ব্যাংক ঋণের উচ্চসুদ শিল্পায়নে বাধা
পাঁচ মাসে ৯ থেকে লাফিয়ে লাফিয়ে প্রায় সাড়ে ১১ শতাংশে পৌঁছেছে
হামিদ বিশ্বাস
প্রকাশ: ০৪ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ফের বাড়ছে ব্যাংক ঋণের সুদহার। পাঁচ মাস আগেও ছিল ৯ শতাংশ। ধীরে ধীরে এখন তা প্রায় সাড়ে ১১ শতাংশ ছুঁয়েছে। এর সঙ্গে হিডেন চার্জ যোগ হলে প্রকৃত সুদহার ১৩ শতাংশের কম হবে না। শিল্প উদ্যোক্তারা বলছেন, এভাবে সুদের হার বাড়তে থাকলে শিল্পায়ন হবে না। বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হবে। ফলে কাঙ্ক্ষিত কর্মসংস্থানও সৃষ্টি হবে না।
জানতে চাইলে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইর সাবেক সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন যুগান্তরকে বলেন, সুদহার আরও বাড়লে তা হবে ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’র মতো। এতে ব্যবসা-বাণিজ্যে ব্যয় অনেক বেড়ে যাবে। উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হবে। রপ্তানি বাজার প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়বে। এমনিতেই এখন সেভাবে নতুন শিল্প হচ্ছে না। ডলারের অভাবে মূলধনি যন্ত্রপাতি এবং শিল্পে ব্যবহৃত কাঁচামাল আমদানি কমে যাচ্ছে। আবার বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি কমছে। এখন ঋণ প্রবৃদ্ধি আরও কমলে কর্মসংস্থানের ওপর আঘাত আসবে। ফলে এ সময়ে সুদহার বাড়িয়ে কীভাবে চাহিদা নিয়ন্ত্রণ করে মূল্যস্ফীতি কমানো হবে, তা বোধগম্য নয়। তিনি বলেন, এখন দরকার ডলার। এ জন্য ডলারের রেট বেঁধে না দিয়ে বাজারভিত্তিক করা উচিত। তাতে হয়তো প্রথম দিকে কিছুটা কষ্ট হবে, তবে রেমিট্যান্স বাড়বে। আবার আন্ডার ইনভয়েসিং কমবে।
জানা গেছে, নীতিসুদ হার বাড়ানোর মাত্র চার দিন পর নতুন ‘স্মার্ট’ সুদহার নির্ধারণ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে ঋণ দিতে ব্যাংকগুলো এখন সর্বোচ্চ ১১ দশমিক ৪৭ শতাংশ সুদ নিতে পারবে। গত সপ্তাহের শেষ কার্যদিবসে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডিসেম্বরের জন্য স্মার্ট (সিক্স মান্থস মুভিং অ্যাভারেজ রেট অব ট্রেজারি বিল) সুদহার নির্ধারণ করেছে ৭ দশমিক ৭২ শতাংশ। নভেম্বরের জন্য যা ছিল ৭ দশমিক ৪৩ শতাংশ। এক মাসের ব্যবধানে স্মার্ট সুদহার বাড়ল ২৯ বেসিস পয়েন্ট, গত ছয় মাসে প্রকাশিত সুদহারের মধ্যে এটি সর্বোচ্চ বৃদ্ধি। গত জুন মাস থেকে প্রতি মাসের জন্য স্মার্ট সুদহার প্রকাশ করে আসছে বাংলাদেশ ব্যাংক। প্রথম মাসে তা ছিল ৭ দশমিক ১০ শতাংশ। এ হিসাবে ছয় মাসে স্মার্ট সুদহার বাড়ল ৬৩ বেসিস পয়েন্ট। স্মার্ট সুদহারের সঙ্গে সর্বোচ্চ ৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ মার্জিন যোগ করে সুদের হার নির্ধারণ করতে পারবে ব্যাংকগুলো।
নীতিমালা অনুযায়ী, গ্রাহক পর্যায়ে ঋণ সুদহার দাঁড়াবে সর্বোচ্চ ১১ দশমিক ৪৭ শতাংশ। প্রি-শিপমেন্ট রপ্তানি ঋণ এবং কৃষি ও পল্লী ঋণে সুদহার হবে সর্বোচ্চ ১০ দশমিক ৪৭ শতাংশ (স্মার্ট সুদহারের সঙ্গে সর্বোচ্চ ২ দশমিক ৭৫ শতাংশ যোগ করে)। এর সঙ্গে ১ শতাংশ হারে সার্ভিস চার্জ নিতে পারবে এসএমই ঋণের বিপরীতে। মুদ্রানীতির আধুনিকায়ন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও বাজারভিত্তিক সুদহার ব্যবস্থা চালু করতে আইএমএফ-এর শর্ত বাস্তবায়নে গত জুলাই থেকে সুদহার করিডোর পদ্ধতি চালু করতে স্মার্ট (প্রতি ছয় মাসের ট্রেজারি বিল ও বন্ডের গড় সুদহার ধরে হিসাব করা হয় ‘স্মার্ট’ রেট) চালু করে বাংলাদেশ ব্যাংক। প্রতি মাসের শেষে বা প্রথম দিনে স্মার্ট সুদহার কত হবে তা জানিয়ে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। নভেম্বরের স্মার্ট সুদহার প্রযোজ্য হবে ডিসেম্বর মাসে বিতরণ করা ঋণের ওপর।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিকেএমইএ নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম যুগান্তরকে বলেন, এমনিতে এখন পরিস্থিতি খারাপ। ব্যবসা-বাণিজ্য নেই। গ্যাসের দাম বাড়তি। তার ওপর ব্যাংক ঋণের সুদহার বাড়লে শিল্প টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না। ইতোমধ্যে সুদহার ১২ শতাংশের কাছাকাছি চলে এসেছে। কোনোভাবেই উচ্চসুদ দিয়ে প্রতিযোগিতামূলক বাজারে টিকে থাকা যাবে না। সুদের লাগাম এখনই টেনে ধরতে হবে। তা না হলে উৎপাদন, বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান কিছুই হবে না।
এদিকে নীতি সুদহার হিসেবে পরিচিত ‘রেপো রেট’ ফের বাড়িয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ব্যাংকগুলোর স্বল্প মেয়াদে ধারের এ মাধ্যমের সুদহার এক লাফে ৭৫ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ করা হয়েছে। এর আগে এ হার ছিল সাড়ে ৬ শতাংশ। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য ঋণের চাহিদা কমাতে বাংলাদেশ ব্যাংক এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর প্রভাবে ব্যাংকের গ্রাহক পর্যায়েও সুদহার বাড়বে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এ সিদ্ধান্তের পেছনে আইএমএফের পরামর্শ গুরুত্ব পেয়েছে। সফররত আইএমএফ প্রতিনিধ দল প্রথম দিনে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে বৈঠক করে। তারা সুদহার আরও বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক রেপোর সুদহার বৃদ্ধির বিষয়ে সার্কুলার জারি করে অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে। চলতি বছর এর আগে এ সুদহার দু’দফা বাড়ানো হয়।
রেপোর মাধ্যমে ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে স্বল্পমেয়াদি ধার নেয়। রেপোর সুদ বাড়লে স্বাভাবিকভাবে কলমানিসহ আন্তঃব্যাংক সব ধরনের ধারের সুদহার বেড়ে যায়। এতে ব্যাংকের তহবিল গ্রহণের ব্যয় বাড়ে, যার প্রভাবে ঋণের সুদহার বাড়তে পারে। আমানতের সুদহারও বাড়ার ক্ষেত্র তৈরি হয়। বেশির ভাগ দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতি সুদহার বাড়ানোর মাধ্যমে সামগ্রিক সুদহার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সক্ষম হয়। তবে বাংলাদেশে এমনিতেই বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি অনেক কম। ফলে বর্তমান বাস্তবতায় সুদহার কমানোর মাধ্যমে চাহিদা নিয়ন্ত্রণ কতটুকু কার্যকর হবে, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে ব্যবসায়ীদের।
বাংলাদেশ ব্যাংক গত জুলাইতে রেপোর সুদহার বেসিস পয়েন্ট ৫০ বাড়িয়ে ৬ দশমিক ৫০ শতাংশ নির্ধারণ করে। এর আগে চলতি বছরের জানুয়ারিতে বাড়ানো হয় বেসিস পয়েন্ট ২৫ শতাংশ। অবশ্য ব্যবসায়ীদের দাবির মুখে রেপোর সুদ পরে কমানো হয়। ২০২০ সালের জুলাইতে রেপোর সুদ ৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ নির্ধারণ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এরপর থেকে একটু একটু বাড়িয়ে এ পর্যায়ে আনা হয়। এতদিন রেপোর সুদ বাড়লেও বাজারে ৯ শতাংশ সুদহারের সীমাই অপরিবর্তিত ছিল। তবে গত জুলাই থেকে সুদহারের নতুন পদ্ধতি কার্যকর হয়েছে।
২০২০ সালের এপ্রিল থেকে ব্যাংক ঋণের সুদহারের সর্বোচ্চ সীমা ৯ শতাংশ ঠিক করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যবসায়ীদের সুবিধা দিতে এতদিন এ নীতি চলছিল। তবে বৈশ্বিক পরিস্থিতির কারণে শেষ পর্যন্ত তা আর ধরে রাখতে পারেনি। এর মধ্যে বৈদেশিক মুদ্রার সংকট মেটাতে আইএমএফ থেকে ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের চুক্তি করেছে সরকার। এই ঋণের অন্যতম শর্ত দেওয়া হয় মুক্তবাজার অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় এভাবে সুদহারের সীমা বেঁধে দেওয়া যাবে না। এরপর গত জুলাই থেকে আগের সীমা তুলে দিয়ে সুদহারের নতুন পদ্ধতি কার্যকর করা হয়। শুধু তাই নয়, ঋণ আমানতের সুদহারের যে ব্যবধান (স্প্রেড) সেটাও প্রত্যাহার করা হয়। ফলে হু হু করে বাড়ছে সুদহার।