Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

গ্রামাঞ্চলের অপরিকল্পিত উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ 

মহাপরিকল্পনার বাইরে দেশের ৮৪ শতাংশ

মহাপরিকল্পনা ছাড়া গ্রামাঞ্চলের পরিকল্পিত, টেকসই ও পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন সম্ভব নয় -সভাপতি, বিআইপি

Icon

মতিন আব্দুল্লাহ 

প্রকাশ: ১১ মে ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

মহাপরিকল্পনার বাইরে দেশের ৮৪ শতাংশ

দেশের ২৩ হাজার ২৯ বর্গকিলোমিটার অঞ্চলের মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে। যা বাংলাদেশের মোট আয়তনের ১৫.৬২ শতাংশ। এখনো ৮৪ শতাংশ অঞ্চল মহাপরিকল্পনার বাইরে । যে কারণে দেশের সর্বত্র অপরিকল্পিত উন্নয়নযজ্ঞ চলছে, পরিবেশ ও প্রতিবেশ নষ্ট হচ্ছে। এ অবস্থায় সরকার গ্রামাঞ্চলের অপরিকল্পিত উন্নয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এখন প্রশ্ন উঠেছে মহাপরিকল্পনা ছাড়া পরিকল্পিত উন্নয়ন কিভাবে সম্ভব? উল্লেখ্য বাংলাদেশের আয়তন ১ লাখ ৪৭ হাজার ৬১০ বর্গকিলোমিটার।

অনুসন্ধানে জানা যায়-গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন সংস্থাগুলোর মধ্যে নগর উন্নয়ন অধিদপ্তরের (ইউডিডি) আওতায় ১৩ হাজার ৬৬৪.৩৪ বর্গকিলোমিটার অঞ্চলের ৩৬টি মহাপরিকল্পনা তৈরি করা হয়েছে। এরমধ্যে ৪টি জেলা শহর, ৩৩টি উপজেলা ও উপজেলা শহর এবং পায়রা বন্দরের পরিকল্পনা করেছে। এছাড়া রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ), খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (কেডিএ), রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (আরডিএ) এবং কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (কউক) নিজস্ব এখতিয়ারভুক্ত ৬ হাজার ৩৬০.৫৫ বর্গকিলোমিটার এলাকার পরিকল্পনা তৈরি করেছে। ইউডিডি এবং উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ মিলে দেশের ২০ হাজার ২৪.৮৯ বর্গকিলোমিটার এলাকার মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করছে, যেটা দেশের মোট আয়তনের ১৩.৫৯ শতাংশ। পাশাপাশি স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের আওতায় স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) ২১৬টি পৌরসভার ৩০০৪.১১ বর্গকিলোমিটার এলাকার মহাপরিকল্পনা করেছে, যেটা দেশের মোট আয়তনের ২.০৩ শতাংশ। 

অনুসন্ধানে আরও জানা যায়-দেশের যে অংশের মহাপরিকল্পনা করা হয়েছে, তার সব গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয়নি। যেগুলো গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয়েছে তারও বাস্তবায়ন করা হচ্ছে না। পাশাপাশি পরিকল্পিত উপায়ে সারা দেশের নগরায়ণ ও উন্নয়নে যে পদ্ধতি অনসুরণ করা দরকার সে পথেও হাঁটছে না সরকার। বিশেষ করে জাতীয় ভৌত পরিকল্পনা, আঞ্চলিক পরিকল্পনা ছাড়া খণ্ড খণ্ড পরিকল্পনায় কার্যত সুফল মিলে না। এই দুই পরিকল্পনার আলোকে স্থানীয় পর্যায়ের পরিকল্পনা প্রণয়ন করে সমন্বিতভাবে তার বাস্তবায়ন করা হয়। গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের কাঁধে এই দায়িত্ব থাকলেও মন্ত্রণালয় সে কাজ শুরুর কোনো উদ্যোগ না নিয়ে গ্রাম অঞ্চলের উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ করতে তিনটি মন্ত্রণালয়ের সহায়তা চেয়েছেন। যার মাধ্যমে কার্যত তেমন কোনো সুফল মিলবে না। এজন্য গণপূর্ত মন্ত্রণালয়কে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতা নিয়ে পরিবেশবান্ধব ও টেকসই উন্নয়নের উদ্যোগ নিতে হবে। তা না হলে কার্যত কোনো সুফল মিলবে না বলে মনে করছেন নগরপরিকল্পনাবিদ এবং সংশ্লিষ্টরা। 

এদিকে ১ ফেব্রুয়ারি গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্তমন্ত্রী র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী এমপি তিনটি মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী বরাবর একটি চিঠি ইস্যু করেছেন। মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে রয়েছে-স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয় এবং পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রণালয়। ওই চিঠিতে বলা হয়েছে-গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় ভূমির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করে পরিকল্পিত নগরায়ণ ও শহর এলাকার নাগরিকদের জন্য সাশ্রয়ী, মানসম্মত ও পরিবেশবান্ধব আবাসন নিশ্চিত করতে কাজ করে যাচ্ছে। তবে পরিতাপের বিষয় যে-গ্রামাঞ্চলের অপরিকল্পিত আবাসন ও অবকাঠামো নির্মাণের ফলে একদিকে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে, অন্যদিকে দেশের কৃষি জমি দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। ফলে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়েছে। এই অবস্থায় শহরাঞ্চলের পাশাপাশি গ্রামীণ অবকাঠামো ও আবাসন ব্যবস্থায়ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা জরুরি হয়ে পড়েছে। এজন্য গ্রামাঞ্চলের অপরিকল্পিত উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ করতে স্থানীয় সরকার, পূর্ত, কৃষি এবং পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের পারস্পারিক সহযোগিতা ও সমন্বয়ের মাধ্যমে কাজ করার সুযোগ রয়েছে। এজন্য প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও করণীয় নির্ধারণের জন্য একটি সাধারণ সভা করা যেতে পারে। এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়গুলোর পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণের প্রত্যাশা করা হয়। তবে চিঠি ইস্যুর পর ৩ মাসের বেশি সময় অতিবাহিত হলেও অন্যান্য মন্ত্রণালয়গুলোর পক্ষ থেকে কোনো ধরনের সাড়া মেলেনি। 

সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কয়েকজন কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের কাজ সারা দেশের মহাপরিকল্পনা তৈরি করা। তার আলোকে দেশের উন্নয়ন হওয়ার কথা। অল্প কিছু এলাকার পরিকল্পনা করেছে। তারও কোনো বাস্তবায়ন নেই। পূর্ত মন্ত্রণালয় জাতীয় ভৌত পরিকল্পনা, আঞ্চলিক পরিকল্পনা ও স্থানীয় পর্যায়ের পরিকল্পনা করে দিলে তার আলোকে অন্যান্য মন্ত্রণালয় প্রকল্প গ্রহণ করবে। সেখানে পরিবেশ, জলাশয় ও উন্নয়নের নির্দেশনা দেওয়া থাকবে, সবাই সেটা অনুসরণ করবে। কিন্তু সে ধরনের কোনো উদ্যোগ না নিয়ে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়ে তো কোনো কাজ হবে না। 

বিশেষজ্ঞ অভিমত : জানতে চাইলে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান যুগান্তরকে বলেন-পরিকল্পিত, পরিবেশবান্ধব ও টেকসই উন্নয়নের জন্য মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন বাধ্যতামূলত কাজ। আর এই প্রক্রিয়ায় প্রথম কাজ-জাতীয় ভৌত পরিকল্পনা প্রণয়ন, এরপর আঞ্চলিক পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং সর্বশেষ স্থানীয় পর্যায়ের মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করা। কিন্তু সেগুলো না করে কৃষিজমি, হাওড়, বাঁওড়, জলাশয় রক্ষা করা সম্ভব হবে না। আর বিদ্যমান অবস্থায় পরিকল্পিত ও টেকসই উন্নয়নতো অবাস্তব চিন্তা।

তিনি বলেন, নতুন সরকারের পূর্তমন্ত্রী দায়িত্ব গ্রহণের পর তার সঙ্গে পরিকল্পনাবিদদের পক্ষ থেকে দেখা করে তার কাছে দেশের অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও উন্নয়নের বাস্তবচিত্র তুলে ধরা হয়েছে। পাশাপাশি পূর্ত মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন জাতীয় প্রতিষ্ঠান নগর উন্নয়ন অধিদপ্তরকে (ইউডিডি) শক্তিশালী করা এবং ওই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সারা দেশের পরিকল্পনা প্রণয়নে উদ্যোগ নিতে অনুরোধ জানানো হয়েছে। তার এ ব্যাপারে আন্তরিকতা দেখেছি, কিন্তু এখনো কোনো উদ্যোগ দেখিনি।

তিনি জানান, পূর্ত মন্ত্রণালয় থেকে সম্প্রতি স্থানীয় সরকার, কৃষি ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়ে গ্রামাঞ্চলের পরিকল্পিত উন্নয়ন, কৃষি জমি ও পরিবেশ সুরক্ষায় ভূমিকা রাখতে অনুরোধ জানানো হয়েছে। এটা ইতিবাচক দিক যে মন্ত্রণালয় সারা দেশের পরিকল্পিত ও পরিবেশবান্ধব উন্নয়নের চিন্তা করছে। তবে এভাবে চিঠি না দিয়ে পূর্ত মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে এ ইস্যুতে মন্ত্রী পর্যায়ের সভা করে মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের কাজটি এগিয়ে নেওয়ার বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে।

কর্তৃপক্ষের বক্তব্য : এ প্রসঙ্গে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী এমপি যুগান্তরকে বলেন-বর্তমান সরকার সারা দেশে পরিকল্পিত উন্নয়ন করতে চায়। কেননা অপরিকল্পিত উন্নয়নের কারণে কৃষি জমি হ্রাস পাচ্ছে। জলাশয়, হাওড়, বাঁওড়, পুকুর ভরাট হয়ে যাচ্ছে। শহরাঞ্চলের পরিকল্পিত উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণে কার্যক্রম চলমান থাকলেও গ্রামাঞ্চলে একেবারে কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। যার যা ইচ্ছা, সেভাবে কাজ করছেন। এজন্য গ্রামাঞ্চলকেও পরিকল্পিত উপায়ে গড়ে তোলা হবে।

তিনি বলেন, পরিবেশ, কৃষি ও স্থানীয় সরকারের গ্রাম পর্যায়ে অনেক কার্যক্রম রয়েছে। এজন্য ওই মন্ত্রণালয়গুলোকে চিঠি দিয়ে পূর্ত মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনার কথা জানানো হয়েছে। আশা করি তারাও বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে। সবাই মিলে যার যার অবস্থান থেকে কাজ করলে ভালো ফলাফল আসবে।
তিনি জানান, গ্রামাঞ্চলের পরিকল্পিত উন্নয়ন ও পরিবেশ সুরক্ষার জন্য যা যা করা দরকার সবকিছু করা হবে। ধাপে ধাপে সেসব কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হবে। অপরিকল্পিত ও পরিবেশ ধ্বংস করে কাজ করলে টেকসই, স্মার্ট ও উন্নত দেশ গড়ে তোলা সম্ভব হবে না। 
 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম