উপজেলা পরিষদ নির্বাচন
মন্ত্রী-এমপিদের প্রভাব বন্ধ চায় মাঠ প্রশাসন
কাজী জেবেল
প্রকাশ: ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
কখনও সরকারি কর্মসূচির নামে আবার কখনও ব্যক্তিগত সফরে নির্বাচনি এলাকায় ঘন ঘন যাচ্ছেন অনেক মন্ত্রী-এমপি। তারা বিভিন্ন কর্মসূচির নামে পছন্দের প্রার্থীকে জেতাতে নানাভাবে প্রভাব বিস্তার করছেন। ওই প্রভাব ঠেকাতে গলদগর্ম হচ্ছেন স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা। মাঠের এমন পরিস্থিতির কথা নির্বাচন কমিশনকে জানিয়েছেন বেশ কয়েকজন বিভাগীয় কমিশনার, ডিআইজি, ডিসি এবং এসপি। তাদের মতে, মন্ত্রী-এমপিদের এমন ভূমিকায় নির্বাচনে ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড রক্ষা (সবার জন্য সমান সুযোগ) এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমন অবস্থায় নির্বাচনি মাঠে মন্ত্রী-এমপিদের প্রভাব বন্ধে নির্বাচন কমিশন থেকে পদক্ষেপ নেওয়ার অনুরোধ জানান তারা। একইসঙ্গে তাদের (মন্ত্রী-এমপি) অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে মাঠ প্রশাসন ও পুলিশ কর্মকর্তাদের যেন শাস্তিমূলক বদলি না করা হয়, সেই ব্যাপারে আশ্বাসও চান।
বৃহস্পতিবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত এক সভায় তারা এসব কথা তুলে ধরেন। তাদের আইনানুগভাবে নির্ভয়ে দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। জাতীয় সংসদের চেয়ে উপজেলা নির্বাচন আরও সুন্দরভাবে অনুষ্ঠানের নির্দেশনা দেওয়া হয়। তবে সংসদ-সদস্যদের প্রভাব বন্ধের বিষয়ে কী পদক্ষেপ নেবে তা সভায় স্পষ্ট করেনি কমিশন। বৈঠকের একাধিক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
আরও জানা গেছে, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের স্বার্থে প্রিসাইডিং ও সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তা পাশের উপজেলা থেকে নিয়োগ দেওয়ার প্রস্তাব করেছেন মাঠ প্রশাসন ও পুলিশের কর্মকর্তারা। ভোটকেন্দ্রে আনসার নিয়োগের ক্ষেত্রে পাশের ইউনিয়ন থেকে নিয়োগ এবং নির্বাচনে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে ভোট কেনাবেচার আশঙ্কা তুলে ধরে তা বন্ধে সুপারিশ করেন। নির্বাচনের দিন ভোরে ভোটকেন্দ্রে ব্যালট পৌঁছানো চ্যালেঞ্জিং উল্লেখ করে তারা নিরাপত্তা ও পরিবহণ খাতে বাড়তি অর্থ বরাদ্দের জন্য নির্বাচন কমিশনকে অনুরোধ জানান।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়ালের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত রুদ্ধদ্বার ওই সভায় জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. মোস্তাফিজুর রহমান, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সমন্বয় ও সংস্কার বিভাগের সচিব মো. মাহমুদুল হোসাইন খান, পুলিশের আইজি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনসহ বিভাগীয় কমিশনার, পুলিশ কমিশনার, ডিআইজি, ডিসি, এসপি ও আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তারা অংশ নেন।
বৈঠকের বিষয়ে সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন নির্বাচন কমিশন সচিব মো. জাহাংগীর আলম। তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলাসংক্রান্ত বিশেষ সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। নির্বাচনে মন্ত্রী-এমপিদের প্রভাব বিস্তারের বিষয়ে সভার আলোচনা প্রসঙ্গ জানতে চাইলে সচিব বলেন, আচরণবিধির প্রতিপালন যেন হয়, সেই বিষয়ে অনুরোধ জানিয়েছেন মাঠ কর্মকর্তারা। এ বিষয়ে তাদের আশ্বস্ত করে নির্বাচন কমিশন তাদের বলেছে, প্রয়োজনে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলবে।
জাহাংগীর আলম বলেন, আইনশৃঙ্খলাসংক্রান্ত বিশেষ সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই সভায় মাঠ প্রশাসনকে প্রথম নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতো নিরপেক্ষ থাকার জন্য। যেহেতু উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থী বেশি থাকা মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংখ্যা বাড়িয়ে দেওয়ার অনুরোধ করেছেন। উপজেলা ভোটে ইউনিয়ন পর্যায়ে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোতায়েনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। প্রত্যেক উপজেলায় দুই থেকে চার প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হবে। কোনো জেলায় যদি অতিরিক্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মোতায়েনের প্রয়োজন হয়, তা দেওয়ার বিষয়ে কমিশন সম্মত হয়েছে।
সচিব বলেন, জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপাররা বলেছেন যেহেতু ভোটের দিন সকালে রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে ব্যালট পেপার ভোটকেন্দ্রে যাবে, সেখানে অতিরিক্ত বরাদ্দ লাগতে পারে। কমিশন সেই বিষয়টা বিবেচনা করবে বলে আশ্বস্ত করেছে। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানরা স্বপদে থেকে উপজেলা ভোটে অংশগ্রহণ করা যাবে-উচ্চ আদালতের এমন আদেশ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এই মামলার আদেশের কপি আমরা এখনো পাইনি। যদি পাই তবে কমিশনের পক্ষ থেকে উচ্চ আদালতে আপিল করা হবে।
সিইসির বক্তব্যে সহিংসতার শঙ্কা : বৈঠক সূত্র জানায়, স্বাগত বক্তব্য দেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল। তার বক্তব্যে উপজেলা নির্বাচনে সহিংসতার আশঙ্কা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, আবেগ-অনুভূতির কারণে এ নির্বাচনে কিছুটা বিশৃঙ্খলা হতে পারে, সহিংসতা হতে পারে। এগুলো যাতে না হয়, সেদিকটা আমাদের দেখতে হবে। নির্বাচন যাতে অবাধ হয়, ভোটাররা যেন নির্বিঘ্নে এসে ভোট দিয়ে বাড়ি ফিরে যেতে পারেন সে বিষয়ে আপনাদের (প্রশাসন ও পুলিশ কর্মকর্তা) দৃষ্টি রাখতে হবে। সিইসি বলেন, নির্বাচন মানে নির্বাচন। এক্ষেত্রে আমরা ব্যর্থ হই তাহলে আমাদের গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা, যেটার দৃষ্টান্ত আপনারা ৭ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠিত করেছেন সেটাও ক্ষুণ্ন হয়ে যেতে পারে। আমরা আশা করব, আগামীতে আমাদের প্রতিটি নির্বাচন সুন্দর করতে হবে। তিনি আরও বলেন, আমরা যেন প্রতিষ্ঠিত করতে পারি যে বাংলাদেশে গণতন্ত্র আছে। আমাদের নির্বাচন নির্বাচনের মতোই হয়ে থাকে।
মন্ত্রী-এমপিদের প্রভাব : বৈঠক সূত্র জানায়, নির্বাচনের মাঠপর্যায়ের পরিস্থিতি তুলে ধরে বক্তব্য রাখেন বেশ কয়েকজন বিভাগীয় কমিশনার, ডিআইজি, ডিসি, এসপি ও আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা। সভার একপর্যায়ে চট্টগ্রাম বিভাগের একটি জেলার এসপি তার বক্তব্যে প্রথম নির্বাচনে মন্ত্রী-এমপিদের প্রভাব বিস্তারের বিষয়টি উত্থাপন করেন। তার বক্তব্যে সমর্থন জানিয়ে আরও কয়েকজন এসপি, ডিসি, ডিআইজি ও বিভাগীয় কমিশনার বক্তব্য দেন। তারা বলেন, নির্বাচন সামনে রেখে মন্ত্রী-এমপিরা নির্বাচনি এলাকায় ঘন ঘন সফর করছেন। তারা বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছেন। তারা যে ধরনের কার্যক্রম চালাচ্ছেন তা পছন্দের প্রার্থীর পক্ষে যাচ্ছেন। এ ধরনের কার্যক্রম আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুধু তাই নয়, এমপিদের পছন্দের প্রার্থীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গেলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের শাস্তিমূলক বদলিও করা হয়।
তাদের ওই বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচন কমিশনকে পদক্ষেপ নেওয়ার অনুরোধ জানান জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে শেষ করতে হলে এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশন প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারে। এমপিদের বিরুদ্ধে অনেক ক্ষেত্রে স্থানীয় প্রশাসনের ব্যবস্থা নেওয়া কঠিন হয়ে যায়। তিনি পুলিশ ও মাঠ প্রশাসনকে ইসির নির্দেশনা মেনে কাজ করার নির্দেশ দেন। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সমন্বয় ও সংস্কার বিভাগের সচিব মো. মাহমুদুল হোসাইন খান বলেন, বর্তমান প্রশাসনের কর্মকর্তারা জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করেছেন। ওই নির্বাচনের জন্য তাদের কাউকে বদলি করা হয়নি। এবারও সমস্যা হবে না। পুলিশের আইজি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন নির্বাচনি দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কোনো পুলিশ কর্মকর্তা যেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের আক্রোশের মুখে না পড়েন সেই পদক্ষেপ নিতে ইসিকে অনুরোধ জানান। তিনি বলেন, আচরণ বিধিমালা ঠিকমতো প্রতিপালন করলে নির্বাচনে সমস্যা হবে না। পুলিশ কর্মকর্তাদের উদ্দেশে আইজি বলেন, ভয়ের কিছু নেই। সর্বোচ্চ শাস্তি বদলি করবে। আরেক জায়গায় অর্থাৎ নতুন কর্মস্থলে চাকরি করবেন।
এ সময় সিইসিসহ সব কমিশনার তাদের আশস্ত করেন। তারা বলেন, বদলি কোনো শাস্তি নয়। এটা চাকরির অংশ। আপনাদের বিরুদ্ধে কোনো মহল থেকে বদলি করার জন্য কমিশনে অনুরোধ আসলে আমরা সেটি খতিয়ে দেখব। কারও কথায় আপনাদের বদলি করা হবে না। কমিশন নিজস্ব উৎস থেকে তদন্ত করবে। যদি কারও বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা না পায় তাহলে বদলি করা হবে না। আপনারা কারও কাছে মাথানত করবেন না। দায়িত্বে অটুট থাকেন। আমরা আপনাদের সব ধরনের সহায়তা দেব। এমনকি সিইসি আরও স্পষ্ট করে বলেন, নির্বাচনে চাপ থাকবে। চাপ সবার ওপরে থাকে।
অন্য উপজেলা থেকে ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা নিয়োগ : বৈঠকে অন্য উপজেলা থেকে প্রিসাইডিং ও সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়ার প্রস্তাব করেছেন বেশ কয়েকজন ডিসি ও এসপি। তারা বলেন, অনেক সময় মন্ত্রী-এমপিদের পক্ষে ভোটকেন্দ্রে প্রভাব বিস্তারে সহায়ক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন প্রিসাইডিং ও সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তারা। একই উপজেলা বা থানায় চাকরি করার কারণে মন্ত্রী-এমপি ও তাদের স্বজনদের নির্দেশনা উপেক্ষা করে চাকরি করা চ্যালেঞ্জ। কারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনারও দায়িত্বে থাকেন স্থানীয় এমপি ও তার আস্থাভাজন ব্যক্তিরা। নির্বাচনে মন্ত্রী বা এমপিদের কথা না শুনলে তাদের ওপর শাস্তির খক্ষ নেমে আসে। আবার কখনও কখনও পছন্দের প্রার্থীদের কাছ থেকে উপঢৌকন ও উৎকোচ নিয়েও তারা পক্ষাপাতমূলক কাজ করেন। তাদের এই প্রস্তাব বিবেচনা করতে নির্বাচন কমিশনকে অনুরোধ জানান পুলিশের আইজি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন। এছাড়া সভায় পার্শ্ববর্তী ইউনিয়ন থেকে আনসার মোতায়েনের প্রস্তাব দেন।
অন্য উপজেলা থেকে ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা নিয়োগের বিষয়ে প্রশ্ন তোলে নির্বাচন কমিশন। কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হয়, অন্য এলাকা থেকে আনা হলে তাদের যাতায়াত ও থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা নিয়ে জটিলতা তৈরি হবে। এছাড়া এ প্রস্তাব আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কিনা-তা দেখতে হবে।
অন্যান্য বিষয় : সকালে ব্যালট কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া নিয়ে বাড়তি খরচ দেওয়ার দাবি করেন জেলা প্রশাসকরা। একজন ডিসি বলেন, সদ্য শেষ হওয়া দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করার যে বকেয়া টাকা আছে তা দ্রুত পরিশোধ করার দাবি তোলেন। কয়েকজন জেলা প্রশাসক দুর্গম এলাকায় ম্যাজিস্ট্রেট বাড়ানোর দাবি জানান। আর যাতায়াত ব্যবস্থা খারাপ থাকায় পুলিশের বাড়তি নিরাপত্তা দেওয়ার দাবি জানান। এছাড়া মোবাইলে ভোট কেনাবেচা বন্ধ করার জন্য কমিশন মাঠ কর্মকর্তাদের সহায়তা চান। সভায় ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু করায় ডিসি-এসপিসহ সংশ্লিষ্টদের ধন্যবাদ জানায় ইসি।