ভোটের মাঠে ‘সঙ্গী’ খুঁজছে আ.লীগ
সব দলকে জানানো হচ্ছে আহ্বান, পর্দার বাইরে ও অন্তরালে চলছে নানা আলোচনা
হাসিবুল হাসান
প্রকাশ: ২১ নভেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
তফশিলের পরও ভোটে না যাওয়ার বিষয়ে অনড় বিএনপি ও তাদের মিত্ররা। এমন অবস্থায় নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক করতে কৌশলী আওয়ামী লীগ। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মহলের সমালোচনা এড়াতে ভোটের মাঠে যত বেশি সম্ভব দলকে আনতে চায় ক্ষমতাসীনরা।
এ লক্ষ্যে নিজেদের ভোটের প্রস্তুতির পাশাপাশি নির্বাচনি যাত্রায় ‘সঙ্গী’ বাড়াতে নানা তৎপরতা চলাচ্ছে তারা। পর্দার বাইরে ও অন্তরালে চলছে নানা আলোচনা ও সমঝোতা প্রক্রিয়া। দেশের নিবন্ধিত ৪৪টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে ইতোমধ্যে ১৫টি দল তফশিলকে স্বাগত জানিয়েছে। ১৪ দলের শরিক এবং আগে মহাজোটের অংশ হয়ে নির্বাচন করেছে এমন দলগুলোও নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু করেছে। ইসিতে নিবন্ধিত নয় এমন বেশ কয়েকটি জোট এবং দলও নির্বাচনের মাঠে নেমে পড়েছে।
এছাড়া যে ১২টি দল এখনো নির্বাচন নিয়ে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করেনি, তাদের ভোটের মাঠে আনতে চায় আওয়ামী লীগ। একই সঙ্গে ভোটের বিপক্ষে থাকা এবং বিএনপির আন্দোলনের মিত্র দলগুলোর সঙ্গেও নানা মাধ্যমে যোগাযোগ রাখার চেষ্টা চালাচ্ছে ক্ষমতাসীনরা। বিশেষ করে মহান স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী দলগুলোকে পাশে রাখতে চাইছে আওয়ামী লীগ।
এছাড়া স্বাধীনতার পক্ষের ছোট দলের বড় নেতাদের সঙ্গেও যোগাযোগ বাড়িয়েছে দলটি। তাদের দু-চারজনও ইতোমধ্যে প্রকাশ্যে ভোটে নিজেদের ইতিবাচক অবস্থানের কথা জানিয়েছে। আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা বলছেন, কৌশলগত কারণে সবকিছু এখনই বলা যাবে না। উপযুক্ত সময়ে জানানো হবে। এটা নিয়ে তারা যেমন লুকোচুরি করতে চান না, তেমনি আগ বাড়িয়ে কিছু বলতেও রাজি নন।
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য এবং কেন্দ্রীয় ১৪ দলের মুখপাত্র আমির হোসেন আমু যুগান্তরকে বলেন, আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ১৪ দলীয় জোটগতভাবে অংশ নেবে। আমাদের জোটনেত্রী, আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী খুব শিগগিরই শরিক দলের নেতাদের সঙ্গে বসে আসন ভাগাভাগিসহ অন্যান্য বিষয় নিয়ে আলোচনা করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন। এর বাইরে ১৪ দলের আকার বাড়বে কিনা বা আওয়ামী লীগ আর কারও সঙ্গে জোট বা মহাজোট করবে কিনা জানতে চাইলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
এদিকে তফশিলের পর আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানাতে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ তারিখের আগে অনেক দল ও ব্যক্তির নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিষয়ে ইঙ্গিত করেছিলেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, সামনের কয়েকটা দিন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
৩০ নভেম্বর মনোনয়ন ফরম জমা দেওয়ার শেষ তারিখ। এর মধ্যে কত ফুল ফুটবে। আর শীতকাল তো এসে গেছে, কিছু কিছু ফুল ফোটার সময়ও এসে গেছে। এখন কোন ফুল কোথায় ফুটছে, হঠাৎ জেগে উঠবে। অপেক্ষা করুন। আওয়ামী লীগ কি দলগত নাকি জোটগত নির্বাচন করবে এবং জাতীয় পার্টি থাকবে কিনা? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি। সময়মতো জানতে পারবেন।
এদিকে বিএনপিসহ বিরোধীদের দাবি না মানলেও আওয়ামী লীগ নেতারা শুরু থেকেই বলে আসছেন-তারা চান বিএনপিসহ সব রাজনৈতিক দল আগামী নির্বাচনে অংশ নিক। আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেও তফশিল ঘোষণার পর সব রাজনৈতিক দলকে নির্বাচনে অংশগ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন। দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের অন্য নেতারাও বলেছেন, আওয়ামী লীগ কারও জন্য বাধা হবে না। দিনরাত যারা তাদের গালিগালাজ করেন, তাদের জন্যও নির্বাচনের দরজা বন্ধ হয়নি। আওয়ামী লীগ কাউকে নির্বাচন থেকে দূরে থাকতে উৎসাহিত করছে না বলেও জানান দলটির নেতারা।
এদিকে আওয়ামী লীগ এবারও ১৪ দলীয় জোটের শরিকদের সঙ্গে নিয়ে নির্বাচন করার ঘোষণা দিয়েছে। এর বাইরে আগের নির্বাচনগুলোতে মহাজোটে থাকা কয়েকটি দল ছাড়াও নতুন গঠিত কয়েকটি দলও আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটবদ্ধভাবে নির্বাচন করতে আগ্রহী। বিএনপি মাঠে না থাকায় এবং আওয়ামী লীগই আবার ক্ষমতায় আসবে ধারণা থেকেই এসব দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে থাকতে চায়। যদিও এখনো জোট বা জোটের বাইরে কারও সঙ্গেই আসন ভাগাভাগি নিয়ে কোনো সমঝোতা হয়নি ক্ষমতাসীনদের। এরই মধ্যে আওয়ামী লীগ এককভাবে তাদের দলীয় প্রার্থী বাছাইয়ের কার্যক্রমও শুরু করেছে। শনিবার থেকে শুরু হয়েছে দলীয় মনোনয়ন ফরম বিক্রি ও জমাদান কার্যক্রম। ১৪ দলের শরিক দলগুলোও নিজেদের প্রার্থী চূড়ান্তের কাজ শুরু করেছে।
তবে আসন ভাগাভাগি না করলেও নির্বাচন কমিশনের বেঁধে দেওয়া নির্ধারিত সময়ের (শনিবার বিকাল পর্যন্ত) মধ্যে জোটবদ্ধ হয়ে অংশ নেওয়ার কথা জানিয়েছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। এছাড়া জাতীয় পার্টি (জেপি), বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল (এমএল), গণতন্ত্রী পার্টি, বিকল্পধারা বাংলাদেশ, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশন ও তৃণমূল বিএনপিও জোটবদ্ধ হয়ে ভোট করার কথা জানিয়েছে ইসিকে। জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকে ইসিতে দুটি চিঠি দেওয়া হয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী, প্রার্থিতা প্রত্যাহারের পর প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের প্রতীক বরাদ্দ দেন রিটার্নিং অফিসার। জোটভুক্ত হলে সংশ্লিষ্ট দলের সম্মতি সাপেক্ষে একটি প্রতীক বরাদ্দ দেবেন তিনি। ভোটের ব্যালটে প্রার্থীর নামের পাশে ওই প্রতীক উল্লেখ থাকবে।
রোববার আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক করেছেন তৃণমূল বিএনপির নেতারা। বৈঠক থেকে বেরিয়ে তারা জানিয়েছেন, আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তৃণমূল বিএনপি অংশ নিচ্ছে। অবশ্য এর আগে গত ১৬ নভেম্বর নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা দেন তৃণমূল বিএনপির চেয়ারপারসন শমসের মুবিন চৌধুরী। ইতোমধ্যে ভোটের প্রস্তুতিও নিতে শুরু করেছে তারা। দলীয় মনোনয়ন ফরমও বিক্রি শুরু করেছে দলটি। আগামী ২৫ নভেম্বর পর্যন্ত দলটির মনোনয়ন ফরম বিক্রি চলবে। একই সঙ্গে ২১ নভেম্বর সকাল ১০টা থেকে দলীয় মনোনয়নপ্রত্যাশীদের সাক্ষাৎকারও নেওয়া হবে।
ইতোমধ্যে নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে ইসলামী ঐক্যজোট। সোমবার বিকালে জাতীয় প্রেস ক্লাবের জহুর হোসেন চৌধুরী হলে সংবাদ সম্মেলনে ঐক্যজোটের মহাসচিব মুফতি ফয়জুল্লাহ জানান, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) প্রতিশ্রুতির ওপর আস্থা রেখে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইসলামী ঐক্যজোট। ঘোষিত তফশিল অনুযায়ী প্রস্তুতির সময় কম বিবেচনায় তারা তফশিল পুনর্বিন্যাসের জন্যও কমিশনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ। দলীয় প্রতীক ‘চেয়ার’ নিয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে তারা। আজ মঙ্গলবার থেকে দলীয় মনোনয়ন ফরম বিতরণ শুরু করবে দলটি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সাবেক সহসভাপতি (ভিপি) ও আওয়ামী লীগের সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা ছিলেন সুলতান মনসুর। গত নির্বাচনের আগে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠিত হয়। জোটের শীর্ষ নীতিনির্ধারণী ফোরাম স্টিয়ারিং কমিটির সদস্যও হন তিনি। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থী হিসাবে বিএনপির ধানের শীষ প্রতীকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। এবার ইতোমধ্যে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়ে নির্বাচন করার আগ্রহের কথা জানিয়েছেন সুলতান মনসুর।
আওয়ামী লীগের গত জাতীয় সম্মেলনের আগের দিন সপরিবারে গণভবনে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন কাদের সিদ্দিকী। পরদিন দলটির সম্মেলনেও উপস্থিত হয়েছিলেন তিনি। এরপর থেকেই কাদের সিদ্দিকী আওয়ামী লীগে ফিরছেন কিনা তা নানা আলোচনা শুরু হয়। তবে শেষ পর্যন্ত তা আর হয়নি। এখনো পর্যন্ত নিজের দল কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ নিয়েই আছেন তিনি। তবে এবার জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইতোমধ্যে অংশগ্রহণের বিষয়ে ইঙ্গিতও দিয়েছেন তিনি।
আওয়ামী লীগের একটি সূত্র বলছে, জোট বা জোটের বাইরে যাদের সঙ্গেই আলোচান করুন না কেন, আসন নিয়ে কোনো কিছুই চূড়ান্ত করছে না আওয়ামী লীগ। কারণ বিএনপি নির্বাচনে না এলে বিকল্প ভাবনা রয়েছে আওয়ামী লীগের। সেক্ষেত্রে কয়েকটি আসন উন্মুক্ত রাখার চিন্তা করা হচ্ছে। ওই আসনগুলো আওয়ামী লীগের নির্বাচনি জোটের বাইরে থাকা সমমনা রাজনৈতিক দলকে ছেড়ে দেওয়া হবে। আবার আসন উন্মুক্ত না রেখে ওইসব আসনে দুর্বল প্রার্থী দেওয়ারও চিন্তা রয়েছে। এতে আওয়ামী লীগের ভোটাররা সমমনা দলের প্রার্থীদের ভোট দেবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।