময় করে তুলতে পেমেন্টে নানা ধরনের ক্যাশব্যাক ও ডিসকাউন্ট অফার দিয়ে থাকে বিকাশ।
নগদ লিমিটেডের হেড অব মিডিয়া অ্যান্ড কমিউনিকেশন্স জাহিদুল ইসলাম সজল যুগান্তরকে বলেন, নগদে দৈনিক লেনদেন প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা হলেও ঈদ উপলক্ষ্যে সে অঙ্ক ১৮শ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। এদিকে লেনদেন আরও সহজ করতে দেশে প্রথমবারের মতো ডিজিটাল ব্যাংকের অনুমোদন দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ‘নগদ ডিজিটাল ব্যাংক পিএলসি’ নামের এ ব্যাংকটিকে চলতি বছরের ৩ জুন তফশিলি ব্যাংক হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে নগদ মুখপাত্র জাহিদুল ইসলাম সজল বলেন, প্রথম দফায় নগদ ডিজিটাল ব্যাংক তাৎক্ষণিকতা বজায় রেখে রাত দিন ২৪ ঘণ্টা যে কোনো সময় লেনদেনের সুযোগ করে দেবে। তাছাড়া ক্ষুদ্র সঞ্চয় এবং জামানতবিহীন ও স্বল্প সুদের ঋণ কার্যক্রমের মতো বেসিক সেবা দিয়ে শুরু হবে এ ব্যাংকিং। তবে পর্যায়ক্রমে সাধারণ মানুষের জীবনকে স্পর্শ করে এমন প্রতিটি আর্থিক সেবাকে নগদ ডিজিটাল ব্যাংকের সঙ্গে যুক্ত করা হবে।
জানা গেছে, দেশে এক সময় এক ব্যাংক থেকে টাকা তুলে আরেক ব্যাংকে জমা রাখতে হতো। কারণ, আন্তঃব্যাংক লেনদেনের ব্যবস্থা ছিল না। এক ব্যাংকের চেক অন্য ব্যাংক গ্রহণ করত না। পরে চেক গ্রহণ শুরু হয়, কিন্তু গ্রাহককে অপেক্ষা করতে হতো বেশ কয়েক দিন। এখন চেক জমা দিলে দিনের মধ্যেই টাকা পেয়ে যান গ্রাহক। এটা সম্ভব হয়েছে ডিজিটাল ব্যবস্থায় ‘নিকাশঘর’ বা চেক ক্লিয়ারিং ব্যবস্থা চালুর মাধ্যমে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১০ সালে সেবাটি চালু হয়। এছাড়া ১৯৯২ সালে বাংলাদেশে প্রথম অটোমেটেড টেলার মেশিন বা এটিএম যন্ত্র স্থাপন শুরু করে কয়েকটি ব্যাংক। যার মাধ্যমে কার্ড দিয়ে নগদ টাকা তোলার সুযোগ তৈরি হয়। ১৯৯৬ সালে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক দেশে প্রথম ক্রেডিট কার্ড চালু করে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের মার্চে ক্রেডিট কার্ডে শুধু দেশেই লেনদেন হয়েছে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা। এছাড়া বাংলাদেশিরা বিদেশে গিয়ে ক্রেডিট কার্ডে লেনদেন করেছেন আরও ৫০০ কোটি টাকা। এর বাইরে ইন্টারনেট ব্যাংকিংয়ে মোট গ্রাহক ১ কোটি ২৪ লাখ ছাড়িয়েছে। বিকাশ, নগদ ও রকেটের মতো মোবাইল ফোনে আর্থিক সেবায় গ্রাহক ২২ কোটি ৪০ লাখ ছাড়িয়েছে। ব্যাংকগুলো নিয়ে আসছে নিজস্ব অ্যাপ, যার মাধ্যমে মোটামুটি সব ধরনের লেনদেন করা যায়।
তবে ডিজিটাল লেনদেন মানুষের জীবনকে যেমন সহজ করেছে, তেমনি কিছু সমস্যাও আছে। প্রথমত, মানুষ প্রতারণার শিকার হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, এক ব্যাংক থেকে অন্য ব্যাংকে লেনদেন যতটা সহজ, মোবাইল ফোনে আর্থিক সেবায় একটি প্রতিষ্ঠানের হিসাব থেকে অন্য প্রতিষ্ঠানের হিসাবে (যেমন বিকাশ, রকেট ও নগদ হিসাবের মধ্যকার লেনদেন) ততটা সহজ নয়। তৃতীয়ত, কিছু কিছু সেবা নেওয়া যায় শুধু একটি প্রতিষ্ঠানের হিসাব ব্যবহার করে। ফলে মানুষকে একাধিক হিসাব খুলতে বাধ্য হতে হয়।