Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

ধর্ষণ-কাণ্ডে উত্তাল জাবি ক্যাম্পাস

ছাত্রলীগ নেতাসহ ৪ জন রিমান্ডে, ৬ জনের সনদ স্থগিত, তদন্ত কমিটি গঠন

Icon

জাবি প্রতিনিধি 

প্রকাশ: ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ধর্ষণ-কাণ্ডে উত্তাল জাবি ক্যাম্পাস

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) মীর মশাররফ হোসেন হলে বহিরাগত এক ব্যক্তিকে আটকে রেখে তার স্ত্রীকে ধর্ষণ করা হয়েছে। শনিবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে হলসংলগ্ন জঙ্গলে ঘটা এ ঘটনায় পুলিশ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ নেতা মোস্তাফিজুরসহ চারজনকে গ্রেফতার করেছে। রোববার আদালতের মাধ্যমে তাদের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। 

গ্রেফতার মোস্তাফিজ মীর মশাররফ হোসেন হলের আবাসিক শিক্ষার্থী। তিনি বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক। অন্যরা হলেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ছাত্র সাগর সিদ্দিকী ও হাসানুজ্জামান এবং উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র সাব্বির হাসান। পলাতক আছেন ভুক্তভোগীর পূর্বপরিচিত মো. মামুনুর রশিদ এবং স্বামীকে আটকে রাখতে সহায়তা ও মারধরে যুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষার্থী মো. মুরাদ। ঘটনার পর বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ মোস্তাফিজকে সাময়িক বহিষ্কার করে। পরে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ তাকে স্থায়ী বহিষ্কার করে। 

বিষয়টি নিয়ে রোববার দুপুর ১২টার দিকে আশুলিয়া থানায় সংবাদ সম্মেলন করেন সদ্য পুলিশ সুপার পদে পদোন্নতি পাওয়া ঢাকা জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস ও ট্রাফিক উত্তর বিভাগ) মো. আবদুল্লাহিল কাফী। তিনি বলেন, ‘ভুক্তভোগী নারী ও তার স্বামী আশুলিয়ায় একটি ভাড়া বাসায় থাকেন। পূর্বপরিচয়ের সূত্র ধরে একই বাসায় পাশাপাশি কক্ষে ভাড়া থাকতেন মামুনুর রশিদ। 

শনিবার মুঠোফোনে ভুক্তভোগী নারীর স্বামীকে মামুন জানান, তিনি (মামুন) জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মীর মশাররফ হোসেন হলে তার পরিচিত মোস্তাফিজুর রহমানের সঙ্গে কিছু দিন থাকবেন। এরপর তিনি ভুক্তভোগীর স্বামীকে ক্যাম্পাসে এসে তার (মামুন) সঙ্গে দেখা করতে বলেন। কথা মতো ভুক্তভোগীর স্বামী ক্যাম্পাসে এলে হলের একটি কক্ষে মুস্তাফিজ ও মুরাদের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। একপর্যায়ে মামুন ভুক্তভোগীর স্বামীকে জানান, সাভারের একটি ইলেকট্রনিক্সের দোকানে তারা কিছু টাকা পাবে, তবে দোকানদার টাকা দিতে চাচ্ছেন না। 

ওই টাকার বিনিময়ে বাসার জন্য টিভি, ফ্রিজসহ অন্যান্য আসবাব দিতে চান দোকানদার। ওই পণ্য সমপরিমাণ টাকা দিয়ে নিতে ভুক্তভোগীর স্বামীকে প্রস্তাব দেন মামুন। এরপর মানুন কিছু দিন ক্যাম্পাসে থাকতে হবে জানিয়ে ভুক্তভোগীর স্বামীকে বলেন যাতে তার স্ত্রী কাপড় নিয়ে (মানুনের কাপড় নিয়ে) ক্যাম্পাসে আসেন। এরপর স্বামী তার স্ত্রীকে ক্যাম্পাসে আসতে বলেন। রাত ৯টার দিকে স্ত্রী কাপড় নিয়ে ক্যাম্পাসে আসেন। 

ভুক্তভোগীর স্বামী, মামুন, মুস্তাফিজ ও মুরাদ মীর মশাররফ হোসেন হলের সামনে আসেন। একপর্যায়ে মুরাদ ভুক্তভোগীর স্বামীকে হলের এ ব্লকের ৩১৭ নম্বর কক্ষে নিয়ে বেঁধে ফেলেন ও মারধর করেন। পরে মুস্তাফিজ ও মামুন ওই নারীকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মীর মশাররফ হোসেন হলসংলগ্ন পাশের জঙ্গলে নিয়ে ধর্ষণ করেন। প্রায় দেড় ঘণ্টা পর ওই নারী ও তার স্বামীকে ছেড়ে দেওয়া হয়। ঘটনার পর অভিযোগ নিয়ে প্রথমে তারা আশুলিয়া থানায় এবং পরে সাভার মডেল থানায় যান।

আবদুল্লাহিল কাফী বলেন, এর পরই সাভার মডেল থানা ও আশুলিয়া থানার পুলিশ যৌথভাবে তদন্ত শুরু করে। জড়িতদের পালিয়ে যেতে সহায়তা করায় তিনজনকে ক্যাম্পাস থেকে আটক করা হয়। পরে আটক হয় মোস্তাফিজুর। রোববার সকালে মামলা হলে তাদের গ্রেফতার দেখানো হয়। পলাতক আসামি মুরাদ ও মামুনকে গ্রেফতারে অভিযান চলছে।

ভুক্তভোগী নারী সাংবাদিকদের বলেন, ‘মামুন ভাই আমার স্বামীর মাধ্যমে ফোন দিয়ে আমাকে তার রেখে যাওয়া জিনিসপত্র নিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে বলেন। আমি তার জিনিসপত্র নিয়ে ক্যাম্পাসে যাই। মামুন আমার কাছ থেকে তার জিনিসপত্রগুলো নিয়ে হলে রেখে আসেন। পরে আমার স্বামী অন্যদিক থেকে আসবেন বলে আমাকে হলের সামনে থেকে পাশের জঙ্গলে নিয়ে যান। তার সঙ্গে মোস্তাফিজ ভাইও ছিলেন। তারা আমাকে জোরপূর্বক ধর্ষণ করেন।

এ ঘটনা মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়লে মীর মশাররফ হোসেন হলের সামনে জড়ো হতে থাকেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। তারা বিচারের দাবিতে বিক্ষোভ শুরু করেন। 

রাত ১টার দিকে ভুক্তভোগী নারীকে নিয়ে ঘটনাস্থলে যায় সাভার হাইওয়ে থানা পুলিশ। পুলিশ আসার খবর পেয়ে ডাইনিংয়ের রান্নাঘরের পেছনের তালা ভেঙে পালিয়ে যান মোস্তাফিজুর। রান্নাঘরে থাকা সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, রাত ১টা ১৭ মিনিটে মোস্তাফিজুরকে পালিয়ে যেতে সহযোগিতা করছেন ছাত্রলীগ কর্মী সাগর সিদ্দিকী, সাব্বির হাসান ও হাসানুজ্জামান। তবে রোববার সকাল সাড়ে ৭টার দিকে সাভার মডেল থানায় আত্মসমর্পণ করেন মোস্তাফিজুর। এর আগে রাতেই মোস্তাফিজুরকে পালাতে সহয়তাকারীদের আটক করে আশুলিয়া থানা পুলিশ।

এদিকে ধর্ষণের ঘটনার বিচার দাবিতে রোববার মানববন্ধন ও বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। দুপুর ১২টার দিকে শহিদ মিনারসংলগ্ন রাস্তায় মানববন্ধন করেন তারা। মানববন্ধনে বিভিন্ন বিভাগের প্রায় চার শতাধিক শিক্ষার্থী অংশ নেন। সাড়ে ১২টার দিকে প্রশাসনিক ভবন অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা। তাদের আরেকটি দল ও শিক্ষকদের একটি প্রতিনিধি দল উপাচার্যের কক্ষের সামনে অবস্থান নেয়। তারা জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক বিচার এবং বিভিন্ন হলে অবস্থান করা আড়াই হাজার অবৈধ শিক্ষার্থীকে বের করার দাবি জানান।

এসময় বাংলা বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক শামিমা সুলতানা বলেন, এমন অথর্ব প্রশাসন দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় চলে না। আমরা বারবার প্রশাসনকে বলেছি, অবৈধ শিক্ষার্থীরা যেন হলে থাকতে না পারে। কারণ তারা কোনো অন্যায় করলে সেটির কোনো বিচার হয় না। এখন দেখব এই ৪৫ ব্যাচ, যারা কাণ্ডটা ঘটিয়েছে তদের বিচারটা কী হয়? জড়িতদের সার্টিফিকেট বাতিলের দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, শিক্ষার্থীদের প্রতি আমার অনুরোধ, আপনারা সজাগ থাকলে প্রশাসন যা ইচ্ছে তাই করতে পারবে না। এ সময় তিনি প্রক্টরিয়াল বডির বিচার ও পদত্যাগ দাবি করেন।

ছাত্র ইউনিয়ন জাবি সংসদের আহ্বায়ক আলিফ মাহমুদ বলেন, প্রক্টরের উপস্থিতিতে রাত ১টার দিকে ধর্ষক মোস্তাফিজ অন্যদের সহায়তায় হল ক্যান্টিনের তালা ভেঙে পেছন দিয়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। আমরা এই অথর্ব প্রক্টরের পদত্যাগ চাই। প্রক্টর তার পদে থাকার নৈতিক যোগ্যতা অনেক আগেই হারিয়েছেন। এ ঘটনায় তার ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। 

দুপুর আড়াইটার দিকে শহিদ মিনারসংলগ্ন রাস্তায় বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান লিটন নিজের অনুসারীদের নিয়ে মানববন্ধন করেন। সাড়ে ৪টায় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি আক্তারুজ্জমান সোহেল অনুসারীদের নিয়ে মীর মশাররফ হোসেন হলের সামনে মানববন্ধন করেন। মানববন্ধন থেকে তারা জড়িতদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি করেন। 

এছাড়া জড়িতদের শাস্তি ও চার দফা দাবি জানিয়েছে বঙ্গবন্ধু শিক্ষক পরিষদ। দাবিগুলো হল পৈশাচিক ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি, অছাত্রদের ৭ দিনের মধ্যে হল ত্যাগের নির্দেশ এবং গণরুমের চির-অবসান করা। 

৬ জনের সনদ বাতিল, তদন্ত কমিটি গঠন : ঘটনা তদন্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য ড. অজিত কুমার মজুমদারকে সভাপতি করে চার সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য বলা হয়েছে। আর সিন্ডিকেট সভায় মোস্তাফিজুরের সনদ স্থগিত এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে অবাঞ্ছিত ঘোষণা, অন্য অভিযুক্ত মুরাদকে সাময়িক বহিষ্কার ও সনদ স্থগিত, শাহ পরানের সনদ স্থগিত, সাব্বির আহমেদ সাগরকে সাময়িক বহিষ্কার ও সনদ স্থগিত, এ এস এম মোস্তফা মনোয়ার সিদ্দিকীকে সাময়িক বহিষ্কার ও সনদ স্থগিত এবং হাসানুজ্জামানের সনদ স্থগিত ও ক্যাম্পাসে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়েছে। এছাড়া সব অছাত্রকে ৫ দিনের মধ্যে হল ত্যাগের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

চারজন রিমান্ডে : ধর্ষণের ঘটনায় মোস্তাফিজুর রহমানসহ চারজনকে তিন দিন রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দিয়েছেন আদালত। ঢাকার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট (সিজেএম) আদালতের বিচারক রোববার এ আদেশ দেন। ঢাকা জেলা পুলিশের প্রসিকিউশন বিভাগে কর্মরত উপপরিদর্শক মাসুদ মিয়া জানান, গ্রেফতার চারজনকে আদালতে হাজির করে সাত দিন করে রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন করে আশুলিয়া থানা পুলিশ। অপরদিকে আসামিপক্ষ থেকে রিমান্ড আবেদন বাতিল ও জামিনের আবেদন করা হয়। উভয়পক্ষের শুনানি নিয়ে আদালত প্রত্যেক আসামির তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

শিক্ষার্থীদের মশাল মিছিল : ধর্ষণের প্রতিবাদে রোববার সন্ধ্যায় মশাল মিছিল করেছে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। মিছিলটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শহিদ মিনার থেকে শুরু হয়ে মীর মশাররফ হোসেন হল, কেন্দ্রীয় ক্যাফেটেরিয়া, ছাত্রীদের আবাসিক হল, প্রান্তিক গেট হয়ে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে এসে এক সংক্ষিপ্ত সমাবেশের মাধ্যমে শেষ হয়। 

এ সময় শিক্ষার্থীরা ‘ক্যাম্পাসে ধর্ষণ কেন, প্রশাসন জবাব চাই’, ‘অবৈধ ছাত্র, মানি না মানব না’, ‘ধর্ষকের দুই গালে, জুতা মারো তালে তালে’ ইত্যাদি স্লোগান দেন। সমাবেশে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ৪৭ ব্যাচের শিক্ষার্থী আরিফ সোহেল বলেন, আমরা প্রশাসনকে বলে দিতে চাই এই ক্যাম্পাসে ধর্ষকদের মদদদাতাদেরও কোনো ঠাঁই নাই। 

৪৯ ব্যাচের শিক্ষার্থী আহসান লাবীব বলেন, যে সংগঠন, যে শিক্ষক, যে রক্ষক এদের মদদ দেয় তাদেরকে অবিলম্বে ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়িত করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ইউনিয়ন জাবি শাখার আহ্বায়ক আলিফ মাহমুদ বলেন, যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের কাছে নিরাপদ নয়, সেখানে বহিরাগতরা কীভাবে নিরাপদ থাকবে। সমাবেশ থেকে আজ বেলা ১১টায় পোস্টারিং কর্মসূচির ঘোষণা দেওয়া হয়।
 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম