Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

বিশ্ব পানি দিবস আজ

সুপেয় পানি যেন সোনার হরিণ

Icon

মতিন আব্দুল্লাহ

প্রকাশ: ২২ মার্চ ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

সুপেয় পানি যেন সোনার হরিণ

দেশের ৪১ ভাগ মানুষ সরাসরি বিশুদ্ধ পানি সেবার বাইরে রয়ে গেছে। তাদের কষ্ট করে সুপেয় পানির ব্যবস্থা করতে হয়। বাকি ৫৯ ভাগ মানুষ সুপেয় পানি সেবার আওতায় এসেছে। সরকার তথা স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণের ফলে এ সুবিধা অর্জিত হয়েছে। তবে ‘সবার জন্য সুপেয় পানি’-সরকারের এমন প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন এখনো বহুদূরের স্বপ্ন। এমন বাস্তবতায় আজ ‘শান্তির জন্য পানি’ শিরোনামে বিশ্বজুড়ে পালিত হচ্ছে পানি দিবস।

জানা যায়, জাতিসংঘের ‘জয়েন্ট মনিটরিং প্রোগ্রামের আওতায়’ ২০২২ সালে বাংলাদেশের সুপেয় পানি সরবরাহ ব্যবস্থাপনার চিত্র অনুসন্ধান করা হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) ও ইউনিসেফ এই অনুসন্ধান কাজ করে। ২০২৩ সালে এই প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। ওই প্রতিবেদনে উঠে আসে বাংলাদেশের সরবরাহকৃত পানির ৫৯ ভাগ সুপেয়। তবে সরবরাহ করা ৪১ ভাগ এখনো সুপেয় নয়। বিগত এক বছরে এই পরিস্থিতির তেমন কোনো উন্নতি হয়নি।

আরও জানা যায়, বাংলাদেশ ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের এক-তৃতীয়াংশ এলাকা সুপেয় পানি প্রাপ্যতার বিবেচনায় ‘হটস্পট’ হিসেবে চিহ্নিত করে রাখা হয়েছে। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে চর এলাকা, বন্যাপ্রবণ এলাকা, উপকূলীয় এলাকা, হাওড় এলাকা, বরেন্দ্র অঞ্চল ও পাহাড়ি এলাকা। দেশের এই ৬ শ্রেণির এলাকা বিস্তৃত রয়েছে ১০০টি উপজেলায়।

জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, দেশে পানি সরবরাহ প্রায় শতভাগে উন্নীত করতে সরকার সক্ষম হয়েছে। তবে উপকূল ও দুর্গম পাহাড়ি জনপদের কিছু মানুষ এখনো কষ্ট করে পানি সরবরাহ করে থাকে। এর বাইরে সবাই পানি পাচ্ছে।

তিনি জানান, এটা সত্য যে, সব পানি সুপেয় নয়। কোথাও আর্সেনিক রয়েছে। কোথাও লবণাক্ততা রয়েছে। আবার কোথাও সরবরাহ করা পানি ফুটিয়ে পান করতে হচ্ছে। এ বিষয়গুলো সরকারের দৃষ্টিতে রয়েছে। এ সমস্যাগুলো কীভাবে দ্রুত নিরসন করা যায় সে বিষয়ে সরকার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তিনি আশা করছেন, ধাপে ধাপে এই পরিস্থিতির উন্নতি ঘটবে।

তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, শিল্প-কলকারখানার অপরিশোধিত বর্জ্য নদীতে ফেলায় নদীর পানি দূষিত হচ্ছে। সেসব পানি শোধন করে সরবরাহ করলেও তা সরাসরি খেতে পারে না রাজধানীর মানুষ। এজন্য ঢাকার চারপাশের নদীর পানি সংগ্রহ কমিয়ে পদ্মা ও শীতলক্ষ্যার পানি আনতে প্রকল্প গ্রহণ করেছে সরকার। অন্যদিকে ভূগর্ভস্থ পানি বেশি পরিমাণ তোলায় প্রতিবছর পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। যে পরিমাণ পানি প্রতিবছর মাটির নিচ থেকে তোলা হচ্ছে, বর্ষার মৌসুমে সে পরিমাণ পানি রিচার্জ বা পূরণ হচ্ছে না। এতে করে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনও ব্যয়সাধ্য হয়ে পড়েছে। তাছাড়া ভূগর্ভস্থ পানির স্তর বেশি পরিমাণ নিচে নেমে গেলে ভূমি ধসের ঝুঁকি তৈরি করে।

এদিকে রাজধানী ঢাকার বিশুদ্ধ পানি তো একেবারে সোনার হরিণের দেখা পাওয়ার মতো বিষয়। কারণ সরবরাহ করা পানি সরাসরি পান করার কোনো সুযোগ নেই। ফুটিয়ে পান করতে হয়। চট্টগ্রাম শহরের পানি লবণাক্ততায় বিষিয়ে তুলেছে ওই এলাকার জনজীবন। রাজশাহীর পানিতে ময়লা ও দুর্গন্ধ পাওয়া যায়। খুলনায় সরবরাহ করা ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টের পানি না ফুটিয়ে পান করা যায় না। রয়েছে লবণাক্ততাও। গভীর নলকূপের পানিও নিরাপদ নয়, দেশে বিভিন্ন্ন স্থানে রয়েছে আর্সেনিক ও লবণাক্ততার প্রভাব। ফলে সেখানেও সরাসরি নলকূপের পানি পান করা দুষ্কর। সরকারের পানি ব্যবস্থাপনার দুর্বলতায় মিষ্টি পানিসমৃদ্ধ বাংলাদেশেও সুপেয় পানি দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠেছে। দেশের এক-তৃতীয়াংশ এলাকার মানুষ সুপ্রেয় পানির বড় ঝুঁকিতে রয়েছে। খরার মৌসুমে সুপেয় পানির জন্য হাহাকার শুরু হয়। হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে প্রকল্প বাস্তবায়ন করেও নিরাপদ পানি মিলছে না।

ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাওয়ায় ঝুঁকি বাড়ছে : ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরতা বাড়ায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর দ্রুত নিচে নেমে যাচ্ছে। যে হারে পানির স্তর নিচে নামছে, সে হারে পানির স্তর পূরণ হচ্ছে না। এ কারণে ভূগর্ভস্থ উৎস থেকে পানি পেতে অনেক গভীরে যেতে হচ্ছে। স্বাভাবিক অবস্থা ৬ থেকে ৭ ফুট নিচে ভূগর্ভস্থ উৎসে পানি পাওয়ার কথা। কিন্তু সে অবস্থা এখন আর নেই। ঢাকায় পানি পেতে ২৫৫ থেকে ২৬০ মিটার নিচে নামতে হচ্ছে। খুলনায় ভূগর্ভস্থ পানি নেমে গেছে ২৫ থেকে ৩০ ফুট। রাজশাহী ও বরেন্দ্র অঞ্চলে পানির স্তর ১২০ থেকে ১৪০ ফুট নিচে নেমে গেছে। খরার মৌসুমে এই অবস্থা থাকে। বর্ষার মৌসুমে পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতি হয়। ভূ-উপরিস্থ উৎস থেকে চট্টগ্রামের পানির চাহিদা মিটিয়ে সেখানকার ভূগর্ভস্থ পানির উৎসের লাগাম টেনে ধরতে পেরেছে সরকার।

অন্যদিকে দেশের প্রায় ৭৫ শতাংশ এলাকার ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ২ থেকে ৩ মিটার নেমে যায়। আর ২৫ ভাগ এলাকায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ৫ থেকে ১০ মিটার নেমে যায়। বর্ষার মৌসুমে এসব এলাকার বেশির ভাগ অংশে পানির ভূগর্ভস্থ স্তর স্বাভাবিক পর্যায়ে চলে আসে। তবে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, রাজশাহীর বরেন্দ্র অঞ্চল ও দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের কিছু এলাকায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর স্বাভাবিক পর্যায়ে আসে না। দেশের গৃহস্থালি ও খাবার পানির ৯৪ শতাংশ চাহিদা পূরণ হচ্ছে ভূগর্ভস্থ উৎস থেকে। গ্রাম এলাকায় এই উৎস থেকে ৯৯ শতাংশ ও শহর এলাকায় ৮০ শতাংশ পানি সরবরাহ করা হয়। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় ১৮ শতাংশ নলকূপের পানি উত্তোলনে সমস্যা হয়। এছাড়া ফারাক্কা বাঁধের কারণে পদ্মা, মধুমতী, আড়িয়াল খাঁ, গড়াই নদীর পানি কমে যাওয়ায় এসব এলাকার ভূগর্ভস্থ পানির স্তর পুনঃভরণ হয় না। ভূ-উপরিস্থ সুপেয় পানির উৎসের অভাবে খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, যশোর অঞ্চলে সারা বছর সুপেয় পানির সংকট থাকে। খুলনা, ঝালকাঠি, বরিশাল, পিরোজপুরের উপকূলীয় এলাকার মানুষকে ১০ থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে গিয়ে পানি সংগ্রহ করে আনতে হয়। খরার মৌসুমে রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ, নাটোর, রংপুর, দিনাজপুর, বগুড়া, পাবনার নলকূপগুলোতে পানি পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়ে। বর্ষার মৌসুমে দেশের অন্যান্য এলাকার ভূগর্ভস্থ পানির শূন্য স্তরের ২৫ শতাংশ পূরণ হয়ে যায়। তবে বরেন্দ্র অঞ্চলে মাত্র ৮ শতাংশ পূরণ হয়। ওইসব এলাকায় ১৬০ ফুটের আগে পানির দেখা মিলছে না। ঢাকায় ২১২ ফুট নিচে গেলে পানির দেখা মিলছে।

বিশেষজ্ঞ অভিমত : বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের ভূগর্ভস্থ পানি বিভাগের পরিচালক পানি বিশেষজ্ঞ ড. আনোয়ার জাহিদ যুগান্তরকে বলেন, পানির অপরিকল্পিত ব্যবহারে সুপেয় পানির গুণগত মান ও পরিমাণের সংকট তৈরি হচ্ছে। টেকসই ব্যবহার ও ব্যবস্থাপনা করতে না পারলে সামনে আমাদের সুপেয় পানির জন্য আরও ভুগতে হবে।

তিনি বলেন, ভূগর্ভস্থ পানির স্তরও যে হারে নেমে যাচ্ছে, সে হারে পানির স্তর পূরণ হচ্ছে না। এজন্য সরকারকে কৃত্রিমভাবে বর্ষার মৌসুমে পানি মাটির নিচে প্রবেশের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। সরকার সেসব নিয়ে চিন্তা করছে। ইতোমধ্যে ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী ও বরেন্দ্র অঞ্চলে সরকার ভূ-উপরিস্থ উৎসের পান ব্যবহারে প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এই উদ্যোগগুলো আরও বাড়াতে হবে।

ওয়াটার এইড বাংলাদেশের হেড অব টেকনিক্যাল সার্ভিসেস মো. তাহমিদুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, সরকার দেশের প্রায় শতভাগ মানুষকে পানি সরবরাহের আওতায় নিয়ে এসেছে। তবে সে পানির ৫৯ ভাগ সুপেয়ম বাকি ৪১ ভাগ সুপেয় নয়। সরকারকে সবার জন্য সুপেয় পানি নিশ্চিতে কাজ করতে হবে। আর ২০১৮ সালের পানি বিধিমালায় সুপেয় পানি মানুষের প্রয়োজন পূরণের পর অন্য কাজে ব্যবহার করার নির্দেশনা দেওয়া রয়েছে। কিন্তু এই নির্দেশনা অনুসরণ না করায় সুপেয় পানির সংকট তৈরি হচ্ছে।

তিনি জানান, এবার বিশ্ব পানি দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় ‘শান্তির জন্য পানি।’ এ বছর সারা বিশ্বে নদ-নদীর পানিবণ্টন নিয়ে বিশ্বজুড়ে যে দ্বন্দ্ব চলছে, সে বিষয়কে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। চলতি বছরজুড়ে হয়তো এ বিষয়গুলো সারা বিশ্বে প্রাধান্য পাবে। বাংলাদেশও অমীমাংসিত ইস্যুতে নিয়ে হয়তো তৎপরতা বাড়াবে।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম