Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

বাদী বিবাদী আওয়ামী লীগ মামলা নিচ্ছে না পুলিশ

Icon

নেসারুল হক খোকন, ঝিনাইদহ থেকে

প্রকাশ: ২২ জানুয়ারি ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বাদী বিবাদী আওয়ামী লীগ মামলা নিচ্ছে না পুলিশ

প্রতীকী ছবি

নির্বাচনি সহিংসতায় ঝিনাইদহের শৈলকুপা এলাকায় এখনো থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। বিজয়ী নৌকার প্রার্থীর সমর্থকরা স্বতন্ত্রপ্রার্থীর অর্ধশতাধিক কর্মী-সমর্থকদের ঘরবাড়িতে ভয়াবহ তাণ্ডব চালানো ছাড়াও নৃশংস হামলা চালিয়েছে। কিন্তু ঘটনার ১৫ দিন পার হয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত হামলাকারীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। হামলা ও লুটপাটে জড়িতদের নাম-পরিচয় উল্লেখ করে থানায় লিখিত এজাহার দায়ের করা হলেও পুলিশ মামলা হিসাবে গ্রহণ করেনি। তদন্তের নামে শুধু সময়ক্ষেপণ করা হচ্ছে। এমন অভিযোগ ভুক্তভোগীদের।

পুলিশের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে, অভিযোগকারীরা থানায় না আসায় মামলা হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করা যাচ্ছে না। অপরদিকে ভুক্তভোগীরা বলছেন, হামলাকারীরা বিজয়ী প্রার্থী এমপি আব্দুল হাইয়ের ছত্রছায়ায় থাকায় পুলিশ মামলা নেওয়া তো দূরের কথা, তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। এ অবস্থায় অপরাধীরা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। এর ফলে তাদের অনেকে এখনো ঘরছাড়া। পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে। অবশ্য সংসদ-সদস্য আব্দুল হাই যুগান্তরের কাছে সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।

নির্বাচনি সহিংসতার বিষয়ে বিস্তর অভিযোগ পাওয়ার পর প্রতিবেদক সরেজমিন শৈলকুপা এলাকায় তথ্যানুসন্ধান চালান। উভয়পক্ষের অনেকের সঙ্গে কথা বলা ছাড়াও ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী সাধারণ মানুষের অভিমতও গ্রহণ করেন। এতে আওয়ামী লীগের অনেক প্রবীণ নেতার ভাষ্য হলো- জাতীয় নির্বাচন প্রধানমন্ত্রী উন্মুক্ত করে দেওয়ায় তারা দলে ভালো প্রার্থীর পক্ষে কাজ করেছেন। কিন্তু তারা মনেপ্রাণে নৌকাকে ভালোবাসেন। এখানে তারা নৌকা নয়, ব্যক্তির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ হওয়া তো দূরের কথা, প্রশাসন পুরোপুরি নৌকার প্রার্থীর পক্ষে কাজ করে। তা না হলে বিপুল ভোটে স্বতন্ত্র প্রার্থী জয়লাভ করতে পারতেন। কিন্তু নির্বাচনের পর তাদের ওপর এভাবে হামলা হবে তা তারা কোনোদিন কল্পনা করেননি। কারণ সবাই তো সরকারি দলের নেতাকর্মী। অনেকে আফসোস ও ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আমরা কোনো কোনো পরিবার দুই-তিন পুরুষ ধরে আওয়ামী লীগ করছি। অথচ নারকীয় হামলা ও লুটপাট হওয়ার পরও প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। এটা খুবই দুঃখজনক। এ রকম হলে তো অনেকে দল ছেড়ে দেবে। জানতে চাইলে পৌর মেয়র ও আওয়ামী লীগ নেতা কাজী আশরাফুল আজম অভিযোগ করে যুগান্তরকে বলেন, আমরা দলীয় হাইকমান্ডের নির্দেশে উৎসবমুখর পরিবেশে একটি অবাধ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে ছিলাম। নৌকা নয়, ব্যক্তির বিরুদ্ধে ছিলাম। দলীয়ভাবে যদি নির্বাচন উন্মুক্ত করা না হতো তাহলে দলীয় প্রার্থীর বাইরে যেতাম না। এখন নির্বাচন শেষ হওয়ার পর আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের ওপর হামলা ও লুটপাট অব্যাহত আছে। তিনি বলেন, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সদ্যসমাপ্ত সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী আব্দুল হাইয়ের নির্দেশে পুলিশ কোনো মামলা নিচ্ছে না। বিষয়টি নিয়ে পুলিশ সুপারের সঙ্গে দেখা করে বলার পরও কোনো প্রতিকার পাইনি।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এসপি সাহেবের কাছে গিয়ে অভিযোগ দিলে বলেন, দেখতেছি, আপনি যান। সার্কেল সাহেবও বলেন একই কথা। আর ওসি বলেন, অভিযোগ লেখা হয়নি, বাদীকে থানায় পাঠিয়ে দিয়েন। আমরা ঘটনা শুনে লিখে দেব। আবার বাদী থানায় গেলে ওসি দেখা করেন না। এই করতে করতে ১৫ দিন চলে গেল, কোনো ঘটনারই মামলা হয়নি। শৈলকুপার সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা নায়েব আলী জোয়ার্দার বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ করেছি। জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলাম। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর দুই বছর ভারতে পালিয়ে ছিলাম। জিয়ার আমলে বারবার নিরাপত্তাহীনতায় পালিয়ে থাকতে হয়েছে। তখনো ভেঙে পড়িনি। এখন দল ক্ষমতায়, অথচ আমার বাড়িঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা চালানো হয়েছে। অভিযোগ দিলে আমলে নিচ্ছে না পুলিশ।’ তিনি বলেন, দলের সর্বোচ্চ ফোরাম থেকে বলা হলো-যে যার মতো নির্বাচনে অংশ নেবে, সমর্থন করবে, কোনো বাধা দেওয়া হবে না। এখন কেন শৈলকুপা আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে থাকা আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীর বাড়িতে হামলা হবে? আর হামলাকারীদের বিরুদ্ধে কেন আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে না। তিনি বলেন, গ্রামের কৃষক পর্যন্ত মাঠে যেতে পারছে না। এ অবস্থায় পুলিশি হেফাজতে এভাবে অপরাধীদের উৎসাহিত করা হলে অপরাধ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে।’

অন্তত অর্ধশত বাড়িঘরে হামলার বর্ণনা দেন এই আওয়ামী লীগ নেতা। তিনি এজাহারভুক্ত অপরাধীদের দ্রুত আইনের আওতায় আনার আহ্বান জানান।

এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নবনির্বাচিত সংসদ-সদস্য আব্দুল হাই বলেন, ‘আমার লোকজন কাউকে আক্রমণ করছে না। বরং আমার লোকজনকে ওরা মারছে। মামলাও হচ্ছে আমার লোকজনের বিরুদ্ধে।’ কী মামলা হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ১৬ ডিসেম্বর পোস্টার ছিঁড়ে ফেলার মামলা হয় আমার বিরুদ্ধে। যে পোস্টার টানানোর অনুমতি আসে ১৮ তারিখ, সেই পোস্টার ১৬ তারিখ ছিঁড়ে ফেললাম কীভাবে? স্বতন্ত্র প্রার্থী আমার বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট করে। আরেকটি মামলায় ওয়ারেন্টও হয়ে যায়। তিনি দাবি করে বলেন, ‘আমি মামলা না নেওয়ার বিষয়ে পুলিশকে কিছুই বলিনি।’

যুগান্তরের তথ্যানুসন্ধানে শুধু শৈলকুপায় নির্বাচনি সহিংসতার বিষয়ে ১৩টি লিখিত অভিযোগ পাওয়া গেছে। যার সবকটিই শৈলকুপা ওসি বরাবর দেওয়া। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এসব অভিযোগের একটিও মামলা হিসাবে নথিভুক্ত হয়নি। এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে শৈলকুপা থানার ওসি মো. আমিনুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, শৈলকুপা থানায় নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতার বিষয়ে ৯টি মামলা হয়। এর মধ্যে নৌকার পক্ষে ৫টি এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে ৪টি। যেসব অভিযোগকারী থানায় আসছেন না। যে কারণে তাদের মামলা নেওয়া হচ্ছে না।

ঝিনাইদহ পুলিশ সুপার মো. আজিম-উল-আহসান বলেন, অভিযোগ নেওয়া হচ্ছে না এমন বক্তব্য সঠিক নয়। যারা অভিযোগ দেননি সেসব ঘটনাও তদন্ত করা হচ্ছে। গত ১৫ দিনে তো প্রায় ১৪টি লিখিত অভিযোগ মামলা হিসাবে নথিভুক্ত হয়নি। এর কারণ মামলা নেওয়ার আগে প্রতিটি অভিযোগ তদন্ত করা হচ্ছে। তদন্ত শেষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

যত অভিযোগ : শৈলকুপার হাজামপাড়ার মো. ছাবের আলী ২২ জনের বিরুদ্ধে থানায় লিখিত অভিযোগ করে বলেন, ৮ জানুয়ারি বেলা ১১টার দিকে বাক্কেস মণ্ডলের নেতৃত্বে তার ভাতিজা নূর ইসলামের বাড়িতে হামলা চালানো হয়। এ সময় টিপু (৩২) নামে তার আরেক ভাতিজা বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলে তাকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে আহত করে সন্ত্রাসীরা। সংঘবদ্ধ অবস্থায় আসামিরা বসতবাড়ি ভাঙচুরসহ মূল্যবান জিনিসপত্র লুটপাট করে। এতে কয়েক লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়।

ব্রাহিমপুরের মৃত আনছার মোল্লার ছেলে ঝন্টু মোল্লা ২১ জনের বিরুদ্ধে থানায় লিখিত অভিযোগ করে বলেন, দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে তিনিসহ পরিবারের লোকজন স্বতন্ত্র প্রার্থী ট্রাক প্রতীকের মো. নজরুল ইসলাম দুলাল বিশ্বাসের সমর্থক ছিলেন। আসামিরা নৌকা প্রতীকের সমর্থক। নির্বাচনের পরের দিন ৮ জানুয়ারি সকাল সাড়ে ৭টার দিকে রামদাসহ দেশীয় অস্ত্র নিয়ে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে অকথ্য ভাষায় গালাগালি করে সবাইকে বের করে দেয়। এরপরই তারা তাণ্ডবলীলা চালায়। এ সময় তারা ৫ রুমবিশিষ্ট আধাপাকা বসতঘরের দরজা, জানালা ভাঙচুর করে। ঘরের ভেতরে ঢুকে স্বর্ণালংকারসহ প্রায় ৫ লাখ টাকার মূল্যবান জিনিসপত্র লুট করে। একই গ্রামের শিহাব মোল্লা থানা ওসির কাছে ২১ জনের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ করে বলেন, একইদিন ভোর সাড়ে ৬টার দিকে দেশীয় অস্ত্র নিয়ে বাড়ির লোকজনকে জিম্মি করে নগদ ৫০ হাজার টাকা, স্বর্ণালংকারসহ অন্তত তিন লাখ টাকার মূল্যবান জিনিসপত্রসহ লুটপাট করে। এছাড়া বাড়ির দরজা, জানালা, শোকেস, খাট ও গ্যাসের চুলাসহ দামি জিনিসপত্র ভাঙচুর করে প্রায় দুই লাখ টাকার ক্ষতি করে।

তাইজাল হোসেন মোল্লার ছেলে রোকনুজ্জামান ২০ জনের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ করে বলেন, তার তিন রুমবিশিষ্ট আধাপাকা বসতঘরসহ আসবাবপত্র ও পালসার মোটরসাইকেল ভাঙচুর করা হয়। সন্ত্রাসীরা নগদ ৫ লাখ টাকাও নিয়ে যায়।

আদম মোল্লার ছেলে কামরুল হাসান ২১ জনের বিরুদ্ধে লুটপাট, বাড়ি ভাঙচুরসহ লাখ লাখ টাকার ক্ষতির কথা উল্লেখ করে অভিযোগ করেন। ব্রাহিমপুরের আবু বক্কর মোল্লা বসতঘরসহ আসবাবপত্র ভাঙচুরসহ দামি জিনিসপত্র লুটপাটের লিখিত অভিযোগ করেন। এছাড়া বাজারপাড়ার আফান মণ্ডলের ছেলে লাল্টু, মধ্যপাড়ার মরহুম খন্দকার নুর হোসেনের ছেলে হাবিবুল্লাহ লিটন, দুধসর চরের রহিম মণ্ডলের ছেলে লিটন হোসেন, মৃত জহর আলী সরদারের ছেলে তোতা সরদার, দুধসর মধ্যপাড়া গ্রামের মৃত নছর উদ্দিনের ছেলে লালন শেখ, জমির শেখের ছেলে মনিরুল ইসলাম ওরফে গোলাম আলী, দুধসর মোল্লা পাড়ার আব্দুল জলিল মণ্ডলের ছেলে তরিকুল ইসলাম, দুধসর সর্দারপাড়ার বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলীর ছেলে জাহিদুল ইসলামসহ আরও বেশ কয়েকজন মামলা নেওয়ার আবেদন জানিয়ে থানায় লিখিত অভিযোগ দেন। তারাও তাদের বসতবাড়ি ভাঙচুরসহ দামি জিনিসপত্র লুটপাটের অভিযোগ করেন। এসব ঘটনায় একটি মামলাও নেওয়া হয়নি।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম