অর্থনীতিবিদদের প্রতিক্রিয়া
বিদ্যুতের নতুন দামে ভয়ংকর রূপ নেবে মূল্যস্ফীতি
ফেব্রুয়ারি থেকেই নতুন দাম কার্যকর * অদক্ষতায় বারবার দাম বাড়ানো হচ্ছে * সবকিছুর উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাবে -ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম * বাজার পরিস্থিতি নাগালের বাইরে -ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ০১ মার্চ ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বাজার পরিস্থিতি এমনিতেই মানুষের নাগালের বাইরে। এরপর ডলার সংকটে প্রয়োজনীয় নিত্যপণ্য আমদানি করা যাচ্ছে না। এ অবস্থায় গ্যাস-বিদ্যুতের দাম আরও বাড়ানো হলে মূল্যস্ফীতি হবে ভয়াবহ।
সব ধরনের পণ্যের উৎপাদন খরচ বাড়বে। কারণ জ্বালানি এমন একটি খাত, যার মূল্য বৃদ্ধি সবকিছুর ওপর প্রভাব ফেলে। যুগান্তরের সঙ্গে আলাপকালে দেশের শীর্ষস্থানীয় অর্থনীতিবিদরা এসব মন্তব্য করেন। বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছেন-সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ।
তাদের মতে, অদক্ষতার কারণে এভাবে বারবার বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হচ্ছে। এক্ষেত্রে জনগণের ভোগান্তিকে আমলে নেওয়া হচ্ছে না। এছাড়াও কুইক রেন্টাল এখনো চালু রাখার কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই। সামগ্রিকভাবে জ্বালানি নিয়ে বাংলাদেশ রাজনীতির শিকার।
জানা গেছে, বিদ্যুতের দাম খুচরা পর্যায়ে ৮ দশমিক ৫০ শতাংশ ও পাইকারি পর্যায়ে ৫ দশমিক ০৭৪ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। নিচের দিকে ইউনিট প্রতি বিদ্যুতের দাম ৩৪ পয়সা এবং উপরের দিকে ৭০ পয়সা বাড়বে। অর্থাৎ নিচের দিকে ৫ শতাংশ বাড়বে। উপরের দিকে সাড়ে ৮ শতাংশের মতো। নতুন দাম ফেব্রুয়ারি থেকেই কার্যকর হয়েছে।
দাম বাড়িয়ে বৃহস্পতিবারই গেজেট জারি করে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়। এ ব্যাপারে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের বলেন, ডলারের কারণে ভর্তুকি বাড়ছে। গ্যাসের দামও ঊর্ধ্বমুখী। যে কারণে দাম সমন্বয়ে যেতে হবে। অর্থাৎ বাজারের সঙ্গে জ্বালানির দাম সমন্বয় করতে হবে।
জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বৃহস্পতিবার যুগান্তরকে বলেন, বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির ফলে মূল্যস্ফীতিতে বড় ধরনের প্রভাব পড়বে। সবকিছুর উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাবে। কারণ উৎপাদনের সঙ্গে জ্বালানি জড়িত। তিনি বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, জ্বালানিতে ভর্তুকি বেড়ে যাচ্ছে। এটি সমন্বয় দরকার। কিন্তু বিদ্যুতের বড় আকারে অবৈধ সংযোগ রয়েছে। এ সংযোগগুলো বন্ধ করা হচ্ছে না। কেন করা হচ্ছে না, এটি সরকার ভালো জানে। এছাড়াও এ খাতে দুর্নীতি রয়েছে।
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এখনো কুইক রেন্টালের কী প্রয়োজন আছে আমি জানি না। এটি নিয়ে দীর্ঘদিন থেকে অনেক কথাবার্তা আছে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, বিদ্যুতের উৎপাদন বেড়েছে। আমাদের বিপুল পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়। কিন্তু এরপর কুইক রেন্টাল বন্ধ করা হচ্ছে না। অযথাই এগুলো বসিয়ে ক্যাপাসিটি চার্জ দেওয়া হচ্ছে। কেন এটি করা হচ্ছে তা আমার বুঝে আসে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, অদক্ষতা-অব্যবস্থাপনার কারণেই বারবার জ্বালানির দাম বাড়ানো হচ্ছে। রেন্টাল-কুইক রেন্টালের বিদ্যুৎ অর্থনীতির বড় ক্ষতি করেছে। তিনি বলেন, জ্বালানি এমন একটি খাত, যার প্রভাব সব কিছুর ওপরই পড়ে। অনেক কারখানা মাসে কোটি টাকা বিদ্যুৎ বিল দেয়। জ্বালানির অতিরিক্ত টাকা উৎপাদন ব্যয়ের সঙ্গে সমন্বয় করতে হয়। বাজার পরিস্থিতি মানুষের এমনিতেই নাগালের বাইরে।
বিদ্যুতের দাম বাড়ালে মূল্যস্ফীতি ভয়াবহ হবে। দ্বিতীয়ত, জ্বালানির দাম বৃদ্ধির আসল সুবিধা পাচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগীরা। নানা পক্ষ এখানে জড়িত। জরুরি ভিত্তিতে রেন্টাল-কুইক রেন্টাল প্ল্যান্ট করা হলো। এখন এর বেশিরভাগ বন্ধ রয়েছে। চালু থাকলেও জ্বালানি অপচয় হচ্ছে। ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হচ্ছে। তার মতে, অদক্ষ-অব্যবস্থাপনা জ্বালানি খাতের মূল সমস্যা।’
আমাদের গ্যাস অত্যন্ত উন্নতমানের। তার ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারিনি। তিনি বলেন, সরকার জ্বালানি নিয়ে কোনো নীতি গ্রহণ না করলেও সমালোচনা ঠেকাতে নানা আইন করছে। দায়মুক্তি অধ্যাদেশ জারি করে রেখেছে।
রেন্টাল-কুইক রেন্টাল সম্পর্কে তিনি আরও বলেন, ‘সরকার সব জানার পরেও কিছু ব্যক্তিকে জ্বালানি খাতের মাধ্যমে সহজে টাকা পাইয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করে দিল। এতে দেশের কোনো লাভ হয়নি। বরং রেন্টাল-কুইক রেন্টাল অর্থনীতির বড় ক্ষতি করেছে। পাশের দেশ ভারত ও মিয়ানমার বিদ্যুতে সফল। আমাদের গ্যাসের সন্ধান এবং ব্যবহার করতে পারলে দাম বাড়ানোর দরকার ছিল না।’ তার মতে, জনগণের কাছে সরকার কোনো জবাবদিহিতার প্রয়োজন বোধ করে না।
তিনি বলেন, এই সরকার দীর্ঘদিন ক্ষমতায়। তারা জ্বালানি নিয়ে সঠিক পলিসি গ্রহণ করতে পারত। তা না করে জনগণকে জিম্মি করে গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়াচ্ছে। সরকার যা ইচ্ছা তাই করছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক এ গভর্নর বলেন, জ্বালানির অতিরিক্ত মূল্য পরিশোধ করতে গিয়ে ডলার সংকট সৃষ্টি হয়েছে। সামনে ডলার সংকটের আরও কী পরিস্থিতি হবে তা বলা মুশকিল।
ড. সালেহউদ্দিন বলেন, অব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে। এটি একদিন গলার কাঁটা হবে। তখন পুরোপুরি আমদানির দিকেই যেতে হবে। আবার যাদের কাছ থেকে আমদানি করা হবে, সেখানে রাজনীতি আছে। এই রাজনীতি তো বাংলাদেশের জন্য টেকসই নয়। অর্থনীতির ওপর রাজনীতি চেপে বসলে কোনোভাবেই সুফল বয়ে আনে না। তার মতে, বাংলাদেশ সরকার কয়লা আমদানি করছে ভারতের আদানি গ্রুপের কাছ থেকে। আদানি ভারতেই বিতর্কিত। সেই আদানিকে ব্যবসা পাইয়ে দিয়েছেন নরেন্দ্র মোদি। সবই রাজনীতি। আমরা এমন রাজনীতির শিকার।