শিশুমৃত্যুর তদন্ত প্রতিবেদন জমা
চিকিৎসায় অবহেলার প্রমাণ মিলেছে
ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ তদন্তে ৫ সদস্যের কমিটি
জাহিদ হাসান
প্রকাশ: ১৯ জানুয়ারি ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভুল চিকিৎসায় শিশু আয়ানের মৃত্যুর ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। এতে সুন্নাতে খতনা করানোর সময় রাজধানীর বাড্ডার সাতাকুল এলাকার হাসপাতালটির চিকিৎসকদের অবহেলার প্রমাণ মিলেছে।
এমনকি দুর্ঘটনা ঘটার পর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণে সময়ক্ষেপণ করেছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। তবে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলছেন, তিনি এখনো প্রতিবেদনের কপি হাতে পাননি। ইউনাইটেড হাসপাতালে ভুল চিকিৎসায় গত ৭ জানুয়ারি রাত ১টার দিকে মারা যায় ৫ বছরের শিশু আয়ান।
পরদিন ৮ জানুয়ারি শিশুটির পরিবার গণমাধ্যমে অভিযোগ করেন ৩১ ডিসেম্বর খতনার পর আয়ানের মৃত্যু হয়। এর পরও কর্তৃপক্ষ ঘটনা গোপন রেখে ছয় লাখ টাকার বিল দ্রুত পরিশোধের দাবি করে। হাসপাতালে সুন্নতে খতনা করার পর এক সপ্তাহ ধরে চিকিৎসাধীন থাকার পর আয়ানের মৃত্যুর ঘটনা কীভাবে কোন কারণে ঘটেছে তা যথাযথ অনুসন্ধান করার নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। এক সপ্তাহের মধ্যে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়।
মৃত্যুর ঘটনায় চিকিৎসকদের অবহেলা পেলে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্যও বলে হাইকোর্ট। তখন অধিদপ্তর সরেজমিন পরিদর্শন করে হাসপাতালটির নিবন্ধন নবায়ন না থাকায় কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়।
উচ্চ আদালতের নির্দেশে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর মুগদা জেনারেল হাসপাতালের শিশু সার্জারি বিভাগের প্রধানের নেতৃত্বে চার সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করে। কমিটির অন্য তিন সদস্যের মধ্যে একজন মুগদা হাসপাতালের অ্যানেসথেসিয়া বিভাগের বিশেষজ্ঞ, আরেকজন মুগদা হাসপাতালেরই একজন সহকারী পরিচালক। এছাড়া স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একজন সহকারী পরিচালকও ছিলেন কমিটিতে। ১০ কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের সময় নির্ধারণ করা হয়। যার শেষ দিন ছিল বৃহস্পতিবার।
এদিন সন্ধ্যায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মাদ খুরশীদ আলম যুগান্তরকে বলেন, ‘আয়ানের মৃত্যুর ঘটনায় অধিদপ্তরের হাসপাতাল ও ক্লিনিক শাখা কর্তৃক গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছি। প্রতিবেদনে কী উল্লেখ রয়েছে সেটা বলা যাবে না। এ বিষয়ে আমাদের বলার এখতিয়ার দেয়নি। না হলে অবশ্যই বলতাম। যেহেতু মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছি, আগে তারা দেখবে। সেখান থেকেই সবাই জানতে পারবেন।
স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেনের কাছে জানতে চাইলে তিনি যুগান্তরকে বলেন, অফিসিয়ালি জমা দেওয়ায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তদন্ত কমিটির রিপোর্ট এখনো আমার হাতে আসেনি। অবশ্যই রিপোর্ট দেখব। আমি আগেও বলেছি, দোষী সাব্যস্ত হলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কোনো ছাড় দেওয়া হবে না। তাছাড়া শিশুটির মৃত্যুর ঘটনা তদন্ত করতে নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেটিও গণমাধ্যমে বলেছি।
এই প্রতিবেদক তদন্ত কমিটির অন্য সদস্যদের সঙ্গেও কথা বলেন। কিন্তু কেউ নিজেদের নাম প্রকাশ করে কোনো তথ্য জানাতে রাজি হননি। তবে জানা যায়, শিশুটির মৃত্যুর জন্য হাসপাতালের চিকিৎসকদের চিকিৎসা অবহেলার প্রমাণ পেয়েছে কমিটি। দুর্ঘটনা ঘটার পর হাসপাতালের কর্তৃপক্ষ তাৎক্ষণিকভাবে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে সময় ক্ষেপণেরও প্রমাণ মিলেছে।
এর আগে গত রোববার (১০ জানুয়ারি) স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. আবু হোসেন মো. মঈনুল আহসান স্বাক্ষরিত অফিস আদেশে বলা হয়, হাসপাতালটিতে পরিদর্শনে গিয়ে ওই লাইসেন্সসহ জরুরি কাগজপত্র পাননি। এছাড়া দপ্তরের অনলাইন ডাটাবেজ পর্যালোচনা এবং পরিদর্শনকালে সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করে দেখা যায়, ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল নামে কোনো প্রতিষ্ঠান স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিকট নিবন্ধন/লাইসেন্সপ্রাপ্তির জন্য কখনোই অনলাইন আবেদন করেনি। প্রতিষ্ঠানটি কোনো প্রকার আইনানুগ নিবন্ধন অথবা লাইসেন্স ব্যতিরেকে চিকিৎসাসেবা নির্মাণাধীন ভবনে পরিচালনা করে আসছে, যা সরকারের প্রচলিত আইনের পরিপন্থি।
ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ নিয়ে তদন্তে ৫ সদস্যের কমিটি : এদিকে সাতারকুলের ইউনাইটেড হাসপাতালের পর ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ পরিদর্শন ও তদন্ত করতে নতুন করে পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করেছে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর। বুধবার স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক (প্রশাসন) ডা. মোহাম্মদ হুমায়ুন কবীর স্বাক্ষরিত এক আদেশে এ তথ্য জানানো হয়।
আদেশে বলা হয়, ‘শিশু আয়ানের মৃত্যু : ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল বন্ধের নির্দেশ’ শিরোনামে গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের পরিপ্রেক্ষিতে ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ পরিদর্শন/তদন্তের জন্য কমিটি গঠন করা হলো।
তদন্ত কমিটির সভাপতি স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. বায়জীদ খুরশীদ রিয়াজ। সদস্য হিসাবে গাজীপুর শহিদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. মো. আমীর হোসাইন, স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবারকল্যাণ বিভাগের যুগ্ম সচিব মোহাম্মদ আবদুল কাদের, স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক (সরকারি মেডিকেল কলেজ) ডা. মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান, স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক (পরিকল্পনা) ডা. সায়মা আখতার চৌধুরীকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক এবিএম খুরশিদ আলমের অনুমোদন রয়েছে। পাশাপাশি আগামী দুই কর্মদিবসের মধ্যে মহাপরিচালক স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর বরাবর প্রতিবেদন দাখিল করবেন। তদন্ত কমিটি বৃহস্পতিবার বেলা ১১টায় মেডিকেল কলেজটি পরিদর্শনে করে।
অধিদপ্তরের তদন্ত প্রতিবেদন সম্পর্কে ইউনাটেড হাসপাতালের জনসংযোগ কর্মকর্তা আরিফুল হক যুগান্তরকে বলেন, আমরাও অধিদপ্তরের তদন্ত প্রতিবেদনের কপি অফিসিয়ালি হাতে পাইনি, ফলে বিষয়টি নিয়ে মন্তব্য করতে চাচ্ছি না।