জাতিসংঘ বিশেষজ্ঞদের চিঠির জবাব
রিক্রুটিং এজেন্টদের অনিয়ম বন্ধে কাজ করছে বাংলাদেশ
মালয়েশিয়ায় কর্মী প্রেরণ নিয়ে সংকট সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা -প্রতিমন্ত্রী শফিকুর রহমান চৌধুরী * আটকে পড়া কর্মীদের কোনো সুরাহা হয়নি
মাসুদ করিম
প্রকাশ: ০২ জুন ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
রিক্রুটিং এজেন্টদের একটি সিন্ডিকেটের অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে মালয়েশিয়ায় অভিবাসনপ্রত্যাশী কর্মীদের অধিক অর্থ দিতে হয় বলে জাতিসংঘ বিশেষজ্ঞদের অভিযোগের জবাব দিয়েছে বাংলাদেশ।
অভিবাসনে নানা অনিয়মের অভিযোগ তুলে মালয়েশিয়া ও বাংলাদেশ সরকারের কাছে চিঠি দিয়েছিলেন জাতিসংঘের চার স্বাধীন বিশেষজ্ঞ। চিঠির জবাবে বলা হয়েছে, রিক্রুটিং এজেন্টদের অনিয়ম বন্ধে কাজ করছে বাংলাদেশ।
এদিকে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী শফিকুর রহমান চৌধুরী বলেছেন, মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর ক্ষেত্রে যারা জটিলতা তৈরি করেছেন, তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তদন্তে যারা দোষী সাব্যস্ত হবেন, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
অপরদিকে ভিসা পাওয়ার পরও ফ্লাইট না পাওয়ায় মালয়েশিয়ার নির্ধারিত সময়সীমা ৩১ মের মধ্যেও যেতে না পারা কর্মীদের ব্যাপারে কোনো সুরাহা হয়নি। তারা অন্তহীন দুর্ভোগে পড়েছেন।
কুয়ালালামপুরে বাংলাদেশ হাইকমিশনের কর্মকর্তারা বলছেন, তারা মালয়েশিয়ার সরকারের কাছে এই কর্মীদের গ্রহণের অনুরোধ করেছেন। তিন মাসের মধ্যে আটকে পড়া কর্মীদের পাঠানোর ব্যাপারে মালয়েশিয়ার সরকারের সম্মতি আদায় করতে পারবেন বলে তারা আশা করছেন।
মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার বারবার বন্ধ হওয়ার নেপথ্যে শক্তিশালী সিন্ডিকেটকেই দায়ী করা হচ্ছে। সিন্ডিকেটের নেটওয়ার্ক উভয় দেশে বিস্তৃত।
অভিযোগ উঠেছে, সিন্ডিকেটের সঙ্গে ঢাকা ও কুয়ালালামপুরে সরকারের প্রভাবশালী মহলের যোগসাজশ রয়েছে। সংঘবদ্ধ চক্রটি বিপুলসংখ্যক কর্মীকে প্রলোভন দেখিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটে নিয়েছে। একবার-দুবার নয়, বারবার। সিন্ডিকেট এতটাই শক্তিশালী যে, তাদের বাইরে সরকারি পর্যায়ে (জি টু জি) চুক্তি করেও প্রত্যাশিত সংখ্যক কর্মী পাঠাতে পারেনি বাংলাদেশ।
সিন্ডিকেটের সঙ্গে অনেকটা আপসরফা করে ‘জি টু জি প্লাস’ চুক্তি করে অধিক কর্মী পাঠাতে হয়েছে। বেশি কর্মী গেলেও অনেক ক্ষেত্রে ভুয়া কোম্পানির নামে চাহিদাপত্র বানিয়ে কর্মীদের কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নেয় চক্রটি।
মালয়েশিয়ায় অভিবাসন প্রক্রিয়ায় ব্যাপক ঘুস, দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ জাতিসংঘ পর্যন্ত চলে গেছে। জাতিসংঘের চারজন স্বাধীন বিশেষজ্ঞ প্রকাশ্যে বলে দিয়েছেন, মালয়েশিয়ার সরকারের স্বরাষ্ট্র ও মানবসম্পদ মন্ত্রণালয়ে ঘুস না দিয়ে কর্মী অভিবাসন করা যায় না।
কার্যত সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ঘুসের অর্থ উচ্চপর্যায়ে যায় বলেও অভিযোগ রয়েছে। দুই দেশের সিন্ডিকেটে বাংলাদেশের সরকারের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা জড়িত বলেও অভিযোগ রয়েছে। মন্ত্রী, এমপি কিংবা আমলারা স্বনামে কিংবা বেনামে রিক্রুটিং এজেন্সির লাইসেন্স নিয়ে কুয়ালালামপুরের সিন্ডিকেটের সঙ্গে যোগসাজশের মাধ্যমে কর্মীদের কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে বলে অভিযোগ আছে।
সৌদি আরবের পর বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শ্রমবাজার হিসাবে পরিচিত মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারটি অভিবাসন প্রক্রিয়ায় অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগে ২০০৮ সালে একবার বন্ধ হয়েছিল। দুই দেশের সরকারের মধ্যে দীর্ঘ আলোচনার পর ২০১২ সালে একটি সমঝোতা স্মারক সই হয়।
এ স্মারকের আওতায় সরকারি পর্যায়ে (জি টু জি) কর্মী পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়। প্রথম দফায় ৩০ হাজার কর্মী পাঠানোর জন্য মালয়েশিয়া সরকার চাহিদাপত্র দেয়। ওই সময় ১৪ লাখ কর্মী বিএমএটিতে বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে নিবন্ধন করেন। নিয়োগকর্তারা কর্মী নেবেন বলে স্মারকে উল্লেখ ছিল।
কিন্তু ২০১২ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত চার বছরে মাত্র আট হাজার কর্মী মালয়েশিয়ায় যান। ২০১৬ সালে জি টু জি প্লাস চুক্তি সই হলে রিক্রুটিং এজেন্টদের সিন্ডিকেট যোগ দেয়। ২০১৭-১৮ সালে ২ লাখ ৭৮ হাজার কর্মী মালয়েশিয়ায় যান। কিন্তু তাদের অনেকেই চাকরি পাননি। অতিরিক্ত অভিবাসন ব্যয় এবং দুর্নীতির কারণে ২০১৯ সালে আবার কর্মী নেওয়া বন্ধ করে মালয়েশিয়া। ২০২১ সালের ১৯ ডিসেম্বর পুনরায় বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিয়োগের সমঝোতা স্মারক সই করে মালয়েশিয়া।
বাংলাদেশের ১৩শ রিক্রুটিং এজেন্সির মধ্যে সিন্ডিকেটভুক্ত ২৫টি রিক্রুটিং এজেন্সিকে মালয়েশিয়া কর্মী পাঠানোর অনুমতি দেয়। কর্মী নিয়োগে আবার সেই অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় ৩১ মে থেকে মালয়েশিয়া বিদেশি কর্মী নিয়োগ বন্ধ করে।
জাতিসংঘের চার স্বাধীন বিশেষজ্ঞ ২৮ মার্চ বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার সরকারের কাছে চিঠি দিয়েছেন। ৬০ দিনেও দুই দেশের সরকার চিঠির জবাব না দেওয়ায় জাতিসংঘের মানবাধিকার সংক্রান্ত সংস্থা চিঠিটি প্রকাশ করে দেয়। চিঠিতে বলা হয়, অভিবাসন প্রক্রিয়া শুরুই হয় মালয়েশিয়ার মানবসম্পদ ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ঘুস দেওয়ার মাধ্যমে। ঘুস দিয়ে ভুয়া নিয়োগকর্তারা চাহিদাপত্রের অনুমোদন নেয়। বাংলাদেশের রিক্রুটিং এজেন্টদের সিন্ডিকেটের কাছেও ঘুস দিতে হয়। হাইকমিশনের কর্মকর্তাদেরও ঘুস দিতে হয়। এভাবে বিমান টিকিট, পাসপোর্ট ও ভিসার খরচের বেশি অর্থ গুনতে হয় কর্মীদের। চিঠিতে বলা হয়, উভয় দেশের সরকার অভিবাসন ব্যয় ৭২০ ডলার নির্ধারণ করে দিলেও কর্মীদের কাছ থেকে চার থেকে ছয় হাজার ডলার নিয়ে থাকেন। বিষয়টি জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলে আলোচনা হবে বলেও উল্লেখ করা হয়। যে চারজন স্বাধীন বিশেষজ্ঞ চিঠি দিয়েছেন, তারা হলেন-টেমোয়া ওবোকাটা, রবার্ট ম্যাককরডালে, গেহাদ মার্দি ও সিওবান মুল্লালি। স্বাধীন বিশেষজ্ঞদের চিঠি প্রকাশ হওয়ার পর মালয়েশিয়া জেনেভায় জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনে জবাব জমা দিয়েছে।
শনিবার জেনেভায় বাংলাদেশের স্থায়ী মিশনের কর্মকর্তা সঞ্চিতা হক টেলিফোনে যুগান্তরকে বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশের পক্ষ থেকে জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনে জবাব দিয়েছি। জবাবে আমরা বলেছি, বাংলাদেশ সরকার রিক্রুটিং এজেন্সির অনিয়মের বিরুদ্ধে মালয়েশিয়ার সরকারের সঙ্গে কাজ করছে।’ জবাবটি জাতিসংঘ মানবাধিকার হাইকমিশনের তরফে প্রকাশ করা হবে বলেও তিনি জানান।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, দাতু আমিন নামের বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত একজন মালয়েশিয়ার নাগরিক দেশটির সরকারের উচ্চপর্যায়ে যুক্ত। তিনি ঢাকায় রিক্রুটিং এজেন্সির সিন্ডিকেট এবং মালয়েশিয়ার সরকারের উচ্চপর্যায়ের সঙ্গে সেতুবন্ধ হিসাবে কাজ করেন। চিহ্নিত সিন্ডিকেট বিপুল অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নিলেও এখনো তারা প্রকাশ্যে নানা বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন। তারা খুবই প্রভাবশালী হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে এখনো কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। সিন্ডিকেটের সঙ্গে মালয়েশিয়ার হাইকমিশন ঘিরে গড়ে ওঠা চক্রও নানা অনিয়মে জড়িত হয়ে পড়েছে।
বাংলাদেশে নিযুক্ত মালয়েশিয়ার হাইকমিশনার হাজনাহ মো. হাশিম সম্প্রতি সাংবাদিকদের বলেছেন, সিন্ডিকেট মালয়েশিয়া ও বাংলাদেশ সরকারের ধরাছোঁয়ার বাইরে। অভিবাসন প্রক্রিয়ায় অনিয়ম দূর করার লক্ষ্যে কর্মী নিয়োগ বন্ধ করা হয়েছে। চলতি বছরের শেষ নাগাদ নির্ধারিত জরিমানা দিয়ে অবৈধ বিদেশি কর্মীরা মালয়েশিয়া ত্যাগ করতে পারবেন। তারপর চাহিদার বিপরীতে বাংলাদেশসহ ১৫টি সোর্স কান্ট্রি থেকে কর্মী নেবে মালয়েশিয়া। এতে বাংলাদেশের কর্মীরা মালয়েশিয়ায় গিয়ে চাকরির গ্যারান্টি পাবে বলেও তিনি আশ্বস্ত করেন।
আটকে পড়া কর্মীদের মালয়েশিয়ায় পাঠানোর ব্যাপারে সমন্বয়হীনতা প্রবল। সিন্ডিকেটভুক্ত রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো দায় নিচ্ছে না। তারা বলছে, কর্মীরা বেশি টাকা ভাড়া দিয়ে মালয়েশিয়া যেতে চাইছেন না। আটকে পড়া কর্মীরা বলছেন তারা সর্বস্ব হারিয়েও মালয়েশিয়া যেতে পারেননি। কারণ, রিক্রুটিং এজেন্সি নির্ধারিত সময়ে তাদের হাতে টিকিট দেননি।
এদিকে বেসামরিক বিমান ও পর্যটনমন্ত্রী মুহাম্মদ ফারুক খান বলেছেন, মালয়েশিয়ার সরকার ৩১ মে কর্মী নেওয়া বন্ধ করে দেওয়ার কথা এক মাস আগে বাংলাদেশকে জানালেও বিষয়টি তাদের কাছে গোপন রাখা হয়েছিল। তিনদিন আগে তাদের জানালে বিমান ভাড়া এবং দ্রুত অনুমোদন দিয়ে যতটা সম্ভব কর্মীদের পাঠানো হয়েছে। বিমান বর্তমানে হজ ফ্লাইট পরিচালনা করছে। এ সময়ে হঠাৎ করে জানালে বিপুলসংখ্যক কর্মী পাঠানো সম্ভব নয়। আগে জানালে কর্মীদের বিমান ভাড়াও কম হতো বলে মন্ত্রী জানান।