Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

আগুন ও বিস্ফোরণ ঘটনার বিচার

পার পায় প্রভাবশালীরা ধরা পড়ে চুনোপুঁটি

Icon

মাহমুদুল হাসান নয়ন

প্রকাশ: ০৫ মার্চ ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

পার পায় প্রভাবশালীরা ধরা পড়ে চুনোপুঁটি

দেশে অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণ ঘটনার দায় চিহ্নিত করার সংস্কৃতি গড়ে ওঠেনি। ফলে অবহেলাজনিত মৃত্যু ও সম্পদহানির নেপথ্যে থাকা ব্যক্তিদের প্রকৃত নাম বেরিয়ে আসছে না। আলোচিত ঘটনাগুলোয় মামলা হলেও অধিকাংশ আগুনের ঘটনায় মামলাও হয় না। যেসব ঘটনায় মামলা হয়েছে, সেগুলোর তদন্তেও তদারকি সংস্থাগুলোর দায়ী ব্যক্তিদের নাম আসছে না। অল্পকিছু ঘটনায় ভবন কিংবা প্রতিষ্ঠানের মালিকদের আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। তবে বেশির ভাগ ঘটনায় গ্রেফতার হচ্ছেন এসব জায়গায় কর্মরত বেতনভুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। অথচ ভবন ও প্রতিষ্ঠান নির্মাণের প্রতিটি ধাপে মূল দায় থাকে মালিক ও তদারকসংশ্লিষ্টদের। আবার যারা গ্রেফতার হচ্ছেন, সাক্ষী হাজির না হওয়াসহ নানা কারণে ঝুলে আছে তাদের বিচার। ঢাকার বড় আটটি অগ্নিদুর্ঘটনা বিশ্লেষণ করে মিলেছে এমন তথ্য।

২০১০ সালে নিমতলীতে রাসায়নিক গুদামে আগুনে মৃত্যু হয় ১২৬ জনের। এ ঘটনায় আহত হন আরও অর্ধশতাধিক। পুড়ে যায় ২৩টি বসতবাড়ি, দোকান ও কারখানা। এ ঘটনায় কোনো মামলা না হওয়ায় তদন্তও হয়নি। তাছাড়া বিভিন্ন সংস্থার এ ঘটনার তদন্তে বেশকিছু সুপারিশ উঠে আসে। তবে তদারকি সংস্থার জড়িতরা থেকে যান ধরাছোঁয়ার বাইরে। এতে প্রকৃত অপরাধীরা রয়ে যান আড়ালে। সর্বশেষ রাজধানীর বেইলি রোডে আগুনের ঘটনায় রমনা থানায় দায়ের করা মামলায়ও তদারকি সংস্থার গাফিলতির বিষয়গুলোর উল্লেখ নেই। তাদের কাউকে আসামিও করা হয়নি। এমনকি এখনো ভবনটির প্রকৃত মালিক গ্রেফতার হননি। অবৈধ ফ্লোরে ফায়ার লাইসেন্স প্রদান ও গ্যাস সংযোগ দেওয়ায় জড়িতরাও থেকে গেছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। যদিও ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার হাবিবুর রহমান ঘোষণা দিয়েছেন, যাদের অবহেলায় এ ঘটনা ঘটেছে, তাদের প্রত্যেককেই আইনের আওতায় আনা হবে।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. এএসএম মাকসুদ কামাল যুগান্তরকে বলেন, রাজউকের অকুপেন্সি সার্টিফিকেট (ভবন ব্যবহারের অনুমোদনপত্র) অনুযায়ী যদি কোনো ভবন ব্যবহার হয়, তাহলে আগুন লাগার কোনো কারণই থাকে না। এখন অকুপেন্সি সার্টিফিকেট যে মানছে না, সেই তদারকির দায়িত্ব ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স এবং রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক)। এক্ষেত্রে তদারকি কর্তৃপক্ষকে যদি সক্রিয় না করা যায়, তাহলে শুধু কর্মচারী কিংবা ভবন মালিকদের ধরেও খুব বেশি লাভ নেই। কারণ, মালিকরা তো চাইবেই ভবন থেকে যেন বেশি পরিমাণে উপার্জন আসে। তদারকি সংস্থাগুলোকে রাখাই হয়েছে এ অব্যবস্থাপনাগুলো নিয়ন্ত্রণ করার জন্য। এজন্য তদারকি সংস্থাগুলোর সংশ্লিষ্টদের দায় চিহ্নিত করে সাজার আওতায় আনা না গেলে তাদের মধ্যে দক্ষ ও স্বচ্ছ হওয়ার তাগিদ এবং প্রকৃত সেবা পাওয়া কোনোটিই নিশ্চিত করা যাবে না। এতে অগ্নিঝুঁকির বর্তমান ভয়াবহ পরিস্থিতির উন্নতি হবে না।

২০১২ সালে আশুলিয়ার তাজরিন ফ্যাশনে অগ্নিকাণ্ডে ১১৭ জন, ২০১৯ সালে চকবাজারের চুড়িহাট্টায় ৭১ জন এবং ২০১৯ সালে বনানীর এফআর টাওয়ারে ২৬ জনের মৃত্যু হয়। কেরানীগঞ্জের চুনকুটিয়ায় প্রাইম প্লাস্টিক কারখানায় ১৭ জন মারা যান। ২০২১ সালে মগবাজারে একটি দোকানে বিস্ফোরণের ঘটনায় আগুনে ১২ জন মারা যান। এসব ঘটনায় মামলা হলেও বিচার শেষ হয়নি। যার প্রধান কারণ সাক্ষী হাজির করতে না পারা। এছাড়াও গত বছরের ৭ মার্চ সিদ্দিকবাজারে কুইন স্যানিটারি মার্কেটে বিস্ফোরণে ২৬ জনের মৃত্যু হয়। 
একই বছরের ৪ এপ্রিল বঙ্গবাজার এলাকার চারটি মার্কেটে আগুন লাগে। এতে এক হাজার কোটি টাকারও বেশি ক্ষতি হয়। তবে বনানীর এফআর টাওয়ারের ঘটনা ছাড়া কোনো ঘটনায়ই দায়ী সব ব্যক্তি চিহ্নিত হয়নি। যে একটি ঘটনায় চিহ্নিত হয়েছে, তাদের সবার বিরুদ্ধেও পরে আর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এসব ঘটনায় তদারকির ঘাটতি ছিল রাজউক, ফায়ার সার্ভিস, সিটি করপোরেশন, তিতাস, বিস্ফোরক পরিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর। বেশির ভাগ সময়েই নোটিশ দিয়ে তারা দায় সেরেছে। কোনো কোনো সময় নোটিশ কিংবা চিঠিও দেয়নি। ভবনগুলোর অগ্নিঝুঁকিসহ নিরাপত্তার অন্য দিকগুলো নিয়মিত পরিদর্শনের কথা থাকলেও তাও করেনি তারা। উলটো এসব কাজে বৈধতা দেওয়ার জন্য নানা উদ্যোগ নিয়েছে। ফলে যখন কোনো বড় দুর্ঘটনা ঘটছে, তখন তারা দায় এড়িয়ে চলার চেষ্টা করেন।

সিদ্দিকবাজারে বিস্ফোরণের পর জানা যায়, রাজউকের অনুমোদন ছাড়াই সাততলা ভবনটির উপরের দুই তলা করা হয়েছে। এখানে তিতাসের অবৈধ গ্যাস সংযোগের তথ্যও মিলেছে। বঙ্গবাজারে আগুনের ঘটনার বহু আগেই এটিকে ঝুঁকিপূর্ণ উল্লেখ করে ব্যানার টানিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ব্যবস্থা গ্রহণে মার্কেট কর্তৃপক্ষ এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনকে দফায় দফায় চিঠি দিয়েছিল ফায়ার সার্ভিস। মগবাজারের বিস্ফোরণের পরও তিতাসের অবৈধ গ্যাস সংযোগের বিষয়টি উঠে আসে। অথচ এসব ঘটনার কোনোটিতেই তদারকিতে থাকা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। বরং সংস্থাগুলো তাদের তদন্তে নিজ সংস্থার দায় এড়ানোর চেষ্টা করেছে। বনানীর এফআর টাওয়ারে আগুনের ঘটনা তদন্ত করে ৬২ জনের বিরুদ্ধে প্রতিবেদন দেওয়া হলেও তাদের সবার বিরুদ্ধে মামলা হয়নি।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. এএসএম মাকসুদ কামাল যুগান্তরকে আরও বলেন, আসলে তদারকি কর্তৃপক্ষগুলোর যে ধরনের মনিটরিং করার কথা, তারা সেটি করতে সক্ষম নয়। এর মূল কারণ তাদের জনবলের অভাব। পাশাপাশি স্বচ্ছতা এবং দক্ষতা দুটোরই অভাব আছে। যদি এ সমস্যা নিরসন করে মনিটরিং প্রক্রিয়াকে পুরোপুরি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া যায়, তাহলে এই অগ্নিকাণ্ডের ক্ষয়ক্ষতি বন্ধ করা যাবে। একটি ভবনের নকশা দেওয়ার পর এর ব্যবহার কী হবে-অকুপেন্সি সার্টিফিকেটের মাধ্যমে সেটিও নির্ধারণ করা থাকে। কিন্তু যেভাবে ভবন ব্যবহারের অনুমোদন নেওয়া হয়, পরে সেটি সেভাবে ব্যবহার হয় না। 

অকুপেন্সি সার্টিফিকেট অনুযায়ী ভবনের ব্যবহার না হওয়ার কারণেই এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে। দুর্ঘটনা ঘটতেই পারে। কিন্তু অকুপেন্সি সার্টিফিকেট অনুযায়ী ভবনের ব্যবহার হলে সেটি ভয়াবহ রূপ ধারণ করে না। এজন্য জবাবদিহির সংস্কৃতি গড়ে তোলা জরুরি। এসব ঘটনায় দায়ের মামলাগুলো নিষ্পত্তিতেও সংশ্লিষ্টদের জোরালো ভূমিকা প্রয়োজন।

ভবনের ম্যানেজারসহ ৪ জন রিমান্ড শেষে কারাগারে : গ্রিন কোজি কটেজ নামের ভবনে আগুনে ৪৬ জনের প্রাণহানির ঘটনায় পুলিশের করা মামলায় চারজনকে রিমান্ড শেষে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দিয়েছেন আদালত।

তারা হলেন-ভবনের চুমুক রেস্টুরেন্টের দুই মালিক আনোয়ারুল হক, শফিকুর রহমান রিমন, কাচ্চি ভাই রেস্টুরেন্টের ম্যানেজার জয়নুদ্দিন জিসান, ভবনের ম্যানেজার মুন্সি হামিমুল আলম বিপুল।

সোমবার ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট তাহমিনা হক আসামিদের কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। এদিন দুদিনের রিমান্ড শেষে তাদের আদালতে হাজির করে পুলিশ।
 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম