বাছাইয়ের বিরুদ্ধে আপিল
চ্যালেঞ্জ করে ফিরলেন ৫২ শতাংশ প্রার্থী
৫ দিনের শুনানিতে ২৫৫ জন প্রার্থিতা ফিরে পেলেন * বৈধ ঘোষিত চারজনের প্রার্থিতা বাতিল * ফিরে পাওয়াদের মধ্যে ১১৬ জনই স্বতন্ত্র * আজ শুনানির শেষ দিন
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ১৫ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাই করে রিটার্নিং কর্মকর্তাদের দেওয়া সিদ্ধান্তের অর্ধেকই টিকছে না। তারা যাদের মনোনয়নপত্র বাতিল ঘোষণা করেছিলেন, ওই সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ৫ দিনের শুনানিতে ২৫৫ জন প্রার্থিতা ফিরে পেয়েছেন।
আবার রিটার্নিং কর্মকর্তা বাছাইয়ে চারজনকে বৈধ ঘোষণা করলেও ইসির আপিল শুনানিতে তাদের প্রার্থিতা বাতিল হয়েছে। এই হিসাবে সব মিলিয়ে রিটার্নিং কর্মকর্তার ৫২ শতাংশ সিদ্ধান্ত ইসির আপিল শুনানিতে টিকেনি। বাকি ৪৮ শতাংশ রায় সঠিক হিসাবে গণ্য হয়েছে। ফলে প্রার্থী বাছাইয়ে রিটার্নিং কর্মকর্তাদের সিদ্ধান্তের সঠিকতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠেছে।
প্রার্থিতা ফিরে পেতে অনেকেই নানা ধরনের দুর্ভোগের শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ করেন। গত ৫ দিনে ইসির আপিল শুনানির সিদ্ধান্ত পর্যালোচনা করে এ তথ্য পাওয়া গেছে। আজ আপিল শুনানির শেষ দিন।
পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ১০ থেকে ১৪ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ৫ দিনে ৪৯৪টি আপিল শুনানি হয়। এর মধ্যে ২৬০টি আপিল মঞ্জুর হয়েছে। ২১৩টি আপিল নামঞ্জুর হয়েছে। বাকি ২১টি আপিলের কয়েকটি পেন্ডিং ও আপিলকারী অনুপস্থিত রয়েছেন।
গত ৫ দিনে যে ২৫৫ জন প্রার্থিতা ফিরে পেয়েছেন তাদের ১১৬ জনই স্বতন্ত্র। এছাড়া আওয়ামী লীগের ২ জন ও জাতীয় পার্টির ১৬ জন প্রার্থিতা ফিরে পেয়েছেন। তৃণমূল বিএনপির ১৪ জন ও বিএনএম’র ৭ জন আপিলে বৈধ প্রার্থী হিসাবে ইসির রায় পেয়েছেন।
১৫ নভেম্বর প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফশিল ঘোষণা করেন। এ নির্বাচনের ৬৬ রিটার্নিং কর্মকর্তা ১-৪ ডিসেম্বর দেশের ৩০০ আসনের ২৭১৬ প্রার্থীর মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাই করেন।
এতে ৭৩১ জনের প্রার্থিতা বাতিল ঘোষণা করেন। যেই ৭৩১ জনের প্রার্থিতা বাতিল করা হয় তাদের মধ্যে ৪২৬ জনই স্বতন্ত্র প্রার্থী। এছাড়া আওয়ামী লীগের সাতজন, জাতীয় পার্টির ৩৩ জন, তৃণমূল বিএনপির ২৯ ও বিএনএম’র ১১ জন রয়েছেন। বাতিলদের মধ্যে ইসিতে ৫৬১ জনের আপিল আবেদন জমা পড়ে। এর মধ্যে ৩২ আবেদনে বৈধ প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিল চাওয়া হয়। বাকি ৫২৯টি আপিলে প্রার্থিতা ফিরে পেতে আবেদন করেন সংশ্লিষ্টরা।
আপিল শুনানির পঞ্চম দিন বৃহস্পতিবার ১০১টি আপিল শুনানি হয়। এদিন ৪৪টি আপিল মঞ্জুর ও ৫২টি নামঞ্জুর হয়। ৪টি আপিল শুনানি পেন্ডিং রাখা হয়। এদিন আপিল শুনানিতে প্রার্থিতা ফিরে পেয়েছেন ৪৩ জন। তাদের মধ্যে স্বতন্ত্র ১৫ জন।
এছাড়া সাংস্কৃতিক মুক্তি জোটের ৫ জন, ন্যাশনাল পিপলস পার্টির (এনপিপি) ৩ জন এবং জাতীয় পার্টি, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশন, বিএনএফ ও জাতীয় পার্টির (জেপি) দুজন করে প্রার্থিতা ফিরে পেয়েছেন। এছাড়া বিএনএম, ইসলামী ঐক্যজোট, বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টি, গণফ্রন্ট, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন, বাংলাদেশ কংগ্রেস, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি, গণফোরাম, তৃণমূল বিএনপি ও জাসদের একজন করে প্রার্থিতা ফিরে পেয়েছেন।
চারজনের প্রার্থিতা বাতিল : রিটার্নিং কর্মকর্তার বৈধ ঘোষণা করা চার প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিল করেছে ইসি। বৃহস্পতিবার ময়মনসিংহ-৯ আসনের আওয়ামী লীগের প্রার্থী আব্দুস সালামের প্রার্থিতা বাতিল হয়েছে। ওই আসনের আরেক প্রার্থী মো. আনোয়ারুল আবেদিন খান রিটার্নিং কর্মকর্তার সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করে নির্বাচন কমিশনে আপিল করেছিলেন।
আপিল শুনানিতে আপিল মঞ্জুর হয়েছে। আওয়ামী লীগের প্রার্থী আব্দুস সালামের বৈধ প্রার্থী ঘোষণা করে রিটার্নিং কর্মকর্তার সিদ্ধান্ত বাতিল হয়েছে। এর আগের দিন বুধবার আওয়ামী লীগের একজন ও দুজন স্বতন্ত্র প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিল হয়।
এর আগের দিন বুধবার যশোর-৪ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী এনামুল হকের (বাবুল) প্রার্থিতা বাতিল করে ইসি। ঋণখেলাপির অভিযোগে করা দুই প্রার্থীর শুনানির পর ইসি এ সিদ্ধান্ত দেয়। একইদিন সুনামগঞ্জ-৪ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী দেওয়ান শামছুল আবেদীন ও পাবনা-২ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী খন্দকার আজিজুল হক আরজুর বিরুদ্ধে ঋণখেলাপি হওয়ার অভিযোগে আপিল করেছিল অগ্রণী ব্যাংক। সেই আপিল মঞ্জুর হয়। তাতে ওই দুই প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিল হয়।
ইসির একাধিক কর্মকর্তা জানান, আপিল শুনানিতে রিটার্নিং কর্মকর্তাদের দেওয়া অনেক রায় নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। কয়েকজন রিটার্নিং কর্মকর্তার লেখা রায় ভুল, অপরিপক্ব ও সংক্ষিপ্ত ছিল বলেও শুনানিতে মন্তব্য করেন নির্বাচন কমিশনাররা। এ নিয়ে শুনানিতে রিটার্নিং কর্মকর্তাদের প্রতিনিধিরা বিভিন্ন প্রশ্নের মুখে পড়েন।
৫ দিনের চিত্র : আপিল শুনানির প্রথম দিন ১০ ডিসেম্বর ৯৪টি আপিল শুনানি করে ইসি। এ দিন ৫৬টি আপিল মঞ্জুর ও ৩২টি নামঞ্জুর হয়। বাকি ৬টির সিদ্ধান্ত পেন্ডিং রাখা হয়। ১১ ডিসেম্বর ৯৮টি আপিল শুনানিতে ৫১টি মঞ্জুর ও ৪১টি নামঞ্জুর হয়। পেন্ডিং রাখা হয় ৬টি। মঙ্গলবার (১২ ডিসেম্বর) ৯৮টি আপিল শুনানি হয়। ওইদিন ৬১টি মঞ্জুর ও নামঞ্জুর ৩৫টি, পেন্ডিং রাখা হয় দুটি। বুধবার ১০৩টি আপিল শুনানির ৪৮টি মঞ্জুর ও ৫৩টি নামঞ্জুর হয়। শুনানির প্রথমদিনে ৫৬, দ্বিতীয় দিন ৫১, তৃতীয় দিন ৬১, চতুর্থ দিন ৪৪ ও বৃহস্পতিবার ৪৩ জনসহ ২৫৫ জন প্রার্থিতা ফিরে পেয়েছেন।
শাহজাহান ওমরসহ পাঁচ আলোচিত প্রার্থীর শুনানি আজ : সাবেক বিএনপি নেতা ঝালকাঠী-১ আসনের আওয়ামী লীগের মনোনীত শাহজাহান ওমরসহ ৫ প্রার্থীর বিরুদ্ধে আপিল শুনানি আজ। শাহজাহান ওমর হলফনামায় মামলার তথ্য গোপন করায় তার প্রার্থিতা বাতিল চেয়ে আবেদন করেছেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা মনিরুজ্জামান মনির।
অপরদিকে দ্বৈত নাগরিকত্বের অভিযোগ এনে ফরিদপুর-৩ আসনের আওয়ামী লীগ প্রার্থী শামীম হকের প্রার্থিতা বাতিল চেয়ে আপিল করেন স্বতন্ত্র প্রার্থী বিশিষ্ট ব্যবসায়ী একে আজাদ। ওই অভিযোগে শামীম হক নেদারল্যান্ডসের নাগরিক বলে উল্লেখ করা হয়। অপরদিকে একে আজাদের বিরুদ্ধে হলফনামায় তথ্য গোপন করার অভিযোগ করেন শামীম হক।
অপরদিকে বরিশাল-৪ আসনের আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী শাম্মী আহমেদ এবং একই আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী ও বর্তমান সংসদ-সদস্য পংকজ দেবনাথ পরস্পরের বিরুদ্ধে প্রার্থিতা বাতিল চেয়ে আবেদন করেছেন। পংকজ দেবনাথ তার আবেদনে অভিযোগ করেছেন, শাম্মী আহমেদ অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক হলেও তা গোপন করেছেন। অপরদিকে পংকজ দেবনাথের বিরুদ্ধে তথ্য গোপনের অভিযোগ করেছেন শাম্মী আহমেদ।
আপিল শুনানি নিয়ে ইসিতে হট্টগোল : কুমিল্লা-১ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী ও নৌকা প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে হাতাহাতির ঘটনা ঘটেছে। বৃহস্পতিবার দুপুরে এ ঘটনা ঘটে। এ সময় সেখান থেকে দুজনকে আটক করে পুলিশ।
জানা গেছে, কুমিল্লা-১ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী নাঈম হাসান প্রার্থিতা ফিরে পাওয়ার আপিল শুনানিতে ইসিতে আসেন। তিনি নির্বাচন কমিশনের গেট দিয়ে বেরিয়ে আসার সময় ওই আসনের আওয়ামী লীগ প্রার্থী ইঞ্জিনিয়ার আব্দুস সবুরের সমর্থকদের সঙ্গে বাগবিতণ্ডার একপর্যায়ে হাতাহাতি ও উত্তেজনা সৃষ্টি হয়।
১ শতাংশ ভোটারের স্বাক্ষরের গরমিলের কারণে অনেক স্বতন্ত্র প্রার্থীর মনোনয়ন বাতিল করেন রিটার্নিং কর্মকর্তা। তাদের অনেকেই আপিল করেন। সেখানে তারা প্রমাণের চেষ্টা করেন ১ শতাংশ ভোটারের স্বাক্ষর সঠিক, যারা স্বাক্ষর করেছেন তারা জীবিত আছেন। এটা প্রমাণের জন্য অনেক প্রার্থী দূর-দূরান্ত থেকে বয়স্ক নারী-পুরুষকে ঢাকা টেনে নিয়ে আসেন। ইসিতে অনুষ্ঠিত আপিল শুনানিতে এসে প্রমাণ দেন তারা জীবিত আছেন এবং নিজেরাই স্বাক্ষর করেছেন। এরপর প্রার্থিতা ফিরে পান সংশ্লিষ্ট প্রার্থী। স্বতন্ত্র প্রার্থীর জন্য সংশ্লিষ্ট আসনে মোট ভোটারের ১ শতাংশের স্বাক্ষরসহ মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার বিধান আছে।