তিন ধাপের উপজেলা নির্বাচন
মন্ত্রী-এমপিদের ১৮ স্বজনের পরাজয়
জয়ী হয়েছেন অন্তত ৩৩ জন * স্বজনের ভরাডুবিতে ইমেজ ও জনপ্রিয়তা নিয়ে নানা আলোচনা
কাজী জেবেল
প্রকাশ: ০১ জুন ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
তিন ধাপের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে মন্ত্রী-এমপিদের অন্তত ১৮ আত্মীয়স্বজন চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে হেরে গেছেন। তবে জয়ী হয়েছেন ৩৩ জন স্বজন। পরাজয়ের তালিকায় রয়েছেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের ছোট ভাই, সাবেক কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাকের খালাতো ও মামাতো ভাই, সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের ছোট ভাই, জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার শামসুল হক টুকুর ছোট ভাই ও ভাতিজা, সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. জাহিদ মালেকের ফুফাতো ভাই এবং মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সাবেক প্রতিমন্ত্রী এবি তাজুল ইসলামের ভাতিজা।
নির্বাচনে তাদের অনেকেই স্বজনদের পক্ষে ছিলেন। আবার কেউ কেউ স্বজনদের ঘোরতর বিরোধিতা করেন। তবে পক্ষ-বিপক্ষে যে অবস্থানই নেন না কেন, নির্বাচনে স্বজনদের ভরাডুবিতে এসব মন্ত্রী-এমপিদের ইমেজ ও জনপ্রিয়তা নিয়ে চলছে নানা আলোচনা। স্থানীয় পর্যায় থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
২৯ মে পর্যন্ত তিন ধাপে ৩৭৬টি উপজেলায় ভোটগ্রহণ হয়। ৫ জুন চতুর্থ ধাপে অর্ধশতাধিক উপজেলায় ভোটগ্রহণ হবে। এর মধ্য দিয়ে মূলত চার ধাপের ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচন শেষ হচ্ছে। যদিও ঘূর্ণিঝড় রিমালের কারণে স্থগিত হওয়া ২০ উপজেলায় ৯ জুন ভোটগ্রহণ হবে।
আইন অনুযায়ী উপজেলা পরিষদ নির্বাচন দলীয় প্রতীকে হওয়ার কথা। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা বাড়াতে এবার দলীয় প্রার্থী মনোনয়ন দেয়নি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। একইসঙ্গে মন্ত্রী ও দলীয় এমপির স্বজনদের নির্বাচনে অংশগ্রহণকে নিরুৎসাহিত করা হয়। তবুও তিন ধাপে মন্ত্রী-এমপিদের অর্ধশতাধিক স্বজন ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। এরমধ্যে প্রথম ধাপে মন্ত্রী-এমপিদের ১০ জন স্বজন জয়ী হয়েছেন। আর হেরেছেন ৬ জন। দ্বিতীয় ধাপে জয়ী হয়েছেন ১৩ জন এবং হেরেছেন ৬ জন।
সর্বশেষ তৃতীয় ধাপে জয়ী হয়েছেন ১০ জন, হেরেছেন ৬ জন আত্মীয়।
২৯ মে অনুষ্ঠিত নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের ছোট ভাই শাহাদাত হোসেন বিপুল ভোটের ব্যবধানে হেরে যান। এ নির্বাচনে চারজন প্রার্থীর মধ্যে তিনি টেলিফোন প্রতীকে ৪ হাজার ৬১০ ভোট পেয়ে তৃতীয় হন। এমনকি তার জামানতও বাজেয়াপ্ত হয়েছে। শাহাদাত হোসেন হেরে যাওয়ায় স্থানীয় রাজনীতিতে বেশ আলোচনা-সমালোচনা চলছে। নির্বাচনে পরাজয়ের জন্য শাহাদাত হোসেন তার ভাই বসুরহাট পৌরসভার মেয়র কাদের মির্জা ও প্রশাসনকে দায়ী করেন। তিনি যুগান্তরের কাছে তার প্রতিক্রিয়ায় নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ তুলে ধরেন।
এর আগে ২১ মে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় ধাপে কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে বিপুল ভোটের ব্যবধানে হেরেছেন সাবেক অর্থমন্ত্রী এবং কুমিল্লা-১০ আসনের সংসদ-সদস্য আ হ ম মুস্তফা কামালের ছোট ভাই গোলাম সারওয়ার। টানা তিনবারের উপজেলা চেয়ারম্যান প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা গোলাম সারওয়ার এবার তৃতীয় স্থান অর্জন করেছেন। ওই উপজেলায় বিজয়ী হয়েছেন সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান এবং মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবদুল হাই বাবলু। সারওয়ারের এ পরাজয় পুরো কুমিল্লা জেলায় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসে। আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাকর্মীদের বক্তব্য, মন্ত্রীর ভাই হিসাবে সারওয়ার ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করতেন।
এছাড়া নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাবলুকে সমর্থন দেন কুমিল্লা সদর আসনের এমপি আ ক ম বাহাউদ্দিন। এ নির্বাচনে পরাজয়ের বিষয়ে সরাসরি কিছু বলতে রাজি হননি গোলাম সারওয়ার। তিনি বলেন, নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে। এ ফলাফল আমার কপালে ছিল, এ নিয়ে আর কথা বলতে চাই না। গত ১৫ বছরে আমি এমন কোনো দুর্নীতি করিনি যাতে জনপ্রতিনিধি ও ভোটাররা আমার বিপক্ষে যাবেন। অপরদিকে বিজয়ী বাবলু বলেন, সারওয়ার অনিয়ম-দুর্নীতিতে ডুবে ছিলেন। তাই ব্যালটে জবাব দিয়েছে জনগণ।
তৃতীয় ধাপে অনুষ্ঠিত মানিকগঞ্জ সদর উপজেলা নির্বাচনে হেরে গেছেন সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী মানিকগঞ্জ-৩ আসনের সংসদ-সদস্য ডা. জাহিদ মালেকের ফুফাতো ভাই মো. ইসরাফিল হোসেন। এ নির্বাচনে তাকে সমর্থন দেন জাহিদ মালেক। ২০১৯ সালে মো. ইসরাফিল হোসেন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন। এবার তিনি হেরে গেছেন। উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন সুদেব কুমার সাহা। একইভাবে সাটুরিয়া উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ডা. জাহিদ মালেকের পছন্দের প্রার্থী গোলাম হোসেনও হেরে গেছেন। এ বিষয়ে বারবার যোগাযোগ করেও ডা. জাহিদ মালেকের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুর উপজেলা নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে হেরে গেছেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সাবেক প্রতিমন্ত্রী ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৬ আসনের সংসদ-সদস্য এবি তাজুল ইসলামের ভাতিজা মোহাম্মদ আমিনুল ইসলাম তুষার। কক্সবাজার-৩ আসনের তিনবারের সংসদ-সদস্য সাইমুম সরওয়ার কমলের বড় ভাই সোহেল সরওয়ার কাজল রামু উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে হেরে গেছেন। যদিও এবি তাজুল ইসলাম ও সাইমুম সরওয়ার কমল নির্বাচনে তাদের স্বজনদের প্রকাশ্যে বিরোধিতা করেন।
বরগুনা-২ আসনের সংসদ-সদস্য সুলতানা নাদিরার চাচাতো ভাসুরের স্ত্রী নুর আফরোজ হ্যাপিও পাথরঘাটা উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে ভোট করে হেরে গেছেন। এ নির্বাচনে সুলতানা নাদিরার মেয়েরা নবনির্বাচিত উপজেলা চেয়ারম্যান মোস্তফা গোলাম কবিরের পক্ষে কাজ করেন। বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে বগুড়া-২ আসনের সংসদ-সদস্য শরীফুল ইসলাম জিন্নাহর শ্যালক ফিরোজ আহম্মেদ রিজু শিবগঞ্জ উপজেলায় এবং ময়মনসিংহের সাবেক এমপি অ্যাডভোকেট মোসলেম উদ্দিনের মেয়ে সেলিমা বেগম সালমা ফুলবাড়িয়া উপজেলা নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে পরাজিত হন।
দ্বিতীয় ধাপের উপজেলা নির্বাচনে লালমনিরহাট-২ আসনের সংসদ-সদস্য নুরুজ্জামান আহমেদের ছোট ভাই মাহবুজ্জামান আহমেদ ওই জেলার কালীগঞ্জ উপজেলায়, শরীয়তপুর-১ আসনের সংসদ-সদস্য ইকবাল হোসেন অপুর চাচাতো ভাই বিল্লাল হোসেন দিপু মিয়া শরীয়তপুর সদর উপজেলায়, হবিগঞ্জ-৩ আসনের সংসদ-সদস্য মো. আবু জাহিরের সম্বন্ধি (স্ত্রীর বড় ভাই) মো. আক্তারুজ্জামান বাহুবল উপজেলায় ও সদর উপজেলায় তার ভাতিজা ওয়াসিম উদ্দিন খান চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে হেরে গেছেন।
হবিগঞ্জ-১ আসনের সংসদ-সদস্য আমাতুল কিবরিয়া চৌধুরী কেয়ার বড় ভাই জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক রাজন চৌধুরী বাহুবল উপজেলা নির্বাচনে চেয়ারম্যান নির্বাচন হেরে গেছেন।
প্রথম ধাপে টাঙ্গাইলের ধনবাড়ী উপজেলা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে হেরে গেছেন সাবেক কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাকের খালাতো ভাই মো. হারুনার রশীদ ও মামাতো ভাই খন্দকার মনজুরুল ইসলাম (তপন)। এ নির্বাচনে মো. হারুনার রশীদকে সমর্থন দেন ড. আব্দুর রাজ্জাক। এ উপজেলায় মো. আব্দুল ওয়াদুদ তালুকদার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন।
জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার অ্যাডভোকেট শামসুল হক টুকুর ছোট ভাই মো. আব্দুল বাতেন এবং ভাতিজা আবদুল কাদের পাবনার বেড়া উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন।
তারা দুজনই নির্বাচনে পরাজিত হয়েছেন। ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গী উপজেলায় নির্বাচনে হেরে গেছেন স্থানীয় সংসদ-সদস্য মো. মাজহারুল ইসলামের চাচাতো ভাই আলী আফসার। আর মাদারীপুরে সাবেক নৌমন্ত্রী শাজাহান খানের চাচাতো ভাই পাভেলুর রহমান হেরেছেন তার ভাতিজা আসিবুর রহমানের কাছে। শাজাহান খান এ নির্বাচনে তার ছেলে আসিবুর রহমানের পক্ষে ছিলেন।