নতুন সরকারের কঠোর বার্তা
দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেই দুদকের
হলফনামায় অর্ধশতাধিক মন্ত্রী-এমপির অস্বাভাবিক সম্পদ বাড়ার তথ্য যাচাই-বাছাইয়ে কোনো দল গঠন করা হয়নি
মাহবুব আলম লাবলু
প্রকাশ: ২৩ জানুয়ারি ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ইশতেহারে কঠোর হাতে দুর্নীতি দমনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে আওয়ামী লীগ। টানা চতুর্থবার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন দলটির সভাপতি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। নতুন মন্ত্রিসভার সদস্যরাও পর্যায়ক্রমে দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স (শূন্য সহিষ্ণুতা) দেখানোর কথা বলছেন। এসব কি শুধু কথার কথা, নাকি দুর্নীতি দমনে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে-এমন প্রশ্ন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের।
যুগান্তরের অনুসন্ধানে জানা যায়, দুর্নীতি প্রতিরোধে চোখে পড়ার মতো নতুন কোনো পদক্ষেপ নেয়নি দুদক, যা দেখে মানুষ মনে করতে পারে-‘এবার দুর্নীতিবাজদের খবর আছে’। আবার নির্বাচনের আগে প্রার্থীদের দাখিল করা হলফনামায় অস্বাভাবিক সম্পদ বাড়ার খবর গণমাধ্যমে আলোচিত হলে দুদকের তরফ থেকে বলা হয়েছিল, সময় করে খোঁজখবর নেওয়া হবে। কিন্তু সেই ‘খোঁজখবর’ নেওয়ারও সময় হয়নি সংস্থাটির। অনেকের অস্বাভাবিক সম্পদ বৃদ্ধি এবং সম্পদের বিশ্বাসযোগ্য উৎস না থাকলেও সেগুলো যাচাই-বাছাইয়ে এখনো কোনো দল গঠন করা হয়নি। একাধিক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, দেশ ও মানুষের কল্যাণে এবার কঠোর হস্তে দুর্নীতি দমনই সরকারের অন্যতম প্রধান কাজ হওয়া উচিত। শুধু বক্তব্যে সীমাবদ্ধ না রেখে দৃশ্যমান পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। যাতে সাধারণ মানুষ আশ্বস্ত হওয়ার পাশাপাশি দুর্নীতিবাজদের মধ্যে ভীতি ছড়িয়ে পড়ে। এজন্য দুর্নীতি প্রতিরোধে দেশের একমাত্র সংবিধিবদ্ধ সংস্থা হিসাবে দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) প্রকৃত অর্থে স্বাধীন ও গতিশীল করতে হবে। রাজনৈতিক প্রভাব বলয়ের বাইরে রেখে সংস্থাটিকে কাজ করতে দিতে হবে। আবার দুদকের কাজের দেখভালের জন্য দাঁড় করাতে হবে কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স সিস্টেম।
জানতে চাইলে দুদক কমিশনার জহুরুল হক বলেন, ‘আমরা (দুদক) দুর্নীতিবিরোধী যে কোনো ব্যবস্থা নিতে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে যখন অনুসন্ধান শুরু করি, যেগুলো পাই, সেগুলোর ব্যাপারে অ্যাকশন নিই। অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির বিরুদ্ধে আমরা মামলা করেছি। তাদের অনেকের শাস্তিও হয়েছে। তবে সমস্যা হচ্ছে, সবক্ষেত্রে তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায় না। ফলে অনেকেই ছাড়া পেয়ে যান। একটি প্রতিষ্ঠানে কারা দুর্নীতিতে জড়িত, তা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ ভালো জানেন। দুর্নীতির তথ্যপ্রমাণ প্রতিষ্ঠানগুলো কিংবা অন্য যে কোনো উৎস থেকে পেলে ব্যবস্থা নিতে বাধ্য দুদক। সরকারের সব প্রতিষ্ঠান দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিলে দেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রা কেউ ঠেকাতে পারবে না।’
জানা যায়, নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর ১৫ জানুয়ারি মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি এবং জড়িতদের শাস্তির আওতায় আনতে ‘জিরো টলারেন্স’ দেখানোর নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মূল্যস্ফীতি ও দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানের কথা জানান তিনি। প্রধানমন্ত্রীর এই নির্দেশনা পেয়েই মন্ত্রীরা নিজ নিজ মন্ত্রণালয়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে তাদের কঠোরতা ও জিরো টলারেন্স নীতির ঘোষণা দিচ্ছেন। ইতোমধ্যে সংবাদ ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের কাছে কয়েকজন মন্ত্রী দুর্নীতির বিরুদ্ধে তাদের এই মনোভাব তুলে ধরেছেন।
এ ব্যাপারে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, ‘শুধু কথা নয়, দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। দুদকের চোখের সামনে এখন অনেক কিছু ঘটছে। বড় বড় দুর্নীতির বেশকিছু ঘটনা বিভিন্ন মহলে আলোচিত হয়েছে। এমনকি সংসদেও আলোচিত হয়েছে। এর মধ্যে অনেক ঘটনা তদন্ত করার ক্ষেত্রে দুদক বছরের পর বছর সময় নিয়েছে। এসব নিয়ে এক ধরনের ফ্যাসাদ তৈরি করেছে। বাস্তবে তেমন কিছু হয়নি। দুর্নীতি প্রতিরোধে দৃশ্যমান কার্যকর ব্যবস্থা নিতে না পারলে দুদকের প্রতি মানুষের আস্থার সংকট ঘনীভূত হবে।’
দুর্নীতি দমনে দেশের একমাত্র এই প্রতিষ্ঠানের কর্তারা কেন কঠোরতা দেখাতে পারছেন না, তা জানতে একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে এ প্রতিবেদকের আলাপ হয়েছে। তাদের কেউ কেউ বলেছেন, দুদক যে কাজ করতে পারে, তা ১/১১-এর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে প্রমাণিত হয়েছে। দুদকের ভয়ে দুর্নীতিবাজরা বিলাসবহুল গাড়ি, ব্যাগভর্তি টাকা রাস্তায় ফেলে পালিয়েছে। মানুষ তার সম্পত্তি অন্যের নামে উইল করে দিয়েছে। তখন দুদকের ভয়ে অনেকেই ট্রুথ কমিশনে গিয়ে আÍস্বীকৃত দুর্নীতিবাজ হিসাবে জরিমানা দিয়ে দায়মুক্তি নিয়েছে। ২০১৭ সাল পর্যন্ত দুদক বেশ ভালোভাবেই কাজ করেছে বলে তাদের অভিমত। এরপর থেকে দুদকের কাজের মান ও গতি কমেছে। এর জন্য কমিশনের সিদ্ধান্তহীনতা ও যাচাই-বাছাই কমিটি একটি চক্রের কাছে কুক্ষিগত হয়ে যাওয়াকেই দায়ী করেছেন তারা। বলেছেন, দুদকের শীর্ষ পদগুলোয় নিয়োগের ক্ষেত্রে যেহেতু রাজনৈতিক বিবেচনা প্রাধান্য পায়, সেহেতু দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে তারা সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগেন। কার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে কে বিরাগভাজন হবেন, সেই দুশ্চিতায় অনেক ক্ষেত্রে অভিযোগ থাকার পরও কমিশন সিদ্ধান্ত দেন না। সরকার যেহেতু জিরো টলারেন্স নীতির ঘোষণা দিয়েছে, সেহেতু শুরু থেকেই সেই নীতির বাস্তবায়নে দুদককে উদ্যোগী হওয়া দরকার বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। কাজ শুরুর পর যদি সরকারের তরফ থেকে বাধা আসে, তখন তা বিবেচনায় সিদ্ধান্ত নিলেও অনেক কাজ হয়ে যাবে।
প্রধান কার্যালয়ে কর্মরত একজন কর্মকর্তা বলেন, আগে গণমাধ্যমে বড় কোনো দুর্নীতির বস্তুনিষ্ঠ খবর প্রকাশ পেলেই সেটা আমলে নিয়ে অনুসন্ধান কমিটি গঠন করা হতো। প্রকাশিত ও প্রচারিত প্রতিবেদনের কপি ধরে কাজ করলে ফল পাওয়া যেত। কিন্তু এখন যাচাই-বাছাই কমিটি গণমাধ্যমে প্রকাশিত দুর্নীতির রিপোর্ট খুব বেশি আমলে নিতে চায় না। আগে ৮০-৯০ শতাংশ বস্তুনিষ্ঠ ও বিশ্বাসযোগ্যভাবে প্রকাশিত, প্রচারিত দুর্নীতির প্রতিবেদন আমলে নিয়ে অনুসন্ধান কমিটি গঠন করা হতো। এখন তা নেমে এসেছে ৫ শতাংশের কোঠায়। জেলা সমন্বিত কার্যালয়ে দায়িত্বরত একজন কর্মকর্তা বলেন, আগে জেলা ও বিভাগীয় কার্যালয়ে জমা হওয়া দুর্নীতির অভিযোগ প্রধান কার্যালয়ে পাঠালে বেশির ভাগ অভিযোগ অনুসন্ধানের অনুমোদন দিয়ে ফেরত পাঠানো হতো। এখন খুব কমসংখ্যক অভিযোগ অনুসন্ধানের অনুমোদন পায়। ফলে অনেক জেলা কার্যালয়ে অনুসন্ধান ও তদন্ত পরিচালনার সংখ্যা একেবারেই কমে গেছে। দেশে সবক্ষেত্রে দুর্নীতির মাত্রা বাড়লেও জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে দুদকের কাজ কমে গেছে। জানা যায়, বর্তমানে রাঙামাটি জেলা কার্যালয়ে মাত্র ৫টি দুর্নীতির অভিযোগের অনুসন্ধান চলছে। নওগাঁ জেলা কার্যালয়ে চলছে ১০/১২টি অভিযোগের অনুসন্ধান। অথচ বিধি অনুযায়ী বিভাগীয় ও জেলা কার্যালয় থেকে প্রাথমিক যাচাই-বাছাই করে যত অভিযোগ প্রধান কার্যালয়ে পাঠায়, সবই এখানকার যাচাই-বাছাই কমিটি দেখে অনুসন্ধানের অনুমোদন দেওয়ার কথা। এখন সেটা দেওয়া হচ্ছে না।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, কাজের গতি বাড়াতে সংস্থার চেয়ারম্যান ও কমিশনের সুস্পষ্ট নির্দেশনা ও সিদ্ধান্ত দরকার। কিন্তু কোন সিদ্ধান্তে কে বিরাগভাজন হন, সেটা ভাবনায় থাকায় তারাও সঠিক সিদ্ধান্ত দিতে পারছেন বলে মনে হচ্ছে না। অথচ গত ১ বছরে দুদকে নতুন ১১৬ জন সহকারী পরিচালক (এডি) এবং ১৩৫ জন উপসহকারী পরিচালক (ডিএডি) নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এতে দুদকের কাজের গতি জাম্প করে দ্বিগুণ হওয়ার কথা। দুদকের অফিসার ছিল আড়াইশ, সেখানে নতুন আরও আড়াইশ যোগ হয়েছে। অফিসার ডাবল হলেও কাজের গতি একটুও বাড়েনি।