Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

এমপি আনার হত্যা : আদালতে সেলেস্তির জবানবন্দি

স্বামী-স্ত্রীর পরিচয়ে ফ্ল্যাট ভাড়া সঞ্জীবায়

নেপালে আটক সিয়ামকে পাচ্ছে না ডিবি * ১০ আসামির ব্যাংক হিসাব অনুসন্ধান করতে তথ্য চেয়েছে ডিবি

Icon

যুগান্তর প্রতিবেদন

প্রকাশ: ০৪ জুন ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

স্বামী-স্ত্রীর পরিচয়ে ফ্ল্যাট ভাড়া সঞ্জীবায়

সিএমএম আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়ে বেরিয়ে আসছেন সেলেস্তি -যুগান্তর

ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য (এমপি) আনোয়ারুল আজিম আনার হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন সেলেস্তি রহমান। এতে তিনি বলেছেন, সঞ্জীবা গার্ডেনের সেই ট্রিপলেক্স ফ্ল্যাটটি শাহীন এবং তাকে স্বামী-স্ত্রী বানিয়ে ভাড়া নেওয়া হয়। এই পরিচয়েই তারা সেখানে ওঠেন। এমপি আনার সেই ফ্ল্যাটে ঢোকার পর সেলেস্তি তাকে অভ্যর্থনা জানিয়ে বলেন, ‘হ্যালো, হাউ আর ইউ।’ উত্তরে এমপি বলেন, ‘আই এম ফাইন।’ 

আনারকে অভ্যর্থনা দেওয়ার পর সেলেস্তি ফ্ল্যাট থেকে বের হয়ে যান, ফেরেন রাতে। দিনের বেলায় সেই ভবনে কে কে গেছেন তাদের নাম-ঠিকানা ও পরিচয় প্রকাশ করেন। মামলার ঘটনা সম্পর্কে নানা দিক তুলে ধরে বর্ণনা দেন। এ সময় তিনি নিজেকে নির্দোষ দাবি করেন। বলেন, হত্যার বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না। সোমবার ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে তার ১৬৪ ধারায় দেওয়া জবানবন্দি রেকর্ড করা হয়। এর আগে এই হত্যা মামলায় গ্রেফতার সেলেস্তি রহমান স্বেচ্ছায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে সম্মত হলে তাকে আদালতে হাজির করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা।

এদিকে এমপি আনার হত্যাকাণ্ডের অন্যতম আসামি নেপালে আটক সিয়াম হোসেনকে ডিবি পাচ্ছে না। নেপাল পুলিশ সিয়ামকে ডিবির কাছে হস্তান্তর করেনি। এমনকি সিয়ামের সঙ্গে কোনো কথা বলারও সুযোগ পায়নি ডিবির টিম। ফলে তাদের খালি হাতেই আজ মঙ্গলবার দেশে ফিরতে হচ্ছে। সিয়ামকে আটকের খবর পেয়ে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের একটি টিম শনিবার নেপালে গেছে। তাকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনতে নেপাল পুলিশের সঙ্গে দফায় দফায় দেনদরবারও করেছে ডিবির টিম।

নেপালে অবস্থানকারী ডিবি ওয়ারী বিভাগের অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার (এডিসি) মো. শাহিদুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, ‘সিয়ামকে আমরা পাচ্ছি না এটা নিশ্চিত। কাল (আজ মঙ্গলবার) দেশে ফিরছি আমরা।’ 
এদিকে ভারতের সিআইডিও সিয়ামকে আনতে নেপাল গেছে। এই আসামিকে তাদের কাছে হস্তান্তরের সম্ভাবনা আছে। সিয়াম আনার হত্যা মামলার গুরুত্বপূর্ণ আসামি। বিশেষ করে এমপির হাড় কলকাতার কৃষ্ণমাটি এলাকার জিরেনগাছি সেতুসংলগ্ন বাগজোড়া খালে ফেলার দায়িত্ব ছিল সিয়াম ও অপর আসামি জাহিদের। সেই হাড় এখনো উদ্ধার করতে পারেনি কলকাতার পুলিশ।

স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে সেলেস্তি রহমান বলেন, এমপির সঙ্গে সময় কাটানোর জন্য তাকে কলকাতায় আনা হয়েছিল। মাঝে মাঝে তাকে এ ধরনের কাজের জন্য বিভিন্ন স্থানে যেতে হয় বলে জানান। তিনি বলেন, এমপি আনারকে খুন করা হবে তা তিনি জানতেন না। তাকে কেউ এ বিষয়ে কিছু বলেনি। রাতে যখন ফ্ল্যাটে ফেরেন তখন প্রচুর ব্লিচিং পাউডারের গন্ধ পেয়েছেন তিনি। সেই সময় সেলেস্তি ফ্ল্যাটে থাকা অন্যদের জিজ্ঞেস করেছেন, ‘গেস্ট (এমপি আনার) কোথায়।’ 

তখন তারা তাকে (সেলেস্তি) বলেছে, ‘গেস্ট চলে গেছে।’ এরপর রাতে টয়লেটে প্রচুর পানি ফ্ল্যাশের শব্দ পেয়েছেন সেলেস্তি। এ সময় তিনি নিজেকে নির্দোষ দাবি করে বলেন, হত্যার বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না। তবে ফ্ল্যাটে থাকা অবস্থায় যতটুকু দেখেছেন তার সম্পূর্ণ চিত্র তুলে ধরেন আদালতের সামনে। জবানবন্দিতে সেলেস্তি উল্লেখ করেছেন, কীভাবে হত্যার মাস্টারমাইন্ড আক্তারুজ্জামান শাহীনের সঙ্গে তার পরিচয়। কেনই বা তিনি শাহীনের সঙ্গে কলকাতায় গেছেন। কীভাবে, কার সঙ্গে কলকাতা থেকে বাংলাদেশে এসেছেন। এ ছাড়া এমপি আনারকে কারা ওই ফ্ল্যাটে নিয়ে গেছে। ফ্ল্যাটটিতে ঘটনার আগে ও পরে কারা গিয়েছিল, সব তথ্যই উঠে এসেছে সেলেস্তির জবানবন্দিতে। 

জবানবন্দির বিষয়ে ডিবির তদন্তসংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেছেন, ‘সেলেস্তি জবানবন্দিতে নিজেকে নির্দোষ দাবি করেছেন। তিনি ডিবির কাছে যেসব তথ্য দিয়েছেন, আদালতে ১৬৪ ধারার জবানবন্দিতে একই কথা বলেছেন। তদন্তের জন্য এটাই যথেষ্ট। পারিপার্শ্বিক অবস্থা বলছে এখানে দেয়ার ইজ সামথিং, কিন্তু কী ঘটেছে তা তিনি জানেন না।’ ডিবির ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘সঞ্জীবার ওই ফ্ল্যাটে কিছু একটা ঘটেছে সেটা সেলেস্তির কথায় প্রমাণ হবে।’  

এদিকে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি রেকর্ডের আবেদনে বলা হয়, আনার হত্যায় ব্যবহৃত কলকাতার সঞ্জীবা গার্ডেনের ফ্ল্যাট ভাড়ার চুক্তি হয় আক্তারুজ্জামান শাহীন ও সেলেস্তি রহমানের নামে। ভুক্তভোগীকে হত্যার পরিকল্পনার অংশ হিসাবেই সেলেস্তি রহমান ভারতের কলকাতার নিউটাউন এলাকায় যান। আবেদনে আরও বলা হয়, সেলেস্তি এমপি আনার অপহরণের ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারী আক্তারুজ্জামান শাহীনের কথিত বান্ধবী। ভুক্তভোগী আনারকে হত্যা ও লাশ গুমের সমন্বয়ক শিমুল ভূঁইয়ার সঙ্গে সেলেস্তি গত ৩০ এপ্রিল কলকাতায় যান। পরে হত্যা ও লাশ গুমের পর সমন্বয়ক চরমপন্থি নেতা শিমুল ভূইয়ার সঙ্গে গত ১৫ মে বাংলাদেশে চলে আসেন।

এদিকে এমপি আনারকে খুনের উদ্দেশ্যে অপহরণের মামলার ১০ আসামির কার কটি ব্যাংক হিসাব আছে তার তথ্য চেয়েছে ডিবি। ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক মোহাম্মদ আসসামছ জগলুল হোসেনের আদালতে আনার হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবির সহকারী পুলিশ কমিশনার (এসি) মাহফুজুর রহমান এ আবেদন করেন। পরে আদালত আবেদনটি মঞ্জুর করেছেন। আসামিরা হলেন গ্রেফতার তিন আসামি শিমুল ভূঁইয়া, তানভীর ভূঁইয়া ও সেলেস্তি রহমান। এছাড়া তদন্তে প্রাপ্ত সন্দিগ্ধ পলাতক আসামিরা হলেন আক্তারুজ্জামান শাহীন, মো. সিয়াম হোসেন, ফয়সাল আলী, মোস্তাফিজুর রহমান, চেলসি চেরী, তাজ মোহাম্মদ খান হাজী এবং মো. জামাল হোসেন।

আদালতে দেওয়া আবেদনে বলা হয়, আসামিরা দীর্ঘদিন ধরে এমপি আনারকে হত্যার পরিকল্পনা করে আসছিল। তারা পরিকল্পনা করে আনারকে কীভাবে অপহরণ করবে ও টাকা-পয়সা আদায় করবে এবং টাকা-পয়সা নেওয়ার পর কীভাবে হত্যা তথা লাশ গুম করবে তার লোমহর্ষক বর্ণনা গ্রেফতারকৃত আসামিদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে এসেছে। এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত তিনজন আসামিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। 

হত্যায় জড়িত অন্য পলাতক আসামিদের নাম-ঠিকানা সংগ্রহ তথা মামলাটি সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে বর্তমানে পুলিশ রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ চলমান আছে। মামলার মূল রহস্য উদঘাটন ও মামলার সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে গ্রেফতার ৩ আসামি ও তদন্তে সন্দিগ্ধ ৭ আসামির এনআইডি ও পাসপোর্ট নম্বরের বিপরীতে কোন ব্যাংকে কটা অ্যাকাউন্ট আছে, তার তথ্য সরবরাহ করার জন্য বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের হেড অব বাংলাদেশের (এফআইইউ) কাছে আদেশ পাঠানো প্রয়োজন।

ডিবির তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, নেপালে আটক সিয়ামের বাড়ি ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলায়। তিনি এমপি আনার হত্যার মাস্টারমাইন্ড আক্তারুজ্জামান শাহীনের সহকারী হিসাবে কাজ করতেন। ভারতের নিউটাউনের সঞ্জীবা গার্ডেনের ফ্ল্যাটে আনার হত্যাকাণ্ডের পর অন্য আসামিরা বাংলাদেশে ফিরলেও সিয়াম চলে যান নেপালে। গত বৃহস্পতিবার তাকে আটক করে নেপাল পুলিশ। তার কাছে হত্যাকাণ্ডের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আছে বলে ধারণা ডিবির। শনিবার ডিবির তিন সদস্যের একটি টিম নেপাল গেছে। এর আগে সিয়ামকে দেশে ফিরিয়ে আনতে বাংলাদেশ দূতাবাসের পক্ষ থেকেও কূটনৈতিক যোগাযোগ করা হয়। 

আনারের মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন ও ব্যক্তিগত সহকারী আব্দুর রউফ ভারতের ভিসা পেয়েছেন। সোমবার বিকালে তারা ভিসা পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন এমপি আনারের ব্যক্তিগত সহকারী আব্দুর রউফ। তিনি যুগান্তরকে বলেন, ‘ভিসা পেলেও ভারতে যাওয়ার বিষয়টি নির্ভর করছে ডিবি পুলিশের ওপর। ডিবির টিমের সঙ্গে আমরা ভারত যাব। ডিবির টিম নেপাল থেকে এলে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে।’ 

উল্লেখ্য, গত ১২ মে ভারতে যান এমপি আনার। কলকাতার ব্যারাকপুরসংলগ্ন মণ্ডলপাড়ায় বন্ধু গোপাল বিশ্বাসের বাড়িতে ওঠেন তিনি। ১৩ মে চিকিৎসার কথা বলে বাসা থেকে বের হন। পরে কলকাতার দমদম বিমানবন্দর লাগোয়া নিউটাউন এলাকার সঞ্জীবা গার্ডেনের একটি ফ্ল্যাটে খুন হন তিনি। এমপি আনার হত্যাকাণ্ডে এখন পর্যন্ত তিনজনকে গ্রেফতার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। তারা হলেন চরমপন্থি নেতা শিমুল ভূঁইয়া ওরফে আমানুল্লাহ, তার চাচাতো ভাই তানভীর ভূঁইয়া ও শাহীনের গার্লফ্রেন্ড সেলেস্তি রহমান। 

এছাড়া কলকাতা পুলিশের কাছে গ্রেফতার আরেক আসামি জিহাদ হাওলাদার ওরফে কসাই জিহাদকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে ভারতের পুলিশ। আরেক আসামি সিয়াম নেপালে পুলিশের কাছে আটক হয়েছে। এছাড়া শাহীন যুক্তরাষ্ট্রে এবং মোস্তাফিজ ও ফয়সাল বাংলাদেশেই রয়েছে বলে ডিবি মনে করছে। 

চরমপন্থি নেতা শিমুলের সহযোগী একদিনের রিমান্ডে : এমপি আনার হত্যা মামলায় গ্রেফতার শিমুল ভূঁইয়ার সেকেন্ড ইন কমান্ডার সাইফুল আলম মেম্বারের একদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। সোমবার বিকাল ৩টার দিকে বিস্ফোরক মামলায় শুনানি শেষে যশোর সদর আমলি আদালত ওই রিমান্ড মঞ্জুর করেন। 

এমপি আনার হত্যায় আরও ৩ জনের সম্পৃক্ততার তথ্য পেয়েছে ডিবি : এমপি আনার হত্যায় আরও ৩ জনের সম্পৃক্ততার তথ্য পেয়েছে ডিবি পুলিশ। তারা হলো তাজ মোহাম্মদ খান ওরফে হাজী, মো. জামাল হোসেন ও চেলসি চেরি ওরফে আরিয়া। সোমবার মামলার তদন্ত কর্মকর্তা যে ১০ আসামির ব্যাংক হিসাবের তথ্য পেতে আদালতে আবেদন করেন, ওই তিনজনের নাম সেখানে রয়েছে। যদিও এর আগে তাদের নাম আলোচনায় ছিল না। 

ডিবির তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, তাজ মোহাম্মদ খান ওরফে হাজী ও জামাল হোসেনের বাড়ি ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুরে। আনার হত্যার মাস্টারমাইন্ড হিসাবে চিহ্নিত আক্তারুজ্জামান ওরফে শাহীনের বাড়িও একই এলাকায়। এ দুজন শাহীনের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসাবে এলাকায় পরিচিত। আরিয়াকে শাহীনের বান্ধবী হিসাবে চেনে সবাই। আনারকে ১৩ মে হত্যার আগে প্রথম দফায় হত্যাচেষ্টায় কলকাতায় এই আরিয়াকে নিয়ে গিয়েছিলেন শাহীন। ডিবি জানায়, তাজ ও জামালের সঙ্গে এমপি আনার খুনের মাস্টারমাইন্ড আক্তারুজ্জামান শাহীনের যোগাযোগ ছিল। জামাল শাহীনের সমবয়সি হলেও তাজের বয়স বেশি।
 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম