Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

খেলাপি ঋণ ১,৪৫,৬৩৩ কোটি টাকা

এক বছরে বাড়ল ২৫ হাজার কোটি টাকা

Icon

হামিদ বিশ্বাস

প্রকাশ: ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

এক বছরে বাড়ল ২৫ হাজার কোটি টাকা

ব্যাংক খাতে কোনোভাবেই খেলাপি ঋণের লাগাম টানা যাচ্ছে না। লাফিয়ে বাড়ছে খেলাপির অঙ্ক। শুধু এক বছরেই বেড়েছে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা। এর আগে এক বছরের ব্যবধানের বেড়েছিল ১৭ হাজার কোটি টাকা। ফলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ক্রমাগতভাবে বাড়ছে।

যদিও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এটাও সঠিক নয়। প্রকৃত তথ্য আরও ভয়াবহ। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক খেলাপি ঋণের যে হিসাব দিচ্ছে, তা প্রকৃত তথ্য নয়। এসব তথ্য বিশ্বাস করি না। কারণ প্রকৃত খেলাপি আরও বেশি। মামলার কারণে অনেক ঋণকে খেলাপি হিসাবে চিহ্নিত করা যাচ্ছে না। আবার অবলোপন করা ঋণও খেলাপির হিসাবে নেই। এ দুই ঋণকে বিবেচনায় নিলে প্রকৃত খেলাপি ঋণের অঙ্ক সাড়ে ৪ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। তিনি মনে করেন, যতদিন ঋণখেলাপিদের জন্য ট্রাইব্যুনাল গঠন করে আলাদাভাবে বিচারের ব্যবস্থা করা যাবে না, ততদিন খেলাপি ঋণও কমবে না।

জানা গেছে, ব্যাংক খাতের প্রধান সমস্যা ঋণ নিয়ে একশ্রেণির প্রভাবশালী গ্রাহক টাকা ফেরত দেয় না। এতে করে বাড়ছে খেলাপি ঋণ। আর্থিক খাতের এ বিষফোড়ার জ্বালা কমাতে নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কিন্তু তেমন ফল পাচ্ছে না। সবশেষ ২০২৩ সালের ডিসেম্বর শেষে দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ এক লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা দাঁড়িয়েছে। এক বছর আগে ২০২২ সালের ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ ছিল এক লাখ ২০ হাজার ৬৫৬ কোটি টাকা। সেই হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা বা প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এসব তথ্য।

প্রতিবেদনের তথ্যে দেখা যায়, ২০২৩ সালের ডিসেম্বর মাস শেষে ব্যাংকিং খাতের মোট বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৬ লাখ ১৭ হাজার ৬৮৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে এক লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ৯ শতাংশ, যা আগের বছরে ছিল ৮.১৬ শতাংশ। যদিও ২০২৬ সালের ৩০ জুনের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৮ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনার ঘোষণা দিয়েছে। তবে বাস্তবতা বলছে, এটা শুধু আশার মধ্যে ঘুরপাক খাবে।

২০২৩ সালের চার প্রান্তিকের মধ্যে প্রথম দুই প্রান্তিকে খেলাপি ঋণ বাড়লেও শেষ দুই প্রান্তিকে কমেছে। এক লাখ ২০ হাজার ৬৫৬ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ নিয়ে ২০২৩ সাল শুরু করে। মার্চে এ খেলাপি গিয়ে দাঁড়ায় ১ লাখ ৩১ হাজার ৬২০ কোটি টাকায় অর্থাৎ প্রথম প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ) খেলাপি ঋণ বাড়ে ১০ হাজার ৯৬৪ কোটি টাকা। পরে জুনে তা আরও বেড়ে দাঁড়ায় এক লাখ ৫৬ হাজার ৩৯ কোটি টাকায়। দ্বিতীয় প্রান্তিকে (এপ্রিল-জুন) ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২৪ হাজার ৪১৯ কোটি টাকা। তৃতীয় প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) ৬৪২ কোটি টাকা কমে দাঁড়ায় এক লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৭ কোটি টাকায়। তবে শেষ প্রান্তিকে (অক্টোবর-ডিসেম্বর) ৯ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা কমেছে। সার্বিক হিসাবে পুরো ২০২৩ সালে ২৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ বেড়েছে ব্যাংক খাতে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক এখন পর্যন্ত কঠোর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। অতি সাম্প্রতিক সময়ে কিছু উদ্যোগের কথা বলা হয়েছে। মনে হচ্ছে সেগুলোও কাজে আসবে না। যেখানে রাজনৈতিক প্রভাব এবং ক্ষমতার বলয় সৃষ্টি হয়, সেখানে কিছুই করা যায় না। এমন প্রেক্ষাপটে ঋণ না দেওয়ার সংস্কৃতি সৃষ্টি হয়েছে, এটা খুব খারাপ। যা বাংলাদেশ ব্যাংকের ভুল নীতির কারণেই হয়েছে। এখান থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। ইদানীং ব্যাংক পরিচালকদের জন্য যে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়, তা পেশাদারিত্বের সঙ্গে কার্যকর করতে পারলে খেলাপি ঋণ কিছুটা কমে আসবে। তা না হলে খেলাপি ঋণ কমানো সম্ভব হবে না।

বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ আবাসিক মিশনের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন যুগান্তরকে বলেন, খেলাপি ঋণ বন্ধে দৃশ্যমান এবং কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেই। যা কিছু করে কৃত্রিম এবং লোক দেখানো। সমস্যার গোড়ায় হাত দেওয়া হয় না। সে কারণে অবস্থার উন্নতি হয়নি বরং ক্রমাগত অবনতি হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাংক খাতের জন্য যে রোডম্যাপ দেওয়া হয় তাতেও একটি ছাড়া বাকিগুলোতে অর্থবহ কিছু নেই।

খেলাপি ঋণ বাড়ার বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম বলেন, খেলাপি ঋণ বাড়া কোনো মতেই কাম্য নয়। এটি বাড়লে ব্যাংক খাত নিয়ে নেতিবাচক প্রশ্ন ওঠে। এতে করে আমানতকারীদের অর্থের ঝুঁকি বেড়ে যায়, পাশাপাশি জমানো টাকা ফেরত পাওয়া নিয়ে সন্দেহ সৃষ্টি হয়।

তিনি জানান, খেলাপি ঋণের যে তথ্য দেখানো হয় তা আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। কারণ এখানে ঋণ পুনর্গঠন-পুনঃতফশিলসহ মামলায় স্থগিত হওয়া অনেক খেলাপি ঋণের তথ্য নেই। তার মানে আন্তর্জাতিক নিয়মে খেলাপি ঋণের হিসাব করলে এ অঙ্ক কয়েকগুণ বেড়ে যাবে।

মহামারি করোনার প্রকোপের কারণে ২০২০ ও ২০২১ সালে ঋণ পরিশোধে পুরোপুরি ছাড় ছিল। গ্রাহককে ঋণ শোধ না করেও ঋণখেলাপি থেকে মুক্ত রাখার সুযোগ করে দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। কম সুদে ঋণ নেওয়া ও ঋণ পরিশোধে কিছুটা ছাড় ছিল ২০২২ সালেও। গেল বছরে ঋণের কিস্তির অর্ধেক পরিশোধে ছিল বিশেষ ছাড়া। এমন সব সুযোগের পরও ব্যাংকের টাকা ফেরত দিচ্ছে না গ্রাহক। যার কারণে নানা উদ্যোগ নিয়েও খেলাপি ঋণ কমাতে পারছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এদিকে খেলাপিদের বিশেষ ছাড় বন্ধ না হলে খেলাপি ঋণ কমবে না বলছেন অর্থনীতিবিদরা। তাদের মতে, ঢালাওভাবে সুবিধার কারণে ব্যাংকের পাশাপাশি গ্রাহকও বিপদে পড়বে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, মোট খেলাপি ঋণের মধ্যে রাষ্ট্র মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে ডিসেম্বরে শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৬৫ হাজার ৭৮১ কোটি টাকা। যা তাদের মোট ঋণ স্থিতির ২১ শতাংশ। বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৭০ হাজার ৯৮১ কোটি টাকা, যা তাদের ঋণ স্থিতির ৫ দশমিক ৯৩ শতাংশ। আর বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর ঋণের ১৩ দশমিক ৮৭ শতাংশ খেলাপি হয়ে পড়েছে। এসব ব্যাংকের মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৫ হাজার ৬৬৯ কোটি টাকা। অন্যদিকে বিদেশি ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৩ হাজার ২০০ কোটি টাকা। তাদের খেলাপি ঋণের হার ৪ দশমিক ৮২ শতাংশ।

সর্বশেষ বিশেষ সুবিধা : বাংলাদেশ ব্যাংক গেল বছরের ২০ জুন জানায়, যদি কোনো গ্রাহক চলতি বছরের জুনের মধ্যে ঋণের কিস্তির অর্ধেক টাকা জমা দেয় সে খেলাপি হবে না। ফলে যারা ঋণ নিয়ে কিস্তি শোধ না করে খেলাপি হওয়ার ঝুঁকিতে পড়েছিলেন, তারা কিস্তির অর্ধেক টাকা জমা দিয়েই নিয়মিত গ্রাহক হওয়ার সুযোগ পান। তবে শুধু মেয়াদি ঋণের ক্ষেত্রে এই সুবিধা দেওয়া হয়। সাধারণত ব্যবসা শুরু বা শিল্প-কারখানা গড়ে তুলতে মেয়াদি ঋণ নেওয়া হয়।

আইএমএফের শর্ত : ডলার সংকটে পড়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল-আইএমএফের ঋণের দ্বারস্থ হয় বাংলাদেশ। ঋণের প্রথম কিস্তির ৪৭৬ দশমিক ২৭ মিলিয়ন ডলার পেয়েছে। বাকি ছয় কিস্তির মধ্যে আগামী নভেম্বরে দ্বিতীয় কিস্তি ছাড়ের সম্ভাব্য তারিখ নির্ধারিত আছে। ধাপে ধাপে ঋণ ছাড়ের ক্ষেত্রে সংস্থাটি ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ ধীরে ধীরে কমিয়ে আনার শর্ত দিয়েছে। ২০২৬ সালের মধ্যে বেসরকারি খাতে খেলাপি ঋণ ৫ শতাংশের নিচে এবং সরকারি ব্যাংকে ১০ শতাংশের নিচে নামাতে হবে। সব শেষ প্রতিবেদনে খেলাপি ঋণের হার ১০ দশমিক ১১ শতাংশ। আর সরকারি ব্যাংকে খেলাপি ঋণের হারও নির্ধারিত মাত্রার অনেক ওপরে।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের অন্যতম শর্ত হচ্ছে রাষ্ট্র খাতের ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশে নামিয়ে আনা। অথচ এসব ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার ২০ শতাংশের ওপরে আছে।

Jamuna Electronics
wholesaleclub

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম