নিটল ইন্স্যুরেন্সের শেয়ারে কারসাজি
মুনাফা সাড়ে ১৬ কোটি জরিমানা ৮০ লাখ টাকা
মনির হোসেন
প্রকাশ: ২০ মে ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
শেয়ারবাজারে নিটল ইন্স্যুরেন্সের শেয়ারে বড় কারসাজির ঘটনা ঘটেছে। এর সঙ্গে জড়িত বাজারে পরিচিত গ্যাম্বলার (কারসাজিকারক) আবুল খায়ের হিরুচক্র। এখানেও কারসাজির মাধ্যমে রিয়ালাইজড (শেয়ার বিক্রি হয়েছে) এবং আনরিয়ালাইজড (শেয়ার বিক্রি হয়নি) মিলে ১৬ কোটি ৫১ লাখ টাকা মুনাফা হয়েছে। কিন্তু চারজনকে ২০ লাখ টাকা করে ৮০ লাখ টাকা জরিমানা করেছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। এর মানে হলো ৮০ লাখ টাকা দিলেই তাদের ১৬ কোটি ৫১ লাখ টাকা বৈধ হয়ে যাবে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এ সিদ্ধান্ত সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য সহায়ক নয়।
জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, বাজারের মূল সমস্যা বিনিয়োগকারীদের আস্থাসংকট। এ সংকট কাটাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা জরুরি। এক্ষেত্রে কারসাজির সঙ্গে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। না হলে তা সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য সহায়ক হবে না। ২০১৯ সালে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয় বিমা খাতের কোম্পানি নিটল ইন্স্যুরেন্স। ২০২০ সালের ১৫ জুলাই থেকে ১১ নভেম্বর পর্যন্ত চার মাসে প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারের দাম ১৭৬ শতাংশ বেড়েছে। ২০২১ সালের ১৭ জানুয়ারি বিএসইসিতে এ ব্যাপারে একটি প্রতিবেদন পাঠায় ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই)। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, একটি চক্র মিলে কৃত্রিমভাবে এ কোম্পানির শেয়ারের দাম বাড়িয়েছে। দাম বৃদ্ধির সঙ্গে কোম্পানির মৌলভিত্তি সংগতিপূর্ণ নয়। দাম বাড়িয়েছে একেএম মনিরুল হক, সালওয়া তাবাসসুম হক, ওয়াসফিয়া তাবাসসুম হক এবং তাদের প্রতিষ্ঠান উখতান এন্টারপ্রাইজ। তবে তাদের নাম সামনে এলেও এর নেপথ্যে আলোচিত গ্যাম্বলার আবুল খায়ের হিরু ও তার সিন্ডিকেট।
আলোচ্য সময়ে প্রতিষ্ঠানটির সবচেয়ে বেশি শেয়ার কিনেছে হিরুর মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান ডিআইটি কো-অপারেটিভ লিমিটেড। এছাড়াও রয়েছে একই সিন্ডিকেটের সদস্য প্যারামাউন্ট টেক্সটাইল, এসবিএল ক্যাপিটাল, কারিব ট্রেডার্স, শিক্ষিত বেকার কেন্দ্রীয় সংঘ, মো. জসিম উদ্দিন, প্রিমিয়ার ব্যাংক ক্যাপিটাল, প্যারামাউন্ট ইন্স্যুরেন্স, একেএম মনিরুল হক, সিরাজুল ইসলাম, হোসাম মো. সিরাজ, মরিয়ম নেসা ও উখতান এন্টারপ্রাইজ। বেশি শেয়ার বিক্রির তালিকায় রয়েছে ডিআইটি কো-অপারেটিভ, প্যারামাউন্ট টেক্সটাইল, কারিব ট্রেডার্স, শিক্ষিত বেকার কেন্দ্রীয় সংঘ, মো. জসিম উদ্দিন, প্রিমিয়ার ব্যাংক ক্যাপিটাল, আইসিবি ইউনিট ফান্ড, আইসিবি, ওয়াসফিয়া তাবাসসুম হক, মাহমুদুল হক শামীম, সালওয়া তাবাসসুম হক, প্যারামাউন্ট ইন্স্যুরেন্স ও সিরাজুল ইসলাম।
জানতে চাইলে আবুল খায়ের হিরু রোববার যুগান্তরকে বলেন, এ জরিমানার ব্যাপারে আমি এখনো জানি না। জানার পর মন্তব্য করা যাবে। তবে তিনি বলেন, শেয়ারের দাম বাড়লেই যদি জরিমানা করা হয়, তাহলে বাজার থাকবে না।
আলোচ্য সময়ে চক্রটি বাজার থেকে নিটল ইন্স্যুরেন্সের ১৪ লাখ ৭০ হাজার ৬৬৪টি শেয়ার কেনে। বিক্রি করেছে ১৫ লাখ ৯১ হাজার ৯২৬টি শেয়ার। এক্ষেত্রে কেনার চেয়ে বিক্রির পরিমাণ ১ লাখ ২১ হাজার ২৬২টি বেশি। তবে এ শেয়ার আগে কেনা ছিল। আলোচ্য সময়ে শেয়ারটির সর্বশেষ দাম ছিল ৬০ টাকা ২০ পয়সা। এ লেনদেনের মাধ্যমে চক্রটি প্রতিটি শেয়ারে ১৫ টাকা ৩৬ পয়সা মুনাফা করেছে। শতকরা হিসাবে যা ৬৫ দশমিক ৬৯ শতাংশ। এর মাধ্যমে রিয়ালাইজড মুনাফা ২ কোটি ৪৪ লাখ ৫২ হাজার টাকা। এছাড়াও আনরিয়ালাইজড মুনাফা ১৪ কোটি ৭ লাখ টাকা। অর্থাৎ চক্রটির মোট মুনাফা ১৬ কোটি ৫১ লাখ টাকা। এ ঘটনায় চক্রটি ৮০ লাখ টাকা জরিমানা করেছে বিএসইসি। এর মধ্যে একেএম মনিরুল হক ২০ লাখ টাকা, সালওয়া তাবাসসুম হক ২০ লাখ, ওয়াসফিয়া তাবাসসুম হক ২০ লাখ এবং তাদের প্রতিষ্ঠান উখতান এন্টারপ্রাইজকে ২০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়।
তবে বিএসইসি বলছে, তারা যৌক্তিকভাবেই জরিমানা করে। জানতে চাইলে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম যুগান্তরকে বলেন, কোনো কোম্পানির শেয়ারের তদন্তের ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট সময় ধরে স্টক এক্সচেঞ্জ থেকে রিপোর্ট পাঠানো হয়। এরপর কমিশন অভিযুক্তসহ সংশ্লিষ্টদের শুনানিতে ডাকে। কিন্তু শুনানির সময় দেখা যায়, আনরিয়ালাইজড মুনাফা কমে যায়। কখনো আবার লোকসানে চলে যায়। ফলে কমিশন সামগ্রিক বিষয় বিবেচনা করে একটি যৌক্তিক জরিমানা করে। তিনি বলেন, এ ধরনের জরিমানা বাজারে সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং লেনদেনে স্বচ্ছতা আনতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
ডিএসইর অনুসন্ধানে এই শেয়ার কারসাজি নিয়ে বেশকিছু তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। এক্ষেত্রে অস্বাভাবিক শেয়ার লেনদেনকে আইন লঙ্ঘন এবং অপরাধ হিসাবে দেখানো হয়েছে। অপরাধের তালিকায় ১৫টি বিও অ্যাকাউন্ট চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে ৫টি ব্রোকারেজ হাউজ রয়েছে। ইউসিবি স্টক ব্রোকারেজ, এমিনেন্ট সিকিউরিটিজ, এসবিএল ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট, প্যারামাউন্ট সিকিউরিটিজ, কমার্স ব্যাংক সিকিউরিটিজ, আইসিবি সিকিউরিটিজ, ইউনাইটেড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস, ব্র্যাক ইপিএল, প্রিমিয়ার ব্যাংক সিকিউরিটিজ, কাইয়ুম সিকিউরিটিজ এবং আইডিএলসি সিকিউরিটিজ। এর মধ্যে একটি হাউজ থেকে শেয়ার ক্রয়ের আদেশ দিয়ে অন্য হাউজ থেকে বিক্রি করেছে। এভাবেই কৃত্রিমভাবে লেনদেন করে শেয়ারের দাম বাড়িয়েছে। এরপর সাধারণ বিনিয়োগকারী এখানে যুক্ত হলে শেয়ার বিক্রি করে বেড় হয়ে গেছে। এ কাজের মাধ্যমে চক্রটি সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ অর্ডিন্যান্স ১৯৬৯ সালের সেকশন ১৭ই লঙ্ঘন করেছে। এর ফলে ওই অধ্যাদেশের ২২ ধারায় তাদের অর্থ জরিমানা করেছে কমিশন। অর্থাৎ, গুরুপাপে লঘুদণ্ড।