কর্মসূচি নির্ধারণে সমমনাদের সঙ্গে বৈঠক
সংগঠিত হয়ে ফের মাঠে নামতে চায় বিএনপি
নেতাদের জামিন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা ও বিদেশিদের ভূমিকার দিকে নজর
সরকারবিরোধী আন্দোলনের মধ্যেই শেষ হয়েছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এতে বিএনপিসহ অনেক রাজনৈতিক দল অংশ নেয়নি। নিরঙ্কুশ জয় পেয়ে টানা চতুর্থবারের মতো সরকার গঠন করেছে আওয়ামী লীগ। সমাবেশ, বিক্ষোভ, গণসংযোগ, হরতাল, অবরোধ ও অসহযোগ আন্দোলনেও নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেনি বিরোধীরা। আদায় হয়নি কোনো দাবি-দাওয়া। উলটো নানাভাবে কোণঠাসা এখন বিএনপি। দলটির মহাসচিবসহ শীর্ষ নেতাদের অনেকেই কারাবন্দি। এখনো আত্মগোপনে অনেকে। তবে দাবি আদায়ে এখনো আত্মবিশ্বাসী তারা। এজন্য চলমান আন্দোলন অব্যাহত রাখতে চায়। সংগঠিত হয়ে ফের রাজপথে নামার পরিকল্পনাও করা হচ্ছে। নতুন আঙ্গিকে ‘ছক’ কষছেন নীতিনির্ধারকরা। কর্মসূচি ঠিক করতে সমমনা দলগুলোর সঙ্গে বৈঠকও করছেন। শান্তিপূর্ণ সভা, সমাবেশের মধ্যে দিয়ে মাঠে নামতে চান। পাশাপাশি কারাগারে থাকা নেতাকর্মীদের জামিন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা ও গণতান্ত্রিক বিশ্বের ভূমিকার দিকেও নজর রাখছেন। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
নেতারা জানান, জনগণ ভোট বর্জন করেছেন। তাই প্রাথমিকভাবে তাদের আন্দোলন সফল। এখন পরিস্থিতি বুঝে সুবিধামতো সময়ে সরকারকে চাপে ফেলতে চান। তারা বিশ্বাস করেন, ‘একতরফা’ ও ‘কারচুপির’ নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ নতুন সরকার গঠন করলেও বেশিদিন ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে পারবে না। বহির্বিশ্বের চাপসহ বিএনপি ও তার মিত্রদের আন্দোলনের মধ্যদিয়েই সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করা হবে। ইতোমধ্যে সরকারের বিরুদ্ধে কর্মসূচিতে জনগণের সাড়া পড়েছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান যুগান্তরকে বলেন, বাংলাদেশের গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আমরা রাজপথে আছি, থাকব। গণতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণভাবে যেসব আন্দোলন করা যায় বিএনপি তা করবে।
দলীয় সূত্র জানায়, ৭ জানুয়ারির পর সমমনা দলগুলোর সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠক করছে বিএনপি। আজ-কালের মধ্যে গণতন্ত্র মঞ্চসহ আন্দোলনের শরিক দলগুলোর সঙ্গেও বৈঠক করার কথা রয়েছে। বৈঠকে সুপারিশগুলো পর্যালোচনা করে নতুন কর্মসূচি নির্ধারণ করবে বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটি।
এদিকে মন্ত্রিসভার শপথের দিন বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে তালা ভেঙে প্রবেশ, চেয়ারপারসনের হাসপাতাল থেকে বাসায় যাওয়া, আত্মগোপনে থাকা অনেক নেতার জনসম্মুখে আসা-এ নিয়ে নানা মহলে ‘কৌতূহল’ সৃষ্টি হয়েছে। অনেকে বলছেন, ভোটের আগে কেন তালা ভেঙে কার্যালয়ে যেতে পারেননি নেতাকর্মীরা। আত্মগোপনে থাকা নেতারাও কেন ভোটের পর বের হচ্ছেন। আবার কার্যালয়ে প্রবেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো ধরনের বাধাও পাননি। আবার ভোটের পর বিএনপি মহাসচিবকে নয় মামলায় জামিনও দেওয়া হলো (এখনো দুই মামলায় জামিন হয়নি)। এসব বিষয় কোনো ধরনের ‘ইঙ্গিত’ কিনা তাও কেউ কেউ বলছেন।
তবে এ নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলার সুযোগ নেই বলছেন বিএনপির নেতারা। তারা বলেন, গুলশান ও নয়াপল্টন কার্যালয়ে ঢোকার সিদ্ধান্ত ছিল স্থায়ী কমিটির। চেয়ারপারসনের শারীরিক অসুস্থতার বিষয়টি সম্পূর্ণ দেখভাল করে মেডিকেল বোর্ড। তাদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সবকিছু হয়। তাদের পরামর্শ অনুযায়ীই বাসায় গিয়েছেন। বাসায় থেকেই তার চিকিৎসা চলবে। আর জোর করে একতরফা নির্বাচন করার অংশ হিসাবেই বিএনপি মহাসচিবসহ নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করা হয়েছে-তা স্পষ্ট। এসব নেতাদের বিরুদ্ধে যে মামলা দিয়েছে, যার সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্কই নেই। এসব মামলায় স্বাভাবিকভাবেই তারা জামিন পান।
এদিকে ভোটের পর যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়াসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিবৃতি নিয়ে পর্যালোচনা করেছেন বিএনপি নেতারা। দলটির বৈদেশিক সম্পর্ক বিষয়ে দেখভাল করেন এমন একজন নেতা যুগান্তরকে বলেন, যারা ভাবছেন নির্বাচন নিয়ে তাদের বিবৃতি ‘নরম’ হয়েছে এটা ঠিক নয়। তাদের বিবৃতির ভাষা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, নির্বাচনকে তারা বৈধতা দেয়নি। বিবৃতিতে নির্বাচন ও গণতন্ত্র নিয়ে যে ভাষা ব্যাবহার করেছেন বড় গণতান্ত্রিক দেশ হিসাবে এর চেয়ে বেশি কখনও তারা বলেন না। এটাই তাদের কূটনীতিক কঠোর ভাষা। তারা গণতন্ত্র যেভাবে চর্চা করে, কূটনীতিতেও অনেক বেশি পারদর্শী। নির্বাচন, সহিংসতা, গণতন্ত্রসহ যেসব বিষয়ে আগে তারা জোর দিয়ে কথা বলেছেন, বাংলাদেশে তার একটিও বাস্তবায়ন হয়নি। বরং বিরোধী দলের শীর্ষ নেতা থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যন্ত নেতাকর্মীদের গণহারে গ্রেফতার করেছে, একতরফা ও কারচুপির নির্বাচন করেছে। দেশ এখন একদলীয় রাষ্ট্র। যেখানে গণতন্ত্রকে পুরোপুরিভাবে হত্যা করা হয়েছে। আশা করেন, বাংলাদেশের জনগণের আকাক্সক্ষার সঙ্গে মিল রেখে এসব নিয়ে গণতান্ত্রিক বিশ্ব আরও সোচ্চার হবে। পাশাপাশি বিরোধী সব দলকে এক করে আবারও সরকারের পদত্যাগ ও নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের একদফা দাবিতে মাঠের আন্দোলনে নামারও পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
ওই নেতা আরও জানান-সিয়েরা লিওন, উগান্ডা, জিম্বাবুয়েসহ কয়েকটি দেশে যুক্তরাষ্ট্র ভিসানীতি প্রয়োগ ও নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। তা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র যা প্রত্যাশা করেছিল, ওইসব দেশেও একই প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু সেসব দেশেও তা বাস্তবায়ন করা হয়নি। যে কারণে দেশটি ভিসানীতি প্রয়োগ ও নানা নিষেধাজ্ঞা দেয়। এবং তা কিন্তু ভোটের পরপরই দেওয়া হয়নি। কোনো দেশে ভোটের দেড় মাস পর, আবারও এমন দেশ রয়েছে এক বছর পর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। কারণ তারা যা করেন তা নিয়ে প্রশ্ন করার কোনো সুযোগ দেন না। অর্থাৎ শতভাগ নিশ্চিত হয়ে তারা পদক্ষেপ নেন। যদিও বিএনপি কোনো বিদেশিদের দিকে তাকিয়ে নেই। বিএনপি মনে করে জনগণের ভোট বর্জনের মধ্য দিয়ে তাদের আন্দোলন শতভাগ সফল। তবে অনেকে বলছেন, সরকারের তো পতন হয়নি। তাদের জন্য বলা প্রয়োজন, বিএনপি কোনো জঙ্গি বা ক্যাডারভিত্তিক সংগঠন নয়। বিএনপি গণতান্ত্রিক ও উদারপন্থি একটি রাজনৈতিক দল। শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে তারা বিশ্বাস করেন। ইতিহাস বলে, ফ্যাসিবাদ ও একদলীয় রাষ্ট্র কোনোদিন টিকেনি। এই সরকারও টিকবে না, পতন হবেই। সুতরাং হতাশার কিছু নেই।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য বলেন, দীর্ঘদিনের আন্দোলনে সরকার পতন নিশ্চিত না হলেও সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে বিএনপি। জনগণ বিএনপি ও সমমনাদের ডাকে নির্বাচন ও ভোট বর্জন করেছেন। অসহযোগ আন্দোলনকে সমর্থন করেছেন। এবার নতুন আঙ্গিকে আন্দোলন শুরু হবে। প্রথমদিকে সভা-সমাবেশের মধ্যদিয়ে নেতাকর্মীদের আবারও সংগঠিত করা হবে। ক্রমান্বয়ে আন্দোলনের গতি বাড়বে। আগামী দিনের আন্দোলনের বিষয়ে সমমনাদের সঙ্গে বৈঠক চলছে। তাদের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষ পরবর্তী কর্মসূচি আসবে। শিগগিরই তা ঘোষণা করা হবে। সরকার যদি গ্রেফতার, মামলা, হামলা ও হয়রানি অব্যাহত রাখে, সেক্ষেত্রে অবরোধ, হরতালের মতো কর্মসূচিও আসতে পারে।
যুগপৎ আন্দোলনে থাকা লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি-এলডিপির প্রেসিডেন্ট কর্নেল (অব.) ড. অলি আহমদ যুগান্তরকে বলেন, বর্তমান সরকার জনগণের ভোটে নির্বাচিত নয়। সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তারা নিজেদের মধ্যে নির্বাচন করে পদগুলো (এমপি) ঘোষণা করেছে। নির্বাচিত হয়েছে দিনের বেলায় গোপন কক্ষে সিল মারার ভোটে। সুতরাং অর্থনৈতিক, সামজিক যে সংকট সৃষ্টি হয়েছে, রাজনৈতিক যে শূন্যতা বিরাজ করছে, মানুষ বিচারহীনতায় ভুগছে এগুলো পূরণ করা সম্ভব নয়। এই সরকারের বিদায় সময়ের ব্যাপার। আমাদের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে।
গণতন্ত্র মঞ্চের শীর্ষ নেতা ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, ডামি নির্বাচনের মধ্য দিয়ে যে সরকার গঠন করেছে, তাদের কোনো বৈধতা নেই। দেশব্যাপী সভা, সমাবেশে, বিক্ষোভ, অবস্থান, ঘেরাও এসব কর্মসূচি আসতে পারে। পরিস্থিতি বুঝে হরতাল-অবরোধের মতো বৃহৎ কর্মসূচিতে যাব।