৪ হাজার কিলোমিটার রেলপথ অরক্ষিত
রেলপথে সেন্সর বসানোর কোনো উদ্যোগ নেই
অজ্ঞাত দুষ্কৃতকারীদের বিরুদ্ধে মামলা * ভরসা পুলিশ-আনসারের ম্যানুয়াল পাহারা
শিপন হাবীব, ঢাকা ও শাহ সামসুল হক রিপন, গাজীপুর
প্রকাশ: ১৫ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
রেলপথে সেন্সর বসানোর কোনো উদ্যোগ নেই
রেলওয়ে কর্মীদের টর্চলাইট আর পুলিশ-আনসারের ম্যানুয়াল পাহারায় রেলপথের নিরাপত্তার দায় সারছে কর্তৃপক্ষ। কিন্তু পাশের দেশ ভারতের রেললাইনে আধুনিক সেন্সর পদ্ধতি বসানো হচ্ছে। তবে দেশে এমন উদ্যোগ না থাকলেও রেলপথের দৈর্ঘ্য বাড়ছে। সর্বশেষ চট্টগ্রাম-কক্সবাজার, ঢাকা-ভাঙ্গা এবং খুলনা-মোংলা রুটে ৩০০ কিলোমিটার আধুনিক রেলপথ নির্মাণ করা হয়েছে। এদিকে, রেলপথের যথাযথ নিরাপত্তা না থাকায় গাজীপুরের শ্রীপুরে প্রায় ২০ ফুট রেললাইন কেটে ফেলা হয়েছে। এ কারণে ইঞ্জিনসহ মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসের সাতটি কোচ ছিটকে পড়ে। হতাহতের ঘটনা ঘটে। এ দুর্ঘটনার জন্য নাশকতাকেই দায়ী করছে সংশ্লিষ্টরা। ঘটনাস্থল থেকে গ্যাস সিলিন্ডার ও কাটার উদ্ধার হওয়ায় তা আরও স্পষ্ট হয়েছে। এ ঘটনায় বৃহস্পতিবার ঢাকা রেলওয়ে থানায় মামলা হয়েছে। আগামী রোব বা সোমবার তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন জমা দিতে পারে বলে কমিটির আহ্বায়ক জানিয়েছেন।
সংশ্লিষ্টরা জানান, রেলপথে সেন্সর থাকলে কেন্দ্রীয় সার্ভারের মাধ্যমে পুরো রেলপথের সার্বিক অবস্থা জানা যায়। কোথাও লাইন বিচ্ছিন্ন বা কোনো অসঙ্গতি থাকলে সার্ভারে তা ধরা পড়ে। এতে দুর্ঘটনা রোধ করা সম্ভব হয়। সম্প্রতি কয়েকটি রেল দুর্ঘটনার পর রেলপথের নিরাপত্তা নিয়ে সমালোচনা চলছে। রেলের মান্ধাতা আমলের নিরাপত্তাপদ্ধতি নিয়ে অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন। একই সঙ্গে দিন দিন বাড়ছে নাশকতার শঙ্কা। রাত গভীর হলে যাত্রীদের মাঝে ভর করে দুর্ঘটনার আতঙ্ক। এটি এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে, যাত্রীদের অনেকে টিকিট ফেরত দিয়ে যাত্রা বাতিল করছেন। গাজীপুরে রেললাইন কেটে নাশকতায় জড়িতদের কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ।
গাজীপুরে রেললাইন কেটে ফেলায় বুধবার ভোর ৪টার দিকে মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস দুর্ঘটনায় পড়ে। তাৎক্ষণিক উদ্ধার কাজ শুরু হলেও প্রায় ১৫ ঘণ্টা পর লাইন মেরামত সম্ভব হয়। দুর্ঘটনার পর ঢাকার সঙ্গে উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চলে ট্রেনের শিডিউল বিপর্যয় ঘটে। এদিকে নাশকতা রোধে রেলওয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও নড়েচড়ে বসেছে। কক্সবাজার এক্সপ্রেসসহ রাতের ট্রেনগুলো পরিচালনার আগে একটি ইঞ্জিন দ্বারা সামনের রেলপথ টহলের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
রেলপথমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন যুগান্তরকে জানান, রেলওয়ের নিরাপত্তা ও যাত্রীসেবা নিশ্চিত করতে মাঠ পর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যসহ রেলওয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সতর্ক রয়েছে। বর্বর কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে ট্রেনযাত্রী ও সাধারণ মানুষকে সোচ্চার হতে হবে। অপরাধীদের চিহ্নিত করতে সহযোগিতা করতে হবে। নাশকতাকারীদের দেখামাত্রই কঠোর অবস্থানে যাবে পুলিশ। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ঢাকা রেলওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ফেরদৌস আহমেদ বিশ্বাস যুগান্তরকে বলেন, গাজীপুরে রেলপথ কেটে নাশকতার ঘটনায় ঢাকা রেলওয়ে থানায় মামলা হয়েছে। রেলওয়ে শ্রীপুর পিডাব্লিউ আশরাফ বাদী হয়ে মামলাটি করেন। মামলায় কারও নাম নেই। ঢাকা রেলওয়ে থানার এসআই শহিদুল্লাহ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা নিযুক্ত হয়েছেন।
রেলওয়ে পুলিশের এডিশনাল ডিআইজি মোর্শেদ আলম যুগান্তরকে বলেন, গাজীপুরে যান্ত্রিক ত্রুটিতে ট্রেন লাইনচ্যুতের ঘটনা ঘটেনি। নাশকতাকারীরা প্রায় ২০ ফুট লাইন গ্যাসকাটার দিয়ে কেটে ফেলায় এমন দুর্ঘটনা ঘটেছে। ইতোমধ্যে অপরাধীদের চিহ্নিত করা হয়েছে। তদন্তের স্বার্থে সবকিছু বলছি না। রেলওয়ে পুলিশের সঙ্গে বিভিন্ন বাহিনীর গোয়েন্দা সদস্যরা কাজ করছেন। পুরো রেলপথে নিরাপত্তা শতভাগ নিশ্চিত করতে আমরা মাঠে কাজ করছি। তবে লোকবলের স্বল্পতায় নিরাপত্তায় কিছু ঘাটতি রয়ে যাচ্ছে। রেলপথ সুরক্ষায় জেলা পুলিশসহ বিভিন্ন গোয়েন্দা বাহিনীর সদস্যদের সহযোগিতায় আমরা সতর্কাবস্থায় আছি। দ্রুত সময়ের মধ্যেই দুষ্কৃতকারীদের গ্রেফতার করা হবে।
মোর্শেদ আলম আরও বলেন, দোহাজারী-কক্সবাজার, ঢাকা-ভাঙ্গা, খুলনা-মোংলাসহ বেশ কয়েকটি নতুন রেলপথে ট্রেন চলাচল করছে। এসব লাইনে নিরাপত্তা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। বর্তমানে রেলে ২৪টি থানা রয়েছে। নতুন করে আরও থানা তৈরি করা হবে। চাহিদা অনুযায়ী লোকবল পেলে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাবে। বর্তমানে প্রায় দুই হাজার ২০০ লোকবল রয়েছে। যাত্রীদের শঙ্কামুক্ত করতে বিশেষ করে রাতের ট্রেনগুলোতে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। রাতের ট্রেনগুলো ছাড়ার আগে নির্ধারিত ইঞ্জিন দ্বারা প্রায় ২০ মিনিট আগে টহল দেওয়া হচ্ছে। ইঞ্জিন ও গার্ড কোচে অস্ত্রধারী পুলিশ থাকছে। বিভিন্ন স্টেশনে রেলওয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ছাড়াও জেলা পুলিশ, বিভিন্ন গোয়েন্দা বাহিনীর সদস্য অবস্থান করছেন। এ বিষয়ে রেলওয়ে অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অবকাঠামো) মফিজুর রহমান জানান, রেলপথে যাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে। রাতের ট্রেন চালানোর আগে ইঞ্জিন দিয়ে টহলের ব্যবস্থা করা হয়েছে। নাশকতার ঘটনায় ইঞ্জিন ও কোচ নষ্ট হচ্ছে।
রেলপথ মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, হরতাল-অবরোধে রেলপথ সুরক্ষায় অস্থায়ীভাবে দুই হাজার ৭০০ আনসার নিয়োগ দেওয়ার কথা থাকলেও তা হয়নি। প্রায় দুই মাস আগে পরিকল্পনা নেওয়া হলেও অদৃশ্য কারণে তা নেওয়া হচ্ছে না। প্রায় ৪০ হাজার কিলোমিটার রেলপথের একেকটি সেকশনে গুটি কয়েকজন ওয়েম্যান পাহারা দিচ্ছে। তবে ওয়েম্যানরা লাইন পাহারা দেন কিনা-তা নিয়েও অনিশ্চয়তা রয়েছে।
গাজীপুরের দুর্ঘটনাস্থল বনখড়িয়া ও আশপাশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যৌথ ট্রান্সফোর্স অভিযান পরিচালনা করছেন। রেলপথ মন্ত্রণালয়ের গঠিত তিন সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি বৃহস্পতিবার সকাল ১০টার দিকে গাজীপুরের বনখড়িয়া এলাকায় ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক রেলওয়ে মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব শাহ্ ইমাম আলী রেজা বলেন, প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টস দেখে এবং সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি করা হবে।