সরকারবিরোধী আন্দোলন বিএনপির
কেন্দ্রে সমন্বয়ের অভাব দেখছে তৃণমূল
অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের কমিটি ভাঙতে ফের সক্রিয় একটি চক্র
নূরে আলম জিকু
প্রকাশ: ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
সরকারবিরোধী আন্দোলনের সফলতা নিয়ে আশাবাদী হতে পারছে না বিএনপির তৃণমূল নেতারা। কর্মসূচি সফলে কেন্দ্রীয় নেতাদের সমন্বয়ের অভাবও দেখছেন। তাদের মতে, হাইকমান্ডের নাম ব্যবহার করে আন্দোলনকে সঠিক পথে নিতে দিচ্ছে না সংশ্লিষ্ট কয়েকজন নেতা। এছাড়া ভোটের আগে আত্মগোপনে যাওয়া অনেক নেতা এখনো কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছে না, যা নিয়ে অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন। এমন পরিস্থিতিতে আবারও নতুন কর্মসূচি নিয়ে ভাবছে বিএনপি। বিশ্ব ইজতেমা, এসএসসি পরীক্ষা, রোজা ও ঈদকে সামনে রেখে কর্মসূচি নির্ধারণ করবে দলটি। একদফা দাবির পাশাপাশি জনসম্পৃক্ত ইস্যুতে শিগগিরই কর্মসূচি ঘোষণা দেওয়ার কথা রয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য।
দলটির একাধিক নেতা জানান, আন্দোলনের এই সময়ে আবার একটি ‘বিশেষ চক্র’ অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের কমিটি ভেঙে দেওয়ার ষড়যন্ত্রে নেমেছে। এ তিন সংগঠনের শীর্ষ নেতাদের নামে নানা অপ্রচারও চালাচ্ছেন তারা। অথচ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল, যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের কমিটির মেয়াদ এখনো রয়েছে। নেতারা জানান, মেয়াদ শেষের আগেই কমিটি ভাঙলে তা হবে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। কেননা চলমান আন্দোলনে মূল দল বিএনপির চেয়ে এসব অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের সারা দেশে ভূমিকা ছিল চোখে পড়ার মতো। এখন কমিটি ভাঙলে তাদের ভূমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হবে। এতে মনোবল হারাবে নেতাকর্মীরা। যার প্রভাব পড়তে পারে সামনের আন্দোলনে। বর্তমান পরিস্থিতিতে ওই বিশেষ চক্রটি কী উদ্দেশ্যে বা কাদের এজেন্ডা বাস্তবায়নে এসব করছেন তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন নেতারা। এ নিয়ে অঙ্গ সংগঠনে ক্ষোভ বিরাজ করছে।
এদিকে সতেরো বছর ক্ষমতার বাইরে বিএনপি। এক যুগেরও বেশি সময় ধরে আন্দোলন করছে দলটি। এরই মধ্যে তিনটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন করে টানা চতুর্থবারের মতো ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ। দীর্ঘ আন্দোলনেও নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেনি। এজন্য দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের দায়ী করছেন তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা। যদিও আন্দোলনের অংশ হিসাবে ভোট বর্জনের ডাকে জনগণ সাড়া দিয়েছে দাবি করে বিএনপি নেতা বলছেন, এটি তাদের বড় সফলতা। তারা আন্দোলন করছেন গণতন্ত্র ও মানুষের মৌলিক অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য। এ দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত রাজপথেই থাকবেন।
তুণমূল নেতাকর্মীদের অভিযোগ, একদফার আন্দোলনে ধারাবাহিক কর্মসূচি ঘোষণা করেও মাঠে নামেনি কেন্দ্রীয় নেতারা। অধিকাংশ শীর্ষ নেতা ছিলেন আত্মগোপনে। কর্মসূচি বাস্তবায়নে ছিল না কোনো সমন্বয়। তাদের সঠিক সময় দেওয়া হয়নি কোনো বার্তা। একের পর এক কর্মসূচি ঘোষণা করলেও দলীয় হাইকমান্ডের বরাত দিয়ে সক্রিয় নেতাদের গ্রেফতার এড়াতে আত্মগোপনের ‘ভিত্তিহীন’ বার্তা দিয়েছেন। বিষয়টি নিয়ে এখন অনেকেই মুখ খুলেছেন। তাদের দাবি, কেন্দ্রীয় নেতারা আত্মগোপনে থেকে অনেক সময় তাদের বিভ্রান্তিমূলক তথ্য দিয়েছেন। যদিও সরকারবিরোধী আন্দোলনে ব্যর্থতার দায় দেখছেন না বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা। তারা বলছেন, দলীয় হাইকমান্ডের নির্দেশেই আত্মগোপনে ছিলেন। শীর্ষ ও কেন্দ্রীয় নেতারা গ্রেফতার হলে সরকারবিরোধী আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হতো না।
জানতে চাইলে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী যুগান্তরকে বলেন, ‘একদফার আন্দোলনে তৃণমূলের সঙ্গে কেন্দ্রীয় নেতাদের কোনো সমন্বয় ছিল না, বিষয়টি সঠিক নয়। সরকার এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি করেছে, তার মধ্যেও জুমে আমাদের শীর্ষ নেতারা নিয়মিত যোগাযোগ করেছেন। তৃণমূলের নেতাদের সঙ্গে সার্বিক বিষয়ে কথা বলেছেন। আমাকেও কর্মসূচি ঘোষণা করতে হয়েছে। প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও কর্মসূচি পালন করেছি।’
তিনি বলেন, ‘যেখানে দেখামাত্রই গ্রেফতার করা হচ্ছে। সরকার নিজেরা নাশকতা করে বিএনপি নেতাদের নামে মামলা দিয়েছে। এমন বীভৎস দমনপীড়নের মধ্যে সর্বোচ্চ যতটুকু পারা যায়, শীর্ষ নেতারা তা রক্ষা করার চেষ্টা করেছেন। এখন পর্যন্ত কেউ কেন্দ্রীয় নেতাদের সমন্বয়হীনতার বিষয়ে অভিযোগ করেননি। তারা (তৃণমূল) মনে করে, সরকারের দমনপীড়নের কারণে একদফার আন্দোলন কিছুটা গতি কমেছে। এটা আবার গতিশীল হবে। সর্বশেষ ৩০ জানুয়ারি কালো পতাকা মিছিলেও সরকার তাণ্ডব চালিয়েছে। স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খানকে হেনস্তা করেছে। তারপরও আন্দোলন থেমে নেই। আন্দোলন চলছেই।’
তৃণমূলের নেতাদের অভিযোগ, ২৮ অক্টোবরের পর লাগাতার কর্মসূচি ঘোষণা করলেও অধিকাংশ কেন্দ্রীয় নেতাকে পাশে পাননি তারা। সরকারবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্বে সমন্বয়হীনতার কারণে তারা অনেকেই নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। গ্রেফতারসহ মামলা, হামলায় সবচেয়ে বেশি জর্জরিত তৃণমূল নেতারা। যাদের অনেকেই এখনো এলাকাছাড়া। জেলা ও মহানগরে কেন্দ্রীয় নেতাদের গ্রুপিং থাকায় অনেকেই মাঠের কর্মসূচি থেকে নিজেদের সরিয়ে রেখেছেন। কেউ কেউ আবার সরকারদলীয় নেতাদের আশীবার্দপুষ্ট ছিলেন।
কয়েকটি জেলার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক প্রায় অভিন্ন তথ্য দিয়ে বলেন, ২৮ অক্টোবর নয়াপল্টনের মহাসমাবেশ পণ্ডের পর থেকেই কেন্দ্রীয় নেতারা আত্মগোপনে চলে যান। যেসব কেন্দ্রীয় নেতা জেলা ও মহানগরের দায়িত্বে ছিলেন তাদেরও এই সময়ে পাওয়া যায়নি। উলটো ধারাবাহিক হরতাল, অবরোধে কেন্দ্রীয় নেতারা মাঠের সক্রিয় নেতাদের গ্রেফতার এড়িয়ে থাকার নির্দেশনা দিয়েছেন। এতে অনেকেই আন্দোলনের মাঠ ছেড়ে আত্মাগোপনে গেছেন। এছাড়া তৃণমূলের সঙ্গে কোনো ধরনের সমন্বয় ছাড়া কর্মসূচি ঘোষণা করেছে বিএনপি। একদফার আন্দোলনে যেসব কর্মসূচি ঘোষণা হয়েছে, বাস্তবে তা কতটুকু বাস্তবায়ন সম্ভব সে বিষয়গুলো দেখা হয়নি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরও একাধিক তৃণমূলের নেতা জানান, শীর্ষ নেতাদের অনেকেই শুধু জুম মিটিংয়েই সীমাবদ্ধ ছিলেন। ফলে হরতাল, অবরোধে তৃণমূল কর্মীরা ছাড়া শীর্ষ নেতাদের দেখা যায়নি। সবাই বলেছেন, আন্দোলন মনিটরিং করছেন। সবাই মনিটরিং করায় মাঠের কর্মসূচিতে ছিলেন না তারা। কর্মীরাই নানা ঝুঁকি নিয়ে বিচ্ছিন্নভাবে কর্মসূচি পালন করেছে। দল থেকে কোনো কর্মসূচি দিলে, সেটা যে শুধু কর্মীরাই বাস্তাবয়ন করবে, জীবন দেবে এটা হতে পারে না। অসংখ্য কেন্দ্রীয় নেতা এলাকায় যাননি। এখনো ঢাকায় আত্মগোপনে রয়েছেন। তবে তারা এও জানান, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের নেতৃত্বেই তারা ঐক্যবদ্ধ আছেন। তিনি যে নির্দেশনা দেবেন তা তারা যে কোনো মূল্যে বাস্তবায়ন করবেন। তবে সঠিক দায়িত্ব উপযুক্ত নেতাকে দেওয়ার মাধ্যমে আন্দোলনে আরও গতিশীল করার কথাও বলেন নেতারা।