অদক্ষ ব্যবস্থাপনার খেসারত মেট্রোরেলে
মতিন আব্দুল্লাহ
প্রকাশ: ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
দেশের প্রথম মেট্রোরেলের চলাচল প্রায়ই বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কখনো যান্ত্রিক ত্রুটি কখনো অন্যান্য কারণে বৈদ্যুতিক ট্রেনটির যাত্রা ব্যাহত হচ্ছে। স্বপ্নের মেট্রো হঠাৎ হঠাৎ বন্ধে জনমনে হতাশা ও নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। অথচ কর্তৃপক্ষ এটাকে সাধারণ ব্যাপার বলছে। তবে বিশেষজ্ঞদের দাবি দক্ষ জনবল এবং পরিচালনা পদ্ধতির অব্যবস্থাপনার কারণে এসব হচ্ছে।
তাদের মতে, বিশ্বজুড়ে মেট্রোরেল পরিচালিত হয় পেশাদার জনবল দিয়ে। কোথাও এটা সরকারি তত্ত্বাবধানে আবার কোথাও বেসরকারি তত্ত্বাবধানে চলে। এখানে দক্ষ জনবলই মুখ্য বিষয়। ঢাকায় নতুন মেট্রোরেল হওয়ায় দক্ষ জনবলের অভাব আছে। এজন্য পরিচালনায় শুরু থেকে নানা ত্রুটি দেখা দিচ্ছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মেট্রোতেও সমস্যা দেখা দেয়। তবে ঢাকা মেট্রোর ত্রুটি অন্য দেশের তুলনায় একটু বেশি।
বিশেষজ্ঞরা জানান, এসব ক্ষেত্রে দেশের সরকারি ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি উন্নত নয়। সেখানে মেট্রোরেল সরকারি জনবল নিয়োগ দিয়ে পরিচালনার সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। সরকার বিমানবন্দর ও পোর্ট বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় ছেড়ে দিয়ে সুফল পাচ্ছে। মানুষের আশার বাহন মেট্রোকে সঠিক উপায়ে পরিচালনার জন্য সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে কোনো গড়িমসি না করার জন্য জড়িতদের পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
ঢাকায় মেট্রোরেলের নির্মাতা ও পরিচালনা সংস্থা ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল)। এই সংস্থার এমআরটি-৬ প্রকল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০২২ সালের ২৮ ডিসেম্বর উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত অংশের উদ্বোধন হয়। ২৯ ডিসেম্বর থেকে মেট্রোরেল উন্মুক্ত করা হয় সর্বসাধারণের জন্য। এর একদিন পরেই বৈদ্যুতিক তারে ফানুস আটকে বন্ধ হয়ে পড়ে মেট্রো। এরপর গত বছরের শুরুতে মেট্রো লাইনসংলগ্ন ভবনের ছাদে নেড়ে দেওয়া কাপড় বিদ্যুতের তারে পড়ায় ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এরপর ঢিল ছুড়ে মেট্রোর গ্লাস ভাঙায় কিছুক্ষণের জন্য ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে পড়ে। এছাড়া গত বছর বহুবার যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে চলাচল বাধাগ্রস্ত হয়। কখনো ৩০ মিনিট কখনো কিছু কম বা বেশি সময় ধরে মেট্রো বন্ধ থাকে।
ডিএমটিসিএল সংশ্লিষ্টরা জানান, চলতি বছরের ২৩ জানুয়ারি ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো দুর্বৃত্ত স্যাটেলাইট টিভির কেবল বা ডিশের তার মেট্রোর তারে নিক্ষেপ করায়, চলাচল বাধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। কর্তৃপক্ষ দুর্বৃত্তদের খুঁজে পায়নি। আধুনিক এই বৈদ্যুতিক যানবাহনের সিসিটিপি দুর্বৃত্তদের শনাক্তে কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি। গত ৪ ফেব্রুয়ারি যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে মেট্রোরেল পৌনে ২ ঘণ্টা বন্ধ থাকে। আর ১৪ ফেব্রুয়ারি ঘুড়ি আটকে বন্ধ থাকে ৩৫ মিনিট। এই ঘটনায় পুলিশ প্রাপ্তবয়স্ক ২ জনকে মামলা দিয়ে কারাগারে পাঠিয়েছে। আর অপ্রাপ্ত ৬ জনকে মুচলেকা দিয়ে থানা থেকে তার পরিবারের কাছে সোপর্দ করেছে। সবশেষ গত শনিবার মেট্রোরেলের স্বয়ংক্রিয় দরজা আটকে যাওয়ায় মেট্রো চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এতে প্রায় ১ ঘণ্টা ১৭ মিনিট ট্রেন বন্ধ থাকে। প্রসঙ্গত, দেশের প্রথম বৈদ্যুতিক যান বা মেট্রোরেল প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকার খরচ করছে ৩৩ হাজার ৪৭২ কোটি টাকা।
সংশ্লিষ্টরা জানায়, ২০৩৫ সালের মধ্যে ঢাকায় ৫টি মেট্রোরেল চালুর পরিকল্পনা আছে সরকারের। এরই অংশ হিসাবে এমআরটি-৬ এর উত্তরা থেকে মতিঝিল অংশের বাস্তবায়ন কাজ শেষ হয়েছে। আর এমআরটি-১ ও এমআরটি-৫ এর কাজ শুরু হয়েছে। বাকি কাজ দ্রুততম সময়ের মধ্যে শুরুর প্রচেষ্টা অব্যাহত। সব প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে ঢাকায় ১৩০ কিলোমিটারের মেট্রো নেটওয়ার্ক তৈরি হবে। উড়ালপথে ৬৯ কিলোমিটার এবং পাতাল পথে ৬১ কিলোমিটার মেট্রো নেটওয়ার্ক হবে। ঢাকার যানজট নিরসন ও পরিবেশবান্ধব গণপরিবহণ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে যাচ্ছে সরকার। এই উদ্যোগ মেট্রো কর্তৃপক্ষের ভুল ও অদক্ষ ব্যবস্থায় যাতে বিফলে না যায় সেদিকে মন্ত্রী সচিবসহ সংশ্লিষ্টদের বিশেষ নজর রাখার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
বিশেষজ্ঞরা যা বললেন : জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. সামছুল হক যুগান্তরকে বলেন, ঢাকা মেট্রোর মতো নড়বড়ে লোকবল দিয়ে মেট্রো পরিচালনার উদাহরণ বিশ্বে দ্বিতীয় আর পাওয়া যাবে না। নতুন জনবল নিয়োগের পর ট্রেনিং শেষে তাদের দিয়ে মেট্রো পরিচালনার ঝুঁকি উন্নত দেশগুলো নেয় না। তারা জ্ঞান-বিজ্ঞানটা ভালো জানেন। কিন্তু এটা স্বীকার করতে নারাজ মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ। এর কারণ তাদের জানাবোঝার ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। এই লোকগুলো জনবল নিয়োগ ও কেনাকাটা পছন্দ করেন; এর বাইরে তারা কিছু বোঝেন না। এসব করতে গিয়ে তারা বিজ্ঞানকে দূরে ঠেলে ফেলেন।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের সরকারি ব্যবস্থাপনার উদাহরণ ভালো নয়। এজন্য বিমানের তৃতীয় টার্মিনালের ব্যবস্থাপনা বিদেশিদের হাতে দেওয়া হয়েছে। তখন বিমান কর্তৃপক্ষও তা ছাড়তে নারাজ ছিল। পতেঙ্গা টার্মিনালও বিদেশি পেশাদার কোম্পানিকে দেওয়া হচ্ছে। মেট্রোর ব্যবস্থাপনা বেসরকারি পেশাদার কোম্পানি দেওয়া উচিত ছিল। মেট্রো কর্তৃপক্ষের খামখেয়ালিপনার জন্য সেটা হয়নি।
তিনি জানান, অদক্ষ ব্যবস্থাপনার কারণে মেট্রোরেলে ট্রায়ালরানে প্রচুর সময় ও অর্থের অপচয় ঘটছে। সক্ষমতা না থাকায় মেট্রো এখনো দেরি করে ছাড়ছে। উন্নত দেশ হলে ধীরগতির কারণে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ করে মেট্রো কর্তৃপক্ষের কাছে জবাবদিহি চাইত। এক বছরের বেশি সময় ধরে ট্রায়াল করলেও তার সুফল মিলছে না।
তিনি আরও জানান, জাপানসহ উন্নত দেশে মেট্রোর পরিচালনা শুধু বেসরকারি নয়, মেট্রোর নির্মাণও বেসরকারি পর্যায়ে চলে গেছে। সেখানে ঢাকায় পরিচালনাও সরকারি পর্যায়ে রাখার সিদ্ধান্ত আমার কাছে প্রাগৈতিহাসিক বলে মনে হয়।
বাংলাদেশ প্ল্যানার্স ইনস্টিটিউটের (বিআইপি) সভাপতি অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান যুগান্তরকে বলেন, পৃথিবীতে সরকারি ও বেসরকারি দুই ব্যবস্থাপনায় মেট্রোরেল পরিচালনা করা হয়। যেহেতু বাংলাদেশের সরকারি ব্যবস্থাপনায় ভালো সেবা মেলে না, সেখানে মেট্রোর ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় দিলে এত সংকট থাকত না।
তিনি বলেন, পৃথিবীর অন্যান্য মেট্রোতেও ত্রুটি দেখা দেয়, তবে ঢাকার মতো হয় না। দেশের অন্যান্য সংস্থা বা প্রকল্পের মতো ঘটনা ঘটছে এখানে। আর মেট্রো থেকে অকারিগরি নেতৃত্ব সরিয়ে দেওয়া দরকার। এটা দেশে নেতিবাচক দৃষ্টান্ত তৈরি করছে।
উল্লেখ্য, দেশের জাতীয় পর্যায়ের প্রকৌশলী এবং তাদের সংগঠন ইনস্টিটিউট অব ইঞ্জিনিয়ার্স, বাংলাদেশ (আইইবি) শুরু থেকে ডিএমটিসিএল’র অকারিগরি নেতৃত্বের বিরোধিতা করেছে। তাতে কর্ণপাত করেনি সরকার; যার খেসারত এখন গুনতে হচ্ছে। বিদ্যমান ত্রুটিগুলো সংশোধন করা না হলে স্বপ্নের বাহন মেট্রোতে নতুন নতুন জটিলতার সৃষ্টি করবে বলে তারা মনে করেন।
কর্তৃপক্ষের অভিমত : সার্বিক বিষয়ে ডিএমটিসিএল’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এমএএন ছিদ্দিকের কাছে জানতে চাইলে যুগান্তরকে বলেন, ঢাকার মেট্রো আন্তর্জাতিক মানের চেয়েও ভালোভাবে পরিচালিত হচ্ছে। এটা নিয়ে নেতিবাচক কথা বলার কোনো সুযোগ নেই।