Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

আমরা কতটুকু বিজয়ী?

Icon

ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন

প্রকাশ: ১৬ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

আমরা কতটুকু বিজয়ী?

১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১। বাঙালির রাজনৈতিক বিবর্তনের ইতিহাসে একটি লাল তারিখ। কারণ সেদিন অপরাহ্নে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী পরাস্ত হয়ে আত্মসমর্পণ করেছিল। বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত হয়েছিল। আমরা বিজয়ী হয়েছিলাম; স্বাধীন তো সে বছর ২৬ মার্চ হয়েছিলাম বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার বার্তা পেয়ে। আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশ শত্রুকবলিত ছিল। আর সে কারণে ১৬ ডিসেম্বর আমাদের বিজয় দিবস-মুক্তিযুদ্ধের সফল সমাপনী পর্ব। কিন্তু বিজয়ের ৫২ বছর পর আজ প্রশ্ন : আমরা কতটুকু বিজয়ী?

প্রশ্নটি ওঠে দুজনের মন্তব্যের কারণে। প্রয়াত মার্কিন ইতিহাসবিদ হানাহ্ আরেন্ডেট তার ‘Freedom’ প্রবন্ধে বলেছিলেন, ‘Freedom means responsibility’-অর্থাৎ স্বাধীনতা মানে দায়িত্বশীলতা। বঙ্গবন্ধু ২ অক্টোবর ১৯৭২ গণপরিষদে অভিন্ন মন্তব্য করেছিলেন। সুতরাং দু’জনের মন্তব্যের ধারাবাহিকতায় আমাদের প্রশ্ন হলো : আমরা কি এত বছরে স্বাধীনতার প্রতি দায়িত্ব পালন করতে পেরেছি? মোটা দাগে প্রশ্নটির উত্তর মিশ্র হতে বাধ্য, এবং তা বস্তুনিষ্ঠ প্রেক্ষাপটে।

১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণ করেছিল পাকিস্তানি দখলদার বাহিনি; কিন্তু রাজাকার বা পাকিস্তানি দোসর বাহিনি নয়, যারা এখন নানাভাবে দৃশ্যমান। তারা তো রাজনীতিও করছে। যারা বাংলাদেশের লক্ষ্য-আদর্শে বিশ্বাসী নয়, তাদের এদেশে রাজনীতি করার অধিকার আছে কি? অবশ্য ২০০১-০৬-এ তারা রাষ্ট্রক্ষমতার অংশীদারও ছিল, তাদের গাড়িতে বাংলাদেশের পতাকা উড়েছিল। এটা তাদের ও আমাদের উভয়েরই লজ্জা ও আত্মগ্লানির। অবশ্য যারা ধর্মভিত্তিক রাজনীতি করে, তাদের লজ্জা বা আত্মগ্লানি বলতে কিছু থাকে না, তাদের কাছে ক্ষমতাই সব-এটা আমাদের বাস্তব অভিজ্ঞতা। ধর্মের ভিত্তিতে দল বা রাজনীতি সম্ভব নয়; তাহলে নবিজী (সা.) তা করতেন। ধর্ম ব্যক্তিগত বিশ্বাস ও আচরণের ব্যাপার। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার।

গত ৫২ বছরে রাষ্ট্রের চরিত্রে অদল-বদল হয়েছে। ’৭৫ থেকে ’৯৬ পর্যন্ত বাংলাদেশ হয়েছিল পাকিস্তান আদলের রাষ্ট্র, রাজাকারদের পুনর্বাসন হয়েছিল তখন। বলা হয়, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরে আসায় বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের গতিমুখে ফিরেছে। আসলে কি তাই? তা নয় অন্তত দুটো কারণে। এক. ১০ জানুয়ারি ১৯৭২-এর ভাষণ অনুযায়ী বঙ্গবন্ধু একটি আদর্শভিত্তিক ধর্মনিরপেক্ষ মানুষের রাষ্ট্র গড়তে চেয়েছিলেন, যা এখন যেন দিল্লি দূরঅস্ত। এখন সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম আছে, যা সামরিক শাসকের অবদান, এবং যাকে আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক কারণে সাদরে গ্রহণ করেছে (পনেরোতম সংশোধনী, ২০১৯)। দুই. সাম্প্রতিককালে ক্ষমতাসীন সরকারের রাজনৈতিক আপস ও আদর্শচ্যুতি বড় পীড়াদায়ক।

’৭২-এর সংবিধানের ৭(১) ধারা অনুযায়ী জনগণই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সব ক্ষমতার মালিক। এমন সাংবিধানিক ধারা যে, বিরাজমান বাস্তবতা থেকে যোজন যোজন দূরে, তা বলার জন্য খুব বেশি তথ্য-যুক্তির প্রয়োজন পড়ে না। বাংলাদেশ তো এখন আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্র, যা সংবিধান ও বিজয়ের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

বাংলাদেশ এখন প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে বিশ্বের বিস্ময়। কিন্তু যাকে বলে উন্নয়ন, তা তো ধরাছোঁয়ার বাইরে এখনো। উন্নয়ন মানে সমতাভিত্তিক প্রবৃদ্ধি। মুখ ব্যাদান করে থাকা ক্রমবর্দ্ধমান বৈষম্য উন্নয়নের সরকারি গীতকে মশকরা করে। যথার্থ উন্নয়নের জন্য সরকারি আন্তরিকতা ও পদক্ষেপ প্রয়োজন। তা কোথায়?

শিক্ষার তো হ-য-ব-র-ল অবস্থা এখন। সংখ্যাবাচক প্রবৃদ্ধি দৃশ্যমান, কিন্তু গুণবাচক গভীরতা এখনো সুদূরপরাহত। শিক্ষিত জাতি পেতে শিক্ষিত শিক্ষক প্রয়োজন। শিক্ষা-ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যারা জড়িত, তারা নিয়োগ পান দলীয় সংশ্লিষ্টতার কারণে, মেধা-মনন বা ব্যক্তিগত ভাবমূর্তির কারণে নয়, ফলে যা হওয়ার তা-ই হয়েছে। বাংলাদেশের কোনো আইন আজও পর্যন্ত যাকে বলে বিউপনিবেশিকরণ, তা হয়নি। তাহলে স্বাধীন বাংলাদেশ কি স্বাধীন আইনে চলছে?

তীর্যক বক্তব্য আরও সম্প্রসারিত হতে পারতো। তবে মোদ্দাকথা দুটো। এক. আমরা আমাদের দায়িত্ব পালনে মিশ্র ভূমিকা পালন করেছি, যার ফলে কাঙ্ক্ষিত রাষ্ট্র এখনো অধরা। দুই. মুক্তিযুদ্ধ ও বিজয়-চেতনার পরিপূরক কর্মকাণ্ড এখনো দৃশ্যমান নয়। আমরা স্বপ্নের রূপায়ন চাই, অপমৃত্যু অনাকাঙ্ক্ষিত।

ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন : চেয়ার অধ্যাপক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব চেয়ার, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস (বিইউপি)

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম