Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

সাক্ষাৎকারে ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম

আয় বাড়ানো বড় চ্যালেঞ্জ

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ জরুরি * খেলাপি ঋণ অন্যতম বড় সমস্যা

Icon

মনির হোসেন

প্রকাশ: ০৩ মে ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

আয় বাড়ানো বড় চ্যালেঞ্জ

সরকারের একটি নির্দিষ্ট সময়ের আয়ব্যয়ের খতিয়ান হচ্ছে বাজেট। এটি তৈরি করতে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি, বহিঃখাত, সম্ভাব্য রাজনৈতিক পরিস্থিতিসহ সবকিছু বিবেচনায় নিতে হয়। বাংলাদেশে বাজেটে অন্যতম সমস্যা মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) তুলনায় রাজস্ব আদায় কম।

এ আয় বাড়ানো এবং মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ বাজেটে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এটি মোকাবিলায় সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। যুগান্তরের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম এসব কথা বলেন। তার মতে, খেলাপি ঋণ কমাতে না পারলে অদূরভবিষ্যতে অর্থনীতিতে বড় ধরনের সমস্যা তৈরি হবে। আর অর্থ পাচার বন্ধে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত জরুরি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন যুগান্তরের সিনিয়র রিপোর্টার-মনির হোসেন

যুগান্তর : বর্তমানে দেশের সামষ্টিক পরিস্থিতি কীভাবে মূল্যায়ন করছেন?

মির্জ্জা আজিজ : সামষ্টিক অর্থনীতিতে চ্যালেঞ্জ হচ্ছে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা। অনেকদিন ধরে প্রবৃদ্ধি ৭/৮ শতাংশে ছিল। বর্তমানে এ হার কিছুটা কমে গেছে। বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ), এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকসহ প্রতিটি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের চলতি অর্থবছরের প্রবৃদ্ধির হার কমিয়ে দিয়েছে। বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠান বলেছে, প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের নিচে থাকবে। দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ হলো মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ। ইতোমধ্যে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের বেশি। এ কারণে নিু ও মধ্যবিত্তরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিশ্বের অনেক দেশে মূল্যস্ফীতি কমছে। কারণ, উন্নত দেশগুলো তাদের মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে ব্যবস্থা নিচ্ছে।

তৃতীয় বিষয় হলো, আমাদের মুদ্রার বিনিময় হার বেশি। অর্থাৎ ডলারের বিপরীতে ক্রমেই দুর্বল হচ্ছে টাকা। ডলারের দাম মূল্যস্ফীতি প্রভাবিত করে। কাঁচামাল, মধ্যবর্তী পণ্য, মূলধনি যন্ত্রপাতি এবং কিছু খাদ্যও আমরা আমদানি করে থাকি। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে আমরা সম্পৃক্ত। তবে অভ্যন্তরীণ চাহিদা কমিয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ কাম্য নয়। মূল্যস্ফীতির কারণে নিু-আয়ের মানুষের যাতে ক্ষতি না হয়, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে।

অন্যদিকে দেশে বৈষম্য বাড়ছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো আঞ্চলিক বৈষম্য। যেমন : রংপুর ও বরিশালে ঢাকা ও চট্টগ্রামের চেয়ে দারিদ্র্যের হার বেশি। সেক্ষেত্রে সামাজিক নিরাপত্তা বাড়াতে হবে। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে যেসব বরাদ্দ দেওয়া হয়, এর সুবিধা প্রকৃত লোকজন পায় না। তাই এখানে দুর্নীতি বন্ধে পদক্ষেপ নিতে হবে।

যুগান্তর : এবারের বাজেটে কী কী চ্যালেঞ্জ থাকছে?

মির্জ্জা আজিজ : বাজেট হচ্ছে একটি নির্দিষ্ট সময়ের আয়ব্যয়ের খতিয়ান। কীভাবে অর্থ আয় হবে এবং কীভাবে কোন খাতে কত পরিমাণ ব্যয় করা হবে, এর একটি সম্ভাব্য খতিয়ানই হচ্ছে বাজেট। সীমিত সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করে প্রতিটি দেশই চায় কীভাবে সর্বাধিক জনকল্যাণ নিশ্চিত করা যায়। কিন্তু বাজেট প্রণয়নের সময় বিভিন্ন রকম চাপ থাকে। অনেক সময় সরকার সে চাপের সামনে নতি স্বীকার করে। এতে বাজেট থেকে যেভাবে কাক্সিক্ষত সুফল পাওয়ার কথা, তা অনেক সময়ই পাওয়া যায় না।

এসব কারণে বাজেটে অন্যতম চ্যালেঞ্জ থাকে রাজস্ব আদায়। দেশে জিডিপির তুলনায় কর আদায়ের যে হার, তা তুলনামূলকভাবে অনেক কম। পৃথিবীর যেসব দেশের কর-জিডিপি অনুপাত সবচেয়ে কম, বাংলাদেশ সেগুলোর মধ্যে অন্যতম। এক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কর আদায়ের হার বাড়ছে না, বরং আরও কমছে। এটি খুবই উদ্বেগজনক।

রাজস্ব খাতে ব্যর্থতার কারণে বাজেটে যেসব ক্ষেত্রে বরাদ্দ বাড়ানো প্রয়োজন, সেখানে ব্যয় বাড়ানো যাচ্ছে না। দেশে বিদ্যমান আর্থসামাজিক অবস্থায় শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক নিরাপত্তা প্রভৃতি খাতে বরাদ্দ বাড়ানো প্রয়োজন। কিন্তু আর্থিক স্বল্পতায় তা বাড়ছে না।

যুগান্তর : অর্থনীতির অবস্থা তেমন ভালো নয়। এ অবস্থায় রাজস্ব আদায়ে কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া উচিত?

মির্জ্জা আজিজ : রাজস্ব বাড়ানোর জন্য অবশ্যই পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। এজন্য বর্তমান করদাতাদের ওপর চাপ না বাড়িয়ে নতুন করদাতা শনাক্ত করা জরুরি। তাদের কর নেটওয়ার্কের আওতায় আনতে হবে। অর্থাৎ করের হার না বাড়িয়ে আওতা বাড়াতে হবে। অন্যদিকে কর ফাঁকি রয়েছে। যেমন : ভ্যাট আদায়ের ক্ষেত্রে অনেক দোকানদার রসিদ দেয় না। তারা টাকা আদায় করলেও সরকারের কোষাগারে জমা দেয় না। আয়করের ক্ষেত্রে টিআইএন (করদাতা শনাক্তকরণ নম্বর) যাদের আছে, রিটার্ন জমা দেয় তার অর্ধেক। বাকি অর্ধেককে কেন পাওয়া যাচ্ছে না, তা আমার কাছে বোধগম্য নয়। ফলে আমাদের করদাতা বাড়ানো জরুরি। তবে এক্ষেত্রে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর্মকর্তাদের দক্ষতার অভাব, না তারা দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত-সেটি ভেবে দেখা দরকার।

যুগান্তর : আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ক্রমেই কমছে, এটি কীভাবে মূল্যায়ন করছেন?

মিজ্জা আজিজ : আমাদের বহিঃখাতে সমস্যা রয়েছে। যে কারণে রিজার্ভ কমছে। রিজার্ভ বাড়ানোর জন্য আমাদের রপ্তানি প্রবৃদ্ধি সন্তোষজনক নয়। ফলে রপ্তানি আরও বাড়াতে হবে। এর আগে কানাডা, কোরিয়া ও জাপানে আমাদের নতুন বাজার সৃষ্টি হয়েছিল। সেসব দেশে রপ্তানি বাড়াতে চেষ্টা করতে হবে। এক্ষেত্রে পণ্যের বহুমুখীকরণ জরুরি। কারণ এখনো আমাদের রপ্তানি আয়ের ৮৫ শতাংশ আসে তৈরি পোশাক খাত থেকে। ফলে এখানে নতুন নতুন পণ্য কীভাবে যোগ করা যায়, সেজন্য চেষ্টা করতে হবে।

আমাদের রিজার্ভ বৃদ্ধির আরেকটি খাত হলো রেমিট্যান্স (প্রবাসী আয়)। এই রেমিট্যান্সের অবস্থা ভালো নয়। যদিও জনশক্তি রপ্তানি অনেক বাড়ছে, কিন্তু রেমিট্যান্স বাড়ছে না। বর্তমানে রেমিট্যান্স পাঠালে প্রণোদনা দেওয়া হয়। এটিও তেমন কাজ করছে না। রেমিট্যান্স বাড়াতে পদক্ষেপ নিতে হবে। এক্ষেত্রে কীভাবে সহজে রেমিট্যান্স পাঠানো যায়, সে ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে হবে। এক্ষেত্রে বিদেশে আমাদের দূতাবাসগুলো কীভাবে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে পারে, সেদিকে দৃষ্টি দেওয়া দরকার।

যুগান্তর : ঋণ দেওয়ার জন্য আইএমএফ ইতোমধ্যে বেশকিছু সংস্কারের শর্ত দিয়েছে। সরকারও সেগুলো বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। সেসব শর্ত বাজেটে কী প্রভাব ফেলবে?

মির্জ্জা আজিজ : আর্থিক খাতে নিঃসন্দেহে সংস্কার প্রয়োজন। কারণ, অর্থনীতিতে বড় সমস্যা হলো খেলাপি ঋণ। এটি ক্রমেই বাড়ছে। এখানেও বাংলাদেশ ব্যাংক যে পরিসংখ্যান দেয়, তার গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। ঋণ পুনঃতফশিল হলে সেটিকে খেলাপির বাইরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এছাড়াও মামলায় আটকে থাকা ঋণও খেলাপির হিসাবে নেই। এসব হিসাব করলে খেলাপি ঋণের মাত্রা অনেক। এসব ঋণে কী ধরনের জামানত নেওয়া হয়, তা নিয়ে বড় প্রশ্ন আছে।

যুগান্তর : আইএমএফ-এর আরেকটি শর্ত হলো ভর্তুকি কমাতে হবে। এটিকে কীভাবে দেখছেন?

মির্জ্জা আজিজ : বর্তমানে সরকারের রাজস্ব আদায় সন্তোষজনক না। ফলে চলতি অর্থবছরের যে লক্ষ্যমাত্রা, তা আদায় করা সম্ভব নয়। ফলে খরচের জন্য সরকারকে ধার করতে হয়। এখানেও দেখা যাচ্ছে, ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ নেওয়ার মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। এতে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবাহ কমছে। ফলে বিনিয়োগেও প্রভাব পড়বে। ভর্তুকি কমানোর প্রয়োজন আছে। ভর্তুকি কমানোর আগে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা বাড়ানোসহ বেশকিছু পদক্ষেপ নিতে হবে। তবে কৃষিতে ভর্তুকি অবশ্যই থাকতে হবে।

যুগান্তর : কয়েক বছরের তুলনায় এ বছরের রাজনৈতিক বাস্তবতা একটু ভিন্ন। বাংলাদেশ ইস্যুতে বিশ্বের বড় শক্তিগুলো দ্বিধাবিভক্ত। এটি অর্থনীতিতে কী ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে?

মির্জ্জা আজিজ : বড় শক্তি বলতে মূলত যুক্তরাষ্ট্রকে বোঝানো হয়। একক দেশ হিসাবে যুক্তরাষ্ট্রে আমাদের সবচেয়ে বেশি পণ্য রপ্তানি হয়। এটি আমাদের বড় বাজার। বাংলাদেশে রেমিট্যান্স আসার ক্ষেত্রেও দেশটি প্রথম সারিতে রয়েছে। তবে তারা আমাদের সঙ্গে সব ধরনের সম্পর্ক স্বাভাবিকভাবেই বজায় রেখেছে। দেশটিতে পণ্য রপ্তানিতেও বাড়তি কোনো সুবিধা নেই। প্রতিযোগিতা করেই আমরা টিকে আছি। ফলে এ মুহূর্তে এটি তেমন কোনো ঝুঁকি মনে হচ্ছে না।

যুগান্তর : গত কয়েক বছরে আর্থিক খাতে সংকটের বিষয়টি সামনে আসছে। এর মধ্যে ব্যাংকিং খাত ও শেয়ারবাজারের অবস্থা ভালো না। বর্তমানে ব্যাংক মার্জার হচ্ছে। এটি দেশের অর্থনীতিতে দীর্ঘমেয়াদে কী ধরনের বাস্তবতা তৈরি করবে?

মির্জ্জা আজিজ : এটি অবশ্যই বড় সমস্যা। দেশের ব্যাংকিং খাতে সুশাসনের অভাব। ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে আঁতাত রয়েছে। এর মানে হলো পারস্পরিক যোগাযোগের মাধ্যমে এক ব্যাংকের মালিকপক্ষ অন্য ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছে। তারাও আবার নিজেদের ব্যাংক থেকে ওই মালিকদের ঋণ দিচ্ছে। আর কোনো পক্ষই এ ঋণ পরিশোধ করছে না। এতে খেলাপি ক্রমেই বাড়ছে। এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক খেলাপি ঋণের যে হিসাব দেয়, প্রকৃতপক্ষে খেলাপি ঋণ আরও বেশি।

এক্ষেত্রে পুনঃতফশিল করা ঋণ, মামলার বিপরীতে আটকে থাকা ঋণ অন্তর্ভুক্ত করা হয় না। এছাড়াও রাজনৈতিক নেতা, ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং ঋণগৃহীতার পারস্পরিক যোগসাজশে এসব ঋণ দেওয়া হয়। এ পরিস্থিতির অবসান না হলে অদূরভবিষ্যতে ব্যাংকিং খাত নিয়ে সমস্যায় পড়তে হবে। এসব কারণে বেসরকারি খাতে প্রকৃত ঋণের প্রবাহ একেবারেই সন্তোষজনক না। অপরদিকে দেশের পুঁজিবাজার শিল্পায়নের ক্ষেত্রে মূলধনের জোগান দেওয়ার বড় মাধ্যম হয়ে উঠেনি। ফলে অর্থায়নে ব্যাংকের বড় ভূমিকা পালন করতে হবে। এক্ষেত্রে সুশাসন নিশ্চিত করা জরুরি।

যুগান্তর : আরেকটি বিষয় সামনে সমালোচনায় আসছে। দেশ থেকে টাকা পাচার বাড়ছে, সরকারও তা অস্বীকার করছে না। আওয়ামী লীগের নির্বাচনি ইশতেহারেও পাচার বন্ধের ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এরপর বন্ধ হচ্ছে না কেন? আসলে করণীয় কী?

মির্জ্জা আজিজ : বৈশ্বিক সংস্থা জিএফআই-এর (গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি) রিপোর্টে বাংলাদেশ থেকে বাণিজ্যের আড়ালে টাকা পাচারের কথা বলা হয়েছে। এগুলো চিহ্নিত করা খুব বেশি কঠিন কাজ নয়। কারণ, কোন পণ্যের কী দাম, তা অনলাইনের মাধ্যমে জানা যায়। ফলে পণ্য আমদানি-রপ্তানিতে যে ঘোষণা দেওয়া হয়, তা বাস্তবসম্মত কি না চিহ্নিত করা যায়। এক্ষেত্রে কাস্টমস কর্মকর্তারা চাইলেই পাচারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে। এটি সিদ্ধান্তের ব্যাপার।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম