Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

ভেস্তে যাচ্ছে ইনস্টিটিউশনাল প্র্যাকটিস

সরকারি হাসপাতালে নেই বৈকালিক সেবা

Icon

জাহিদ হাসান

প্রকাশ: ১৮ মে ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

সরকারি হাসপাতালে নেই বৈকালিক সেবা

ফাইল ছবি

বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসকদের প্র্যাকটিস কমিয়ে এসে সরকারি হাসপাতালে রোগীদের সেবার মান বাড়াতে বৈকালিক চিকিৎসা কার্যক্রম চালু করা হলেও এখন সেখানে মিলছে না সেবা। কদাচিৎ চিকিৎসক দেখানোর সুযোগ হলেও রোগীদের জন্য তাৎক্ষণিক সব ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার কোনো ব্যবস্থা নেই। কোনো কোনো হাসপাতালে হাতেগোনা দু-একটি পরীক্ষা ছাড়া প্রয়োজনীয় অনেক জরুরি পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয় না।

গত বছর মার্চে চালু হওয়া সরকারি হাসপাতালে বৈকালিক কার্যক্রম সরেজমিন ঘুরে সেবার বেহাল দশা লক্ষ্য করা গেছে। হাসপাতালগুলোতে নিয়মিত বসেন না বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক (অধ্যাপক)। দেওয়া হয় না সব ধরনের রোগভিত্তিক সেবাও। জেলা-উপজেলা পর্যায়ে রয়েছে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও রোগ নির্ণয়ে যন্ত্রপাতির সংকট।

সরকারি হাসপাতালে কর্মরত অধিকাংশ চিকিৎসক নির্ধারিত কর্মঘণ্টার (সকাল আটটা-দুপুর আড়াইটা) পর ব্যক্তিগত চেম্বার বা বেসরকারি হাসপাতাল/ক্লিনিকে প্র্যাকটিস করেন। আশা করা হয়েছিল, নির্ধারিত কর্মঘণ্টার পর সরকারি হাসপাতালে প্রাইভেট প্র্যাকটিসের বিধান চালু করা হলে রোগীর চিকিৎসা ব্যয় অনেকাংশে হ্রাস পাবে। বেসরকারি হাসপাতাল এবং ক্লিনিকগুলোর দৌরাত্ম্য কমবে। কেননা, বেসরকারি হাসপাতাল বা ক্লিনিকে কনসালটেশন ফি এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যয়সহ অন্যান্য ব্যয় অত্যধিক। সরকারি এবং বেসরকারি হাসপাতালের মধ্যে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবার মূল্যহ্রাস এবং গুণগতমান উন্নত করার উদ্দেশ্য নিয়ে সরকার এই উদ্যোগটি নেয়। জেলা ও উপজেলা হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসা মেলায় রাজধানী ও বিভাগীয় পর্যায়ে রেফারেল সিস্টেম কমাসহ হাসপাতালগুলোতে চাপ কমবে-এমনটি ধারণা করা হয়। বাস্তবে ইনস্টিটিউশনাল প্র্যাকটিস কার্যক্রম বেশিরভাগ হাসপাতালেই মুখ থুবড়ে পড়েছে।

একটি নীতিমালার আলোকে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ গত বছরের ৩০ মার্চ প্রাথমিকভাবে ৫১টি সরকারি হাসপাতালে বৈকালিক চিকিৎসাসেবা চালু করে। ১৪ জুন দ্বিতীয় দফায় সারা দেশের আরও ১৩২টি প্রতিষ্ঠানে চালুর মাধ্যমে মোট ১৮৩টি সরকারি হাসপাতালে ‘বৈকালিক কনসালটেশন বা ইনস্টিটিউশনাল প্র্যাকটিস’ কার্যক্রমের উদ্বোধন করা হয়। বৈকালিক স্বাস্থ্যসেবায় ছোট অস্ত্রোপচার ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা যেমন এক্স-রে, আল্ট্রাসনোগ্রাফিসহ প্রয়োজনীয় রোগ নির্ণয়ের সুবিধা দেওয়ার কথা বলা হয় নীতিমালায়। এসব সেবার মূল্যও নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। প্রতিদিন বিকাল ৩টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক, সহকারী অধ্যাপক, সিনিয়র কনসালট্যান্টদের রোগী দেখার নিয়ম করা হয়। বৈকালিক স্বাস্থ্যসেবায় নির্ধারিত ফি ধরা হয় ৫০০ টাকা। এ টাকার মধ্যে অধ্যাপক পাবেন ৪০০ টাকা, চিকিৎসাসেবায় সহযোগিতাকারী ৫০ এবং সার্ভিস চার্জ ৫০ টাকা ধরা হয়। এভাবে সহযোগী অধ্যাপক পাবেন ৩০০ টাকা, সহকারী অধ্যাপক ২০০ এবং এমবিবিএস বা বিডিএস ও সমমানের চিকিৎসকরা পাবেন ১৫০ টাকা। এক্ষেত্রে চিকিৎসাসেবায় সহযোগিতাকারীর জন্য ২৫ টাকা এবং সার্ভিস চার্জ ২৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়।

রাজধানীর জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (নিটোর/পঙ্গু) সেবাটি চালুর নির্দেশনা রয়েছে। মঙ্গলবার সরেজমিন গিয়ে সেখানে এ ধরনের কোনো কার্যক্রম দেখা যায়নি। হাসপাতালের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মাহফুজুর রহমান তালুকদার জানান, এখানে বৈকালিক বিশেষজ্ঞ সেবা এখনো চালু করা হয়নি।

পাশেই জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে গিয়ে একই চিত্র দেখা যায়। হাসপাতালটির পরিচালক অধ্যাপক ডা. গোলাম মোস্তফা দাবি করেন, শুরুর দিকে রোগী হলেও এখন কমে গেছে। তবে কার্যক্রম বন্ধ হয়নি। তিনি বলেন, সকালে প্রায় চার হাজার রোগী হয়। মাত্র ১০ টাকার টিকিটে অস্ত্রোপচারসহ সব চিকিৎসা বিনামূল্যে হয়। বিকালে খরচ বেশি, তাই হয়তো রোগী আসে না।

জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট হাসপাতালে দেড় ঘণ্টায় মাত্র ১০ জন রোগীকে সিরিয়াল দিতে দেখা যায়। টিকিট বিক্রির দায়িত্বে নিয়োজিত আব্দুর রহমান জানান, চার বিভাগের বৈকালিক সার্ভিস চালু আছে। শুরুতে কিছু রোগী হলেও এখন একেবারেই কম আসে। কারণ চিকিৎসক দেখানো গেলেও ইসিজি ছাড়া অন্যান্য পরীক্ষা তাৎক্ষণিকভাবে হয় না।

কেরানীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কর্মচারী জুলহাস মুঠোফোনে এই প্রতিবেদককে জানান, মঙ্গলবার বৈকালিক সেবা নিতে মাত্র একজন রোগী এসেছিলেন। একজন মেডিসিন কনসালটেন্ট রোগীর সেবা দেন।

বুধবার রাজধানীর বাইরে বিকালে নীলফামারীর ডোমার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে খোঁজ নিয়ে বৈকালিক সার্ভিসের সেবাদাতা চিকিৎসক ও রোগী কাউকে পাওয়া যায়নি। জানতে চাইলে উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা রায়হান বারী মুঠোফোনে জানান, রোগীরা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দেখাতে আগ্রহী। কিন্তু হাসপাতালে কোনো বিশেষজ্ঞ নেই। দৈনিক দুই থেকে তিনজন রোগী আসেন। তাদের ইমারজেন্সিতে পাঠিয়ে বৈকালিক সার্ভিসের ফি নেওয়া হয়।

গত ছয় মাস ধরে বৈকালিক স্বাস্থ্যসেবা সম্মানী না পাওয়ার অভিযোগ করেছেন ফেনী জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসকরা। ফলে কার্যক্রমটি বন্ধ রয়েছে। হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. আবুল খায়ের মিয়াজি দাবি করেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনের কারণে কিছুটা ধীরগতিতে চলছে। তিনি জানান, প্রথমে যে প্রজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছিল সেভাবে চিকিৎসকদের টাকা দিয়েছি। ওই আদেশের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা এসেছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের ছাড়পত্রের মাধ্যমে নতুন আরেকটি প্রজ্ঞাপন হবে। সে অনুযায়ী সম্মানী দেওয়া হবে।

বুধবার দুদফায় চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স হাসপাতালের বহির্বিভাগে গিয়ে সেখানেও বৈকালিক চেম্বারে কোনো চিকিৎসক পাওয়া যায়নি। পরে হাসপাতালের রেকর্ড থেকে জানা যায়, গত দুই মাসে মাত্র ৪৮ জন রোগী বৈকালিক সেবা পেয়েছেন। এদিন বৈকালিক সেবা নিতে আসা আসমা বেগম নামে এক রোগী অভিযোগ করেন, তিনি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দেখাতে বিকাল ৩টা থেকে অপেক্ষা করছেন। বেশ কয়েকজন দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করে চলে গেছেন। এ বিষয়ে পটিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. নাজমা আক্তার বলেন, বৈকালিক চেম্বারে ডাক্তার সেবা দেন না-এই প্রথম শুনেছেন। বিষয়টি তিনি খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেবেন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল ও ক্লিনিক শাখার পরিচালক ডা. আবু হোসেন মো. মঈনুল আহসান বলেন, রোগীরা সকালেই হাসপাতালে প্রয়োজনীয় সেবা পাচ্ছেন। এ ছাড়া একজন রোগী অর্থ খরচ করে বহির্বিভাগে নয় বরং এসি রুম বা ভিআইপি পরিবেশে সেবা নিতে চাইবে, যা সরকারি হাসপাতালে তাৎক্ষণিকভাবে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। নিউরোসায়েন্সসহ বেশকিছু হাসপাতালে বেশ ভালো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে। রোগীদের স্বার্থেই এটা চালু করা হয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ যুগান্তরকে বলেন, বিগত স্বাস্থ্যমন্ত্রীর আমলে স্বাস্থ্য খাতে খামখেয়ালিপনার নতুন সংযোজন ছিল সরকারি হাসপাতালে ইনস্টিটিউশনাল প্র্যাক্টিস। উপযুক্ত প্রস্তুতি ও প্রাক-মূল্যায়ন ছাড়াই একদিন আগে নোটিশ দিয়ে চিকিৎসকদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়।

তিনি বলেন, সরকারি হাসপাতালে পর্যাপ্তসংখ্যক চিকিৎসক ও প্রয়োজনীয় সহায়ক জনবল নিয়োগ একই ক্লিনিক্যাল গ্রুপের একাধিক বিশেষজ্ঞ কর্মরত থাকা এবং ডায়াগনস্টিক টেস্টের ব্যবস্থা থাকা। এই শর্তগুলো পূরণ করতে না পারায় এটির উদ্দেশ্য ব্যর্থ হচ্ছে।

প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহায়তা করেছেন যুগান্তরের ফেনী জেলা, নীলফামারীর ডোমার উপজেলা ও চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলা প্রতিনিধি

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম