প্রথম ধাপের উপজেলা পরিষদ নির্বাচন: হলফনামার তথ্য বিশ্লেষণ টিআইবির
সম্পদ বৃদ্ধিতে এমপিদের চেয়ে এগিয়ে চেয়ারম্যান প্রার্থীরা
এমপিদের সম্পদ বৃদ্ধির হার ৩০৬৫%, চেয়ারম্যানের ৪২০০ শতাংশের বেশি * মন্ত্রী-এমপিদের স্বজন নির্বাচন করছেন ১৩ জন * কোটিপতি প্রার্থীর সংখ্যা ১১৭ জন
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ০৭ মে ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
চলমান ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ধনাঢ্য প্রার্থীর ছড়াছড়ি। জাতীয় সংসদের মতো এ নির্বাচনেও ব্যবসায়ীদের দাপট বেশি। প্রথম ধাপের নির্বাচনে ১১৭ প্রার্থী রয়েছেন, যাদের প্রত্যেকের কোটি টাকার বেশি সম্পদ রয়েছে। কমপক্ষে এক একর পরিমাণ জমি রয়েছে-এমন প্রার্থী রয়েছেন ৫৫০ জন। আইনি সীমা অনুযায়ী একজনের ১০০ বিঘা বা ৩৩ একর বেশি জমি থাকার নিয়ম নেই। অথচ ওই সীমা অতিক্রম করা জমি রয়েছে অন্তত আট চেয়ারম্যানপ্রার্থীর। তাদের একজনের সর্বোচ্চ ৭৪.২৭ একর জমি আছে।
গত পাঁচ বছরে অস্থাবর সম্পদ অর্জনে সংসদ-সদস্যদেরও ছাড়িয়ে গেছেন উপজেলা চেয়ারম্যানরা। ওই সময়ে সংসদ-সদস্যদের সম্পদ বৃদ্ধির হার সর্বোচ্চ ৩০৬৫ শতাংশ। পক্ষান্তরে একজন উপজেলা চেয়ারম্যানের সম্পদ বেড়েছে ৪২০০ শতাংশের বেশি। উপজেলা চেয়ারম্যানদের স্ত্রী-সন্তানদের সম্পদও সংসদ-সদস্যদের তুলনায় বেড়েছে। সংসদ-সদস্যদের স্ত্রী-সন্তানদের সম্পদ বাড়ার সর্বোচ্চ হার ৯৯০৭ শতাংশ। সেখানে একজন চেয়ারম্যানের পরিবারের সম্পদ বেড়েছে সর্বোচ্চ ১২৪০০ শতাংশ।
প্রথম ধাপের ১৪৪ উপজেলার প্রার্থীদের হলফনামার তথ্য বিশ্লেষণ করে সম্পদ বৃদ্ধির এ চিত্র পেয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। সোমবার সকালে রাজধানীর মাইডাস সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য প্রকাশ করে সংস্থাটি। প্রথম ধাপের ১৪৪টি উপজেলার প্রার্থীদের ৪র্থ ও ৫ম ধাপের নির্বাচনি হলফনামার সঙ্গে তুলনা করে এ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে বলে জানিয়েছে টিআইবি। প্রথম ধাপে ১৫২টির তফশিল ঘোষণা করা হলেও ৮টি উপজেলা নির্বাচনের প্রার্থীদের তথ্য পায়নি সংস্থাটি। মঙ্গলবার এসব উপজেলায় ভোট হবে।
সংবাদ সম্মেলনে প্রতিবেদন তুলে ধরেন টিআইবির পরিচালক তৌহিদুল ইসলাম। তিনি জানান, এ ধাপের প্রার্থীদের ৫৬.৪১ শতাংশ ব্যবসায়ী। ১১৭ প্রার্থী কোটিপতি, যা মোট প্রার্থীর ৭ শতাংশ। বাকি ৯৩ শতাংশের সম্পদ কোটি টাকার নিচে। প্রার্থীদের ১৬.৬৪ শতাংশ বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের মামলায় অভিযুক্ত। অতীতে মামলা ছিল ১৯.৭৬ শতাংশ প্রার্থীর। মন্ত্রী-এমপিদের অন্তত ১৩ স্বজন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
উপজেলা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের বিপুল পরিমাণ সম্পদ অর্জন বিস্ময়কর বলে উল্লেখ করেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। তিনি সংবাদ সম্মেলনে বলেন, অনেক জনপ্রতিনিধির আয় অস্বাভাবিক পরিমাণে বেড়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে উপজেলা নির্বাচনের প্রার্থীদের আয় ও সম্পদ বৃদ্ধির হার জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রার্থীদের চেয়েও বেশি। তিনি বলেন, হলফনামায় যথাযথ কিংবা পর্যাপ্ত ও সঠিক তথ্য দেওয়া হয়েছে কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন আছে। কোনো কোনো প্রার্থীর আয় খুবই কম দেখানো হয়েছে, যার বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ।
আবার যেসব প্রার্থীর আয় ও সম্পদ গগনচুম্বী হারে বেড়েছে বা তাদের নির্ভরশীলদের আয়-সম্পদের যে বিপুল বিকাশ ঘটেছে, তা বৈধ সূত্রের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কি না, এ প্রশ্নও অত্যন্ত যৌক্তিক। বাস্তবতা হলো, প্রার্থীদের হলফনামা বিশ্লেষণের মাধ্যমে জনগণ শুধু তথ্যই জানতে পারছে। তবে তার সত্যতা ও যথার্থতা যেমন দেখতে পারছি না, একইভাবে আইনের প্রয়োগ কিংবা ফল কোনোটিই দেখছি না। অথচ এ হলফনামার সত্যতা ও যথার্থতা নিশ্চিতের দায়িত্ব যাদের, সেই নির্বাচন কমিশন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এবং দুর্নীতি দমন কমিশন স্বতঃপ্রণোদিতভাবে খতিয়ে দেখার দায়িত্বটি পালন করছে না, যা হতাশাজনক।
জনপ্রতিনিধি নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তুলে ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, আমাদের দেশে জনস্বার্থ নয় বরং ব্যক্তিস্বার্থ প্রাধান্য পাচ্ছে। আবার দলীয় শৃঙ্খলা, আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীলতা কিংবা দলের নীতিগত সিদ্ধান্ত মেনে চলার মতো যে ধরনের আচরণ রাজনৈতিক দলের মতো গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের কাছে প্রত্যাশিত, তা ক্ষমতার রাজনীতির কাছে জিম্মি হয়ে গেছে। যেহেতু ক্ষমতায় যেতে পারলে সম্পদ বিকাশের সীমাহীন সুযোগ তৈরি হয়, আর ক্ষমতার বাইরে থাকলে এ সুযোগ থেকে বঞ্চিত হতে হয়-ফলে একটি অসুস্থ প্রতিযোগিতা দেখা যাচ্ছে। উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, ব্যবসায়ীরা যেরূপ আগ্রাসীভাবে রাজনীতিতে আসছেন, তারা কি সুস্থ বা যথাযথ রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় আসছেন কি না, সেই প্রশ্ন রয়েছে।
উপজেলা নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির অবস্থা তুলে ধরে টিআইবির প্রতিবেদনে বলা হয়, ভোট প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করতে এবার ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ দলগতভাবে কোনো প্রার্থী ঘোষণা করেনি। উপজেলা নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রার্থীর অধিকাংশই ‘দলীয় স্বতন্ত্র প্রার্থী’। যদিও বেশির ভাগ স্বতন্ত্র প্রার্থীই দলের স্থানীয় নেতৃত্বের সমর্থনপুষ্ট। অপরদিকে বিএনপি এ নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেওয়ার পরও দলটির আগ্রহী প্রার্থীরা স্বতন্ত্র নির্বাচন করছেন। অবশ্য উলটো চিত্র জামায়াতের প্রার্থীদের ক্ষেত্রে। প্রথম ধাপে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে অংশগ্রহণ করা ২২ জামায়াত নেতা পরে দলের সিদ্ধান্তে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। অন্যদিকে ছোট দলগুলো দলীয় প্রার্থী দেয়নি।
মন্ত্রী-এমপিদের স্বজন ১৩ জন : জাতীয় সংসদ-সদস্যদের স্বজনদের উপজেলা নির্বাচনে অংশ নিতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বিধিনিষেধ জারি করেছে। কিন্তু দলের নিষেধাজ্ঞার বাইরে গিয়ে ষষ্ঠ উপজেলা নির্বাচনে প্রথম পর্বে অন্তত ১৩ জন উপজেলা চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হয়েছেন বলে জানিয়েছে (টিআইবি)। তাদের মধ্যে রয়েছেন সংসদ-সদস্যের পুত্র, চাচাতো ভাই, খালাতো ভাই, জামাতা, ভাইয়ের ছেলে, ভাই ও চাচা।
তিন সংসদ-সদস্যের পুত্র উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচন করছেন। এ তিনজন হচ্ছেন মাদারীপুর সদর উপজেলা চেয়ারম্যান পদে সংসদ-সদস্য ও আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য শাজাহান খানের ছেলে আসিবুর রহমান, নোয়াখালীর সুবর্ণচর উপজেলায় সংসদ-সদস্য একরামুল করিম চৌধুরীর ছেলে আতাহার ইশরাক চৌধুরী এবং বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলায় সংসদ-সদস্য সাহাদারা মান্নানের ছেলে মোহাম্মদ সাখাওয়াত হোসেন। আর তিন সংসদ-সদস্যের ছোট ভাই উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচন করছেন। তারা হলেন বগুড়ার সোনাতলা উপজেলা চেয়ারম্যান পদে সংসদ-সদস্য সাহাদারা মান্নানের ছোট ভাই মিনহাদুজ্জামান, সংসদ-সদস্য শামসুল হক টুকুর ছোট ভাই মো. আবদুল বাতেন বেড়া উপজেলা চেয়ারম্যান পদে এবং সংসদ-সদস্য শ ম রেজাউল করিমের ছোট ভাই এসএম নূর ই আলম নাজিরপুর উপজেলা চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করছেন।
সম্পদ ও পেশা : টিআইবি বলেছে, স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও ব্যবসায়ীদের দাপট বাড়ছে। অনেকেরই অবিশ্বাস্য হারে আয় ও সম্পদের বিকাশ ঘটেছে। ফলে জনস্বার্থ থেকে বিচ্যুত হয়ে ব্যক্তিস্বার্থ বা মুনাফাকেন্দ্রিক রাজনীতি প্রাধান্য পাচ্ছে। ব্যবসায়ী প্রার্থীদের সংখ্যা চতুর্থ নির্বাচনের তুলনায় ৮ শতাংশ বেড়ে এবার দাঁড়িয়েছে ৫৬ শতাংশে। চেয়ারম্যান পদপ্রার্থীদের ৬৯.৮৬ শতাংশ, ভাইস চেয়ারম্যান পদে প্রায় ৬৬.৫৯ শতাংশ এবং নারী ভাইস চেয়ারম্যান পদে ২৪.৩৭ শতাংশের পেশা ব্যবসা। নারী ভাইস চেয়ারম্যানপ্রার্থীদের সাড়ে ১৯ শতাংশ তাদের পেশা গৃহিণী/গৃহস্থালি দেখালেও আয় ব্যবসা থেকে আসে বলে হলফনামায় উল্লেখ করেছেন।
অস্থাবর সম্পদ বৃদ্ধির হারে সংসদ-সদস্যদের পেছনে ফেলেছেন উপজেলা পরিষদের জনপ্রতিনিধিরা। ৫ বছরে সংসদ-সদস্যদের অস্থাবর সম্পদ বৃদ্ধির হার সর্বোচ্চ ছিল ৩ হাজার ৬৫ শতাংশ। সেখানে একটি উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের (গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলা চেয়ারম্যান জিএম সেলিম পারভেজ) সম্পদ বেড়েছে ৪ হাজার ২০০ শতাংশের বেশি।
একইভাবে ৫ বছরে একজন চেয়ারম্যানের (খাগড়াছড়ির রামগড় উপজেলা চেয়ারম্যান বিশ্ব প্রদীপ কুমার কারবারী) আয় বেড়েছে সর্বোচ্চ ৩ হাজার ৩১৯ শতাংশ। আর ১০ বছরের আয় বৃদ্ধির হার সর্বোচ্চ ১৮ হাজার ২৩৩ শতাংশ। এই আয় বেড়েছে গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার নারী ভাইস চেয়ারম্যান রওশন আরা সরকারের। উপজেলা চেয়ারম্যানের স্ত্রী ও নির্ভরশীলদের সম্পদ বৃদ্ধির সর্বোচ্চ হার ১২ হাজার ৪০০ শতাংশ। রাজবাড়ীর পাংশা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো. ফরিদ হাসানের (ওদুদ) পরিবারের সদস্যদের এ হারে সম্পদ বেড়েছে।
অস্থাবর সম্পদের দিক থেকে প্রথম ধাপের নির্বাচনে প্রার্থীদের মাত্র ৭ শতাংশ কোটিপতি। বাকি প্রায় ৯৩ শতাংশ প্রার্থীর সম্পদ কোটি টাকার নিচে। চেয়ারম্যান পদপ্রার্থীদের মধ্যে ৯৪ জন কোটিপতি। আগের নির্বাচনের তুলনায় এ সংখ্যা বেড়েছে প্রায় তিনগুণ (৫ম নির্বাচনে ছিল ৩৭ জন)। সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন টিআইবির গবেষণা দলের সদস্য ও আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের অ্যাসিস্ট্যান্ট কোঅর্ডিনেটর রিফাত রহমান, কেএম রফিকুল আলম ও ইকরামুল হক ইভান।