আগামী সপ্তাহেও চার দিন অবরোধের চিন্তা
সমমনা জোটে অস্থিরতা ঠেকাতে তৎপর বিএনপি
ভেঙে যেতে পারে কল্যাণ পার্টি, ১২ দলীয় জোটের সঙ্গে একাংশের যোগাযোগ
তারিকুল ইসলাম
প্রকাশ: ২৩ নভেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে রাজনীতিতে চলছে নানা সমীকরণ। দল ভাঙাগড়ার পাশাপাশি নতুন জোটেরও আত্মপ্রকাশ হচ্ছে। এ নিয়ে বিরোধী শিবিরে চলছে সন্দেহ ও অবিশ্বাস। বিশেষ করে ১২ দলীয় জোট থেকে কল্যাণ পার্টি ও মুসলিম লীগ (বিএমএল) বেরিয়ে যাওয়ার পর সরকারবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনে সমমনা দল ও জোটে অস্থিরতা বাড়ছে। এ পরিস্থিতিতে সমমনা জোটের দিকে আরও বেশি নজর দিচ্ছে বিএনপি। অস্থিরতা ঠেকাতে বসে নেই দলটির দায়িত্বশীল নেতারা। লোভ-লালসার ফাঁদে পড়ে নির্বাচনে যেতে পারে জোটের শরিক এমন দলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগসহ নানামুখী তৎপরতা শুরু করেছেন তারা। আন্দোলনে থাকা একটি দলের শীর্ষ নেতাও এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন। ইতোমধ্যে কল্যাণ পার্টির একটি অংশ ১২ দলীয় জোটে থাকতে এক শীর্ষ নেতার সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। দু-একদিনের মধ্যে তাদের সঙ্গে বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য। এদিকে কাল শুক্রবার ভোর ৬টা পর্যন্ত চলমান ৪৮ ঘণ্টার দেশব্যাপী সর্বাত্মক অবরোধ কর্মসূচি চলবে। একাধিক নীতিনির্ধারক জানান, আন্দোলন থেকে সরে আসার কোনো সুযোগ নেই বিএনপির। আগামী সপ্তাহেও একদিনের বিরতি দিয়ে চার দিন অবরোধ কর্মসূচি দেওয়ার কথা রয়েছে। জনগণের সুবিধার কথা চিন্তা করেই সপ্তাহে তিন দিন বিরতি দেওয়া হচ্ছে। যদিও তফশিল পেছানো হবে বলে ধারণা করছেন তারা। দলীয় সিদ্ধান্ত মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ দিন পর্যন্ত এ কর্মসূচি টেনে নেওয়া হবে। পরে ভিন্ন কোনো কঠোর কর্মসূচি দেওয়ার প্রস্তাব রয়েছে। প্রস্তাবে ‘অসহযোগ’ নাম দিয়ে হরতাল ও অবরোধ একই সঙ্গে পালনের কথা রয়েছে। এ কর্মসূচির মধ্যেই আবার নির্বাচন কমিশন ঘেরাওসহ সরকারি গুরুত্বপূর্ণ ভবন ঘেরাওয়ের কর্মসূচিও আসতে পারে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য যুগান্তরকে জানান, অবরোধ-হরতাল কর্মসূচিতে দলীয় নেতাকর্মীদের পাশাপাশি সাধারণ জনগণের ব্যাপক সাড়া পাচ্ছেন। আগামী কয়েকদিন চলমান একই কর্মসূচি রাখার বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত রয়েছে। পরে আরও কঠোর কর্মসূচি আসবে। তিনি বলেন, সরকারের নানা চাপ ও লোভে পড়ে হয়তো দু-একটি দল নির্বাচনে যেতে পারে। এতে করে আন্দোলনে কোনো প্রভাব পড়বে না। বরং যারা নির্বাচনে যাবেন তাদের নাম ইতিহাসে ‘বেইমান’ হিসাবে চিহ্নিত থাকবে। নির্বাচনে অংশ নিতে নানামুখী চাপের কথা ইতোমধ্যে বিএনপিকে কয়েকটি দল জানিয়েছে। সমমনা দল ও জোটের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষায় দলের এক সিনিয়র নেতাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘সরকারের লোকজন মাঠে নেমেছে তথাকথিত কিংস পার্টি গঠনের জন্য। বিভিন্ন দল থেকে নেতাদের আনতে হাঁটের মতো দরদাম চলছে। আওয়ামী লীগের কিংস পার্টিতে যোগ দিতে দেশপ্রেমিক বহু নেতাকে চাপ-প্রলোভন ও ভয়ভীতি প্রদর্শন করা হচ্ছে। ছলে-বলে-কৌশলে টোপ দিয়ে কাউকে কাউকে বাগানো হচ্ছে। গণতন্ত্র ও ভোটাধিকারের আন্দোলনে থেকে যারা দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাবে তারা ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হবে। এই সরকারের বিরুদ্ধে জনগণ ফুঁসে উঠেছে। যে কোনো সময় সরকারের পতন নিশ্চিত।’
দলটির কেন্দ্রীয় সহদপ্তর সম্পাদক তাইফুল ইসলাম টিপু বলেন, ‘মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে বিএনপিসহ গণতন্ত্রমনা সব দল এখন রাজপথে আছে। বাড়ি-ঘরে হামলা, মামলা, নির্যাতনের পরও প্রতিদিনই সাধারণ মানুষসহ বিএনপি ও অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা বিভিন্নভাবে মাঠে নেমে আসছে। সব প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে তাদের অবস্থান দিন দিন বৃদ্ধি করছে। প্রতিনিয়তই সম্পৃক্ততা বাড়ছে। সামনে চলমান আন্দোলন আরও বেগবান হবে। এ কর্মসূচির মধ্য দিয়েই বিভিন্ন রকম কৌশল অবলম্বন করে আগামী দিনে রাজপথে আরও সক্রিয় অবস্থান নিয়ে গণআন্দোলনের মাধ্যমে দাবি আদায় করা হবে। আমাদের বিজয় খুব সন্নিকটে।’
সরকার পতনের একদফা আন্দোলনে বিএনপির সমমনা প্রায় ৩৯টি দল যুগপৎ রাজপথে আছে। এর মধ্যে গণতন্ত্র মঞ্চ, ১২ দলীয় জোট, এলডিপি, সমমনা জাতীয়তাবাদী জোট, গণফোরাম (মন্টু), গণঅধিকার পরিষদের দুই অংশসহ অনেকে রয়েছে। ২৮ অক্টোবর ঢাকায় বিএনপির মহাসমাবেশ পণ্ড হয়ে যাওয়ার পর সর্বাত্মক আন্দোলনে নামে এসব দল ও জোট। যুগপৎ আন্দোলনে না থাকলেও জামায়াতে ইসলামী একই কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। এছাড়া অবরোধ কর্মসূচিকে সমর্থন জানিয়েছে ইসলামী আন্দোলন ও এবি পার্টি।
বিএনপি নেতারা জানান, তারা সুষ্ঠু, অবাধ নির্বাচনের জন্য নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন চান। তাদের মতে, দেশের মানুষ, এমনকি বিদেশিরাও এ দাবি গ্রহণ করেছেন। এখন ধৈর্য, সততা ও ঐক্যই হচ্ছে দলের প্রধান চ্যালেঞ্জ। এছাড়া রাজনীতি ও ভোটের হিসাব-এই দুই ফ্যাক্টর নিয়ে সামনে এগোচ্ছেন তারা। ভোটের হিসাবে ইসলামি দলগুলো একটি ফ্যাক্টর। যাদের মধ্যে বড় বড় দলগুলো দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাবে না। আর রাজনীতির ক্ষেত্রে বামদলগুলো ফ্যাক্টর, যাদেরও বেশিরভাগ নির্বাচনে যাবে না। সবাই আলোচনার ভিত্তিতে নির্বাচনকালীন সরকার চান। ক্ষমতাসীন দল মনোনয়ন চূড়ান্তের পর তাদের শরিক দলগুলোর মধ্য থেকে আরও কয়েকটি দল আন্দোলনে অংশ নেবে বলেও ধারণা করছেন নেতারা।
জোট নেতারা জানান, গণতন্ত্র মঞ্চের শরিক দলগুলোকে এখন পর্যন্ত নির্বাচনে আনার কোনো তৎপরতা না থাকলেও ১২ দলীয় জোটের শরিকদের টার্গেট করা হয়েছে। এর বাইরেও আন্দোলনরত আরও কয়েকটি দলের জনপ্রিয় নেতাদের বিভিন্ন ‘টোপ’ দেওয়া হচ্ছে।
গণঅধিকার পরিষদের (একাংশ) সভাপতি নুরুল হক নুর যুগান্তরকে বলেন, বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে না। আজকে জনগণের ভোটের অধিকার ও নির্বাচনের পরিবেশ নেই। বিরোধী দলের কার্যালয় পুলিশ তালাবদ্ধ করে রেখেছে। প্রধান বিরোধী দলের ২০ হাজার নেতাকর্মীকে জেলে রেখে তারা নির্বাচনের খেলা ও উৎসব করছে। শুরু থেকেই বলছি দলীয় সরকারের অধীনে কোনো সাজানো ও পাতানো প্রহসনের নির্বাচনে আমরা যাব না। আমাদের ওপর নির্যাতন করেছে। তারপরও আমরা মাথানত করিনি।
বুধবার সংবাদ সম্মেলন করে ১২ দলীয় জোট থেকে কল্যাণ পার্টিসহ আরও একটি দল বেরিয়ে গিয়ে নতুন জোট যুক্তফ্রন্ট গঠন করেছে। তারা নির্বাচনে যাওয়ারও ঘোষণা দিয়েছে। ১২ দলীয় জোটের নতুন মুখপাত্র বাংলাদেশ এলডিপির মহাসচিব শাহাদাত হোসেন সেলিম বলেন, ‘কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান জাতির সঙ্গে বেইমানি করেছেন। যদিও তিনি দুমাস ধরে সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় ছিলেন। তার দলের পক্ষ থেকেও কেউ জোটের কর্মসূচিতে অংশ নেননি।
আর মুসলিম লীগ হচ্ছে এক ব্যক্তির দল। তারা চলে গেলেও জোটে এর কোনো প্রভাব পড়বে না। কারণ যে আন্দোলন করছি তা আমাদের শক্তিতে বলীয়ান হয়েই করছি। এখন কল্যাণ পার্টির বেশ কয়েকজন আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। তারা সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিমকে বাদ দিয়ে ১২ দলীয় জোটে থেকে আন্দোলনে আগ্রহী। আজ বৃহস্পতিবার এ নিয়ে তাদের সঙ্গে বসব।
এদিকে বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় মজলিশে শূরার বৈঠক হয়েছে। এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, দেশের জনগণের মতামত অগ্রাহ্য করে সরকারের আজ্ঞাবহ নির্বাচন কমিশনের একতরফা তফশিল জামায়াতের কেন্দ্রীয় মজলিশে শূরা ঘৃণার সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করছে। কেন্দ্রীয় মজলিশে শূরার অভিমত, দেশে সুষ্ঠু নির্বাচনের কোনো পরিবেশ নেই। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পূর্বশর্ত লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে। এ অবস্থায় লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরির লক্ষ্যে আমির ডা. শফিকুর রহমানসহ বিরোধী দলের সব শীর্ষ নেতা এবং গ্রেফতারকৃত নেতাকর্মীদের মুক্তি দিতে হবে। মিথ্যা ও সাজানো মামলা প্রত্যাহার করতে হবে। সভা-সমাবেশ ও মিটিং করার সুযোগ দিতে হবে। কেন্দ্রীয় অফিসসহ বন্ধ সব শাখা অফিস খুলে দিতে হবে।