দখল-চাঁদাবাজিতে অতিষ্ঠ এলাকাবাসী
তুরাগের ত্রাস যুবলীগ নেতা নাজমুল
স্থানীয় কাঁচাবাজার, অবৈধ বালুর গদি, খেয়াঘাট ও বিআইডব্লিউটিএ’র ল্যান্ডিং স্টেশন নাজমুল গংয়ের নিয়ন্ত্রণে * মাদক মামলার সাজা থেকে বাঁচতে আয়নাবাজির গোমর ফাঁস
তোহুর আহমদ
প্রকাশ: ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বাজার, রাস্তা, জলাশয় বা আবাদি জমি-কোনোকিছুই বাদ নেই; সব জায়গায় ঝুলছে ‘দখলের সাইনবোর্ড’। ‘জমির মালিক মো. নাজমুল হাসান, পিতা মৃত আবুল হাসিম (চেয়ারম্যান)’-রাজধানীর উপকণ্ঠে তুরাগ এলাকায় ঢুকলে এমন অসংখ্য সাইনবোর্ড চোখে পড়ে।
শুধু জমি দখল নয়-চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসাসহ অসংখ্য অভিযোগ কথিত যুবলীগ নেতা নাজমুলের বিরুদ্ধে। এসব নিয়ে তার বিরুদ্ধে মামলার সংখ্যা অর্ধডজনেরও বেশি। এরপরও সরকারদলীয় নেতা পরিচয়ে তুরাগের বিস্তীর্ণ এলাকায় রীতিমতো রামরাজত্ব চলছে তার।
চাঁদাবাজি : উত্তরা ১০ নম্বর সেক্টরসংলগ্ন কামারপাড়া এলাকার বিশাল কাঁচাবাজার নাজমুলের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণে। এখানে আড়ত বা টং দোকানের সংখ্যা ৬শরও বেশি। প্রতি দোকানে নির্ধারিত চাঁদার হার দৈনিক ৬০০ টাকা। এছাড়া বাজারে পণ্যবোঝাই ট্রাক ঢুকলে খালাসের আগেই দিতে হয় ৫৫০ টাকা। এর বাইরে ভ্যানগাড়ি প্রতি চাঁদা ১০০ টাকা।
রোববার দুপুরে সরেজমিন দেখা যায়, টিনশেডের বাজার। নাম তুরাগ সুপার মার্কেট, কামারপাড়া বাঁশপট্টি, সেক্টর ১০। বিভিন্ন দোকানে শাকসবজির স্তূপ। আড়ত ঘিরে কুলি-মিনতিদের হাঁকডাক। ব্যবসায়ীরা জানান, বাজারের মালিক নাজমুল হাসান। দোকান ভাড়া হিসাবে দৈনিক ভিত্তিতে টাকা নিয়ে যায় নাজমুলের লোকজন। আশপাশের কয়েকটি বাঁশের খুঁটিতে রাজনৈতিক ফেস্টুন দেখা যায়। এতে বড় হরফে লেখা-‘নাজমুল হাসানের পক্ষ থেকে সকলকে জানাই ইংরেজি নববর্ষের শুভেচ্ছ। তুরাগ থানা যুবলীগ।’
স্থানীয়রা জানান, বছর তিনেক আগে হঠাৎ করেই জমি দখল করে এখানে বাজার বসায় নাজমুলের লোকজন। পরে নাজমুলের বাবার নামে বাজারের একাংশের নাম দেওয়া হয় আবুল হাসিম চেয়ারম্যান কাঁচাবাজার। এ সময় পরিত্যক্ত জায়গা ও রাজউকের কয়েকটি প্লট ছাড়াও স্থানীয় কয়েকজনের জমি বেদখল হয়। এর মধ্যে স্থানীয় আব্দুর রাজ্জাক (সাবেক ইউপি মেম্বার), মানিক মিয়া, আশরাফ আলী অন্যতম। বর্তমানে বাজারসংলগ্ন ১০ নম্বর সেক্টরের রাস্তাও দখল করা হয়েছে। রাস্তার দুপাশে গজিয়ে উঠেছে অবৈধ কাঠের আড়ত। এছাড়া মিনিবাস ও টেম্পোস্ট্যান্ড বসিয়ে ভাড়া দিয়েছে নাজমুলের লোকজন।
স্থানীয়রা বলছেন, শুধু কাঁচাবাজার নয়, তুরাগের বিস্তীর্ণ এলাকায় চাঁদাবাজি চলে নাজমুলবাহিনীর নামে। এর মধ্যে কামারপাড়া, নলভোগ, পুরান কালিয়া, রানাভোলা, ধউর ও ১১ নম্বর সেক্টরে নাজমুলের অস্ত্রধারী বাহিনীর তৎপরতা ব্যাপক। ধউর বেড়িবাঁধ এলাকায় অবৈধ বালুর গদি, বিআইডব্লিউটিএ-এর ল্যান্ডিং স্টেশন এবং দিয়াবাড়ী মেট্রোরেল স্টেশনের নিচে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা থেকে নিয়মিত চাঁদা আদায় করা হয়। বিস্তীর্ণ এলাকায় প্রতিমাসে এভাবে আদায়কৃত চাঁদার অঙ্ক বিশাল।
জানা যায়, উত্তরা ১১ নম্বর সেক্টরে রাজউকের একাধিক প্লট দীর্ঘদিন ধরে নাজমুলের দখলে। বর্তমানে সেখানে অবৈধ ফার্নিচার মার্কেট তৈরি করে ভাড়া দেওয়া হয়েছে। এছাড়া তুরাগের সাউদার্ন ও আইএফএল নামের দুটি বৃহৎ গার্মেন্ট প্রতিষ্ঠান নাজমুলবাহিনীর হাতে রীতিমতো জিম্মি। গার্মেন্টের জুট থেকে শুরু করে অনেক কিছুই বিনাবাক্যে তুলে দিতে হয় নাজমুলবাহিনীর হাতে।
দখল : কামারপাড়া কবরস্থান রোডে পরপর কয়েকটি জমিতে নাজমুলের সাইনবোর্ড দেখা যায়। একটিতে লেখা ‘খরিদ সূত্রে এই জমির মালিক মো. নাজমুল হাসান। জমির পরিমাণ ১৬ দশমিক ৫০ শতাংশ। ভাটুলিয়া মৌজা।’ অপরটিতে লেখা ‘চুক্তিনামা দলিলমূলে জমির বর্তমান মালিক নাজমুল হাসান। পিতা মৃত আবুল হাসিম। জমির পরিমাণ ১০৩৫ অজুতাংশ। কামারপাড়া মৌজা।’ পাশেই আরেকটি সাইনবোর্ডে লেখা ‘ক্রয়সূত্রে জমির মালিক নাজমুল হাসান। জমির পরিমাণ ৮২০ অজুতাংশ।’
স্থানীয়রা বলছেন, এসব জমির বেশির ভাগই দখল অথবা অস্ত্রের মুখে লিখে নেওয়া। শুধু তুরাগ নয়, আশুলিয়া ও গাজীপুর এলাকার বহু জমিতে এমন সাইনবোর্ড ভূরিভূরি। এছাড়া তার পরিবারের অন্য সদস্যদের নামে-বেনামে দখল হয়েছে আশপাশের বিপুল ভূসম্পত্তি। এর মধ্যে কবরস্থান রোডে ভাই ভাই মার্কেট, রানাভোলা রোডে তাসলিমা মার্কেট, তাসলিমা প্লাজাসহ আশপাশের কয়েকশ বিঘা সম্পত্তি নাকি নাজমুলের পৈতৃক সম্পত্তি। এছাড়া ধউর এলাকার ইস্টওয়েস্ট মেডিকেল সংলগ্ন শতকোটি টাকা মূল্যের বিশাল জায়গা এবং উত্তরণ আবাসিক এলাকার পেছনে বিশাল জলাশয়ও নাকি কিনেছেন তার বাবা হাসিম চেয়ারম্যান। তবে এলাকাবাসী বলছেন, দখল জমির অনেকাংশ ভাওয়াল এস্টেটের আওতাভুক্ত। এছাড়া হতদরিদ্র অনেকের জমি লিখে নেওয়া হয় অস্ত্রের মুখে।
এলাকায় ঘুরে দেখা যায়, তুরাগের রোসাদিয়া ঘাট ও তালতলা গুদারাঘাট চলে নাজমুলের চাচাতো ভাই আরিফ হাসানের নামে। এ সুযোগে ঘাট ও আশপাশের এলাকায় সারি সারি টিনের ঘর, টং দোকান ও অবৈধ বাস-ট্রাকস্ট্যান্ড গড়ে তোলা হয়েছে। এছাড়া নাগেরটেক এলাকায় অবৈধ ব্যাটারি কারখানা গড়ে তুলেছেন নাজমুল। সেখানে পুরোনো ব্যাটারি ভাঙায় ক্ষতিকর পারদ ছড়িয়ে পড়ছে আশপাশের জলাশয়ে। এ নিয়ে মামলা করেছে পরিবেশ অধিদপ্তর। এছাড়া খায়েরেরটেক এলাকায় সরকারি জমিতে শতাধিক বস্তিঘর তুলে ভাড়া দিয়েছেন নাজমুলের লোকজন।
আয়নাবাজি : সম্প্রতি এক মাদক মামলায় নাজমুলকে ৭ বছর কারাদণ্ড দেন আদালত। কিন্তু সাজা থেকে বাঁচতে অভিনব কৌশল নেন তিনি। আলোচিত আয়নাবাজি সিনেমার মতোই নাজমুল সাজিয়ে কারাগারে পাঠানো হয় ডামি আসামি। এ সময় মোটা অঙ্কের অর্থের প্রলোভনে নাজমুলের হয়ে জেল খাটেন মিরাজুল নামের হতদরিদ্র এক যুবক। ১১ দিন জেল খেটে ২০ আগস্ট জামিনে কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে বের হন মিরাজুল। কিন্তু চুক্তি অনুযায়ী টাকা না পেলে ঘটনা ফাঁস করে দেন তিনি। এ ঘটনায় এখন এলাকায় তোলপাড় চলছে।
নাজমুলের বদলে চুক্তিতে কারাভোগ প্রসঙ্গে গণমাধ্যমে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মিরাজুল বলেন, ‘সে (নাজমুল) বলছিল আমাকে বাড়িগাড়ি কইর্যা দিব। আমার লাইফ সেট কইর্যা দিব। বিনিময়ে তার জন্য আমাকে জেল খাটতে হবে। কিন্তু অহন এর কিছুই দেয় না।’ কান্নাজড়িত কণ্ঠে মিরাজুল বলেন, ‘আমি দিন আনি দিন খাই। চুক্তি অনুযায়ী যা দেওয়ার কথা ছিল তা না দিয়া আমাকে এক লাখ টাকা ধরাইয়া দিছে।’
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের রেকর্ডে নাজমুলের আয়ানাবাজির অকাট্য প্রমাণ রয়েছে। জেলখানার রেকর্ডবুকে আসামি হিসাবে নাজমুলের নাম ও পিতার নাম ঠিক থাকলেও ছবি রয়েছে মিরাজুলের। এছাড়া কারাগারের প্রিজনার্স (বন্দি) তথ্যভান্ডারেও রয়েছে ভিন্ন ফিঙ্গারপ্রিন্ট। সম্প্রতি আয়নাবাজির ঘটনা ফাঁস হলে গোপনে দেশ ছাড়েন নাজমুল।
সূত্র জানায়, তুরাগে নাজমুলের একচ্ছত্র দাপটের পেছনে জনৈক প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতার হাত রয়েছে। অজ্ঞাত কারণে তিনি তুরাগ এলাকায় বিপুল পরিমাণ জমি কিনেছেন। লাঠিয়াল হিসাবে এসব জমি দেখভাল করে নাজমুলের লোকজন। এজন্য দলীয় পদ পাইয়ে দিতে নাজমুলের পক্ষে তদবির করেন ওই প্রভাবশালী নেতা। এছাড়া এলাকায় আধিপত্য বিস্তারে নিজস্ব বাহিনী গড়ে তুলেছেন নাজমুল। তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন নাজমুলের হয়ে বিভিন্ন এলাকায় চাঁদাবাজি করেন। তাদের মধ্যে আছেন রানাভোলার কাশেম, আমির আলীর ছেলে খোরশেদ আলম ওরফে রানা, আবুল ফজলের ছেলে আলামিন, গুলগুল্লা মোড়ের নাসির, কুদ্দুস মিয়ার ছেলে ফরিদ ও ফরহাদ, ধউরের হাবিব, ৫৪ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের নেতা এসএম শাহদাৎ হোসেন ওরফে সেতু, ৫৩ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের কথিত নেতা নজরুল ইসলাম, নুরুজ্জামান, স্থানীয় মিন্নত আলীর ছেলে সাদ্দাম, শিপলু, কেরামত আলীর ছেলে রাতুল ও আক্কাস আলীর ছেলে সজীব।
অভিযোগ প্রসঙ্গে বক্তব্য জানার জন্য রোববার বিকালে উত্তরা ৭ নম্বর সেক্টরে ২৫ নম্বর রোডে নাজমুলের বাড়িতে গেলে তাকে পাওয়া যায়নি। তার ব্যক্তিগত মোবাইল নম্বরে কল করা হলেও সেটি বন্ধ পাওয়া যায়। পরে তার হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে বক্তব্য চেয়ে খুদে বার্তা পাঠানো হয়। কিন্তু এতে তার সাড়া পাওয়া যায়নি। তুরাগ থানা যুবলীগের নেতারা জানান, দলীয় বিভিন্ন কর্মসূচিতে নাজমুলকে দেখা গেলেও তার কোনো পদ-পদবি নেই। তবে তিনি পদ পাওয়ার চেষ্টা করছেন। এছাড়া সম্প্রতি তিনি স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর পদে নির্বাচনের ঘোষণাও দিয়েছেন।
কথিত যুবলীগ নেতা নাজমুলের বিরুদ্ধে দখল ও চাঁদাবাজির অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আওয়ামী যুবলীগের (উত্তর) সাধারণ সম্পাদক ইসমাইল হোসেন শনিবার যুগান্তরকে বলেন, গণমাধ্যমে এ সম্পর্কে বেশকিছু অভিযোগ এসেছে। এ বিষয়ে তদন্ত করে দেখা হবে। বাস্তবে তিনি যদি চাঁদাবাজি বা দখলের মতো অপরাধে জড়িত হন তবে তাকে ছাড় দেওয়ার সুযোগ নেই। এক্ষেত্রে অভিযোগ তদন্ত করে অবশ্যই সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।