Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন

আওয়ামী লীগের সামনে এ মুহূর্তে দুই পথ

বিএনপিকে আনতে পর্দার আড়ালে তৎপরতা * বিএনপি না এলেও নির্বাচনের প্রস্তুতি ক্ষমতাসীনদের * একতরফা নির্বাচন হলে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অর্থনৈতিক সংকট ঘনীভূত হওয়ার শঙ্কা

হাসিবুল হাসান

হাসিবুল হাসান

প্রকাশ: ০৮ নভেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

আওয়ামী লীগের সামনে এ মুহূর্তে দুই পথ

সমমনা দলগুলোকে নিয়ে নির্বাচন করা। তাদের ভোটে আনতে দেশ-বিদেশের যেমন চাপ রয়েছে, তেমনি পর্দার আড়ালে চলছে বিভিন্ন মহলের তৎপরতাও। ইতোমধ্যে আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী ও নেতা সংবিধান মেনে শর্তহীন সংলাপের বিষয়ে ইতিবাচক অবস্থানের কথা জানিয়েছেন। শুধু তাই নয়, যুক্তরাষ্ট্র ও এর মিত্ররা চলমান পরিস্থিতি উত্তরণে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য সংলাপে বসার তাগিদ দিচ্ছে। পাশাপাশি বিএনপি নেতাদের কেউ কেউ তাদের ভোটে যাওয়ার বিষয়েও ইতিবাচক মন্তব্য করেছেন। দ্বিতীয়ত, বিএনপি যদি না আসে, সেক্ষেত্রে সংবিধান মেনে যারা আসবে, তাদের নিয়েই নির্বাচনে যাবে ক্ষমতাসীনরা। তারা এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতিও সম্পন্ন করছে। এক্ষেত্রে নির্বাচন যাতে প্রশ্নবিদ্ধ না হয়, সেজন্য অধিক সংখ্যক রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণের বিষয়টি নিশ্চিত করতে কাজ করছে সরকারি দল। একই সঙ্গে নির্বাচনের আবহ ধরে রাখা ও ভোটার উপস্থিতি বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে আওয়ামী লীগের।

শেষ পর্যন্ত বিএনপি নির্বাচনে অংশ না নিলে এবং তাদের হরতাল-অবরোধের মতো কর্মসূচি অব্যাহত রাখলে রাজনৈতিক অস্থিরতা আরও বাড়াবে-এমন শঙ্কা বিশ্লেষকদের। তাদের মতে, সেক্ষেত্রে দেশের অর্থনৈতিক সংকট ঘনীভূত হবে। এছাড়া বিএনপি ও তাদের সমমনাদের ছাড়া নির্বাচন করলে, এ নিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মহলেও সমালোচনা হবে। পাশাপাশি সম্ভাবনা আছে নানাবিধ নেতিবাচক প্রভাব পড়ার। তাই যেভাবেই হোক একটা ভালো নির্বাচন করতেই হবে। এর বাইরে কোনো সমাধান নেই-এমন অভিমতও দিয়েছেন তারা।

সাবেক সিনিয়র সচিব আবু আলম মো. শহীদ খান যুগান্তরকে বলেন, একতরফা নির্বাচন হলে সেটা রাষ্ট্র, গণতন্ত্র ও মানুষের জন্য কল্যাণকর হবে না। দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এখন কিন্তু ভালো নয়। এটা অর্থনীতিবিদ, বিশেষজ্ঞ ও সংশ্লিষ্টদেরই বক্তব্য। এর মধ্যে যদি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিশ্ববাণিজ্যে কোনো পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, যদি কোনো চ্যালেঞ্জ আসে, সেটা মোকাবিলা করা আমাদের জন্য কঠিন হয়ে যাবে। কারণ অর্থনৈতিক পরিস্থিতি তখন আরও নাজুক হয়ে যাবে। সেটা দেশকে বেশ বড় চ্যালেঞ্জ ও ভোগান্তির মুখে ফেলতে পারে। ফলে আমাদের একটা ভালো নির্বাচন করতেই হবে। ভালো নির্বাচন মানে-সব দলের অংশগ্রহণে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন। এর বাইরে অন্য কোনো সমাধান নেই।

ক্ষমতাসীন দলের একাধিক নীতিনির্ধারক প্রায় অভিন্ন সুরে বলেছেন, আওয়ামী লীগ চায় না নির্বাচন নিয়ে দেশ-বিদেশে কোনো প্রশ্ন বা সমালোচনা থাকুক। এজন্য তারাও চায় বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিক। ফলে রাজনৈতিক সভা-সমাবেশে বিএনপির সঙ্গে কোনো আলোচনা হবে না বললেও আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা বারবার বিএনপিকে ভোটে আসার আহ্বানও জানাচ্ছেন। এক্ষেত্রে একাধিকবার সংবিধানের মধ্য থেকে ছাড় দেওয়ার কথাও বলেছে ক্ষমতাসীনরা। দলটির গুরুত্বপূর্ণ নেতা ও মন্ত্রীরাও একাধিবার বলেছেন-শর্তহীন সংলাপ হতে পারে। এদিকে বিএনপিকে নির্বাচনে চাইলেও সংবিধানের বাইরে না যাওয়ার বিষয়ে অনড় আওয়ামী লীগ। একই সঙ্গে সংবিধান মেনে যথাসময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানের পথেই হাঁটছে ক্ষমতাসীনরা। এ ক্ষেত্রে বিএনপিসহ বিরোধীদের দাবি ও আন্দোলনে পাত্তা দিচ্ছে না। সব কিছু ঠিক থাকলে আগামী সপ্তাহে ঘোষণা হতে পারে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফশিল। ফলে শেষ পর্যন্ত বিএনপি ভোটে না আসার আশঙ্কা আছে। এ বিষয়টি মাথায় রেখেও পথ চলছে আওয়ামী লীগ। একদিকে নিজেদের ভোটের প্রস্তুতির মধ্য দিয়ে নির্বাচনি আবহ ধরে রাখতে চায় ক্ষমতাসীনরা। এক্ষেত্রে দলীয় প্রার্থী বাছাই, নির্বাচনি জনসভা, ইশতেহার প্রণয়ন, উন্নয়ন প্রচার, কেন্দ্রভিত্তিক কমিটি গঠন, কর্মী-জনসভাসহ নির্বাচনি সব কাজও এগিয়ে নিচ্ছে দলটি। এর মধ্য দিয়ে নির্বাচন ও আন্দোলনের মাঠে নেতাকর্মীদের উপস্থিতি বাড়াতে চায় তারা।

এছাড়া বিএনপি না এলেও নির্বাচন যে অংশগ্রহণমূলক হয়, সেই পরিকল্পনা রয়েছে ক্ষতাসীনদের। এ কারণে নির্বাচনে বেশিসংখ্যক দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে চলছে নানা তৎপরতা। এক্ষেত্রে মিত্র ও ইসলামপন্থি দলগুলোকে ভোটে অংশগ্রহণে উৎসাহ দেবে। পাশাপাশি আওয়ামী লীগ অর্থ জোগান, সাংগঠনিক শক্তি ব্যবহার এবং সরকারের বিভিন্ন অঙ্গের সহায়তায় সর্বোচ্চসংখ্যক ভোটারের উপস্থিতি নিশ্চিত করবে। একই সঙ্গে জাতীয় নির্বাচনে তরুণ ভোটার ও নারী ভোটার টানার কৌশল থাকে আওয়ামী লীগের নির্বাচনি ইশতেহারে। এবারও ব্যতিক্রম হচ্ছে না। এ লক্ষ্যে নেওয়া হচ্ছে নানা পদক্ষেপ।

জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আব্দুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, সংবিধান অনুযায়ী যথাসময়ে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এর ব্যত্যয় হওয়ার সুযোগ নেই। নির্বাচনে অংশ নেওয়া না নেওয়া বিএনপির নিজস্ব বিষয়। তারা (বিএনপি) না আসতে চাইলে তো তাদের পায়ে ধরে নিয়ে আসা যাবে না। তিনি আরও বলেন, আওয়ামী লীগ গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল। আমরা নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু করেছি। বিএনপি না এলেও আরও বহু দল আছে, যারা নির্বাচনে অংশ নেবে। এছাড়া নির্বাচনে জনগণের অভূতপূর্ব অংশগ্রহণ থাকবে বলেও মনে করেন আওয়ামী লীগের এই নেতা।

এদিকে নির্বাচন ঘিরে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির অনড় অবস্থানে শঙ্কা বাড়ছে। আওয়ামী লীগ সংবিধান মেনে যথাসময়ে নির্বাচন করার ব্যাপারে অনড়। অন্যদিকে সরকার পতনের একদফা দাবি সামনে রেখে আন্দোলন শুরু করেছে বিএনপি। প্রকাশ্যে দলটির অবস্থান স্পষ্ট-দলীয় সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন নয়। নির্দলীয়, নিরপেক্ষ সরকারে অধীনে নির্বাচন হতে হবে। এমন অবস্থান থেকে হরতাল-অবরোধের মতো কঠোর কর্মসূচিতে চলে গেছে দলটি। ২৮ অক্টোবরের সমাবেশকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট অস্থিরতার পরদিন ২৯ অক্টোবর সারা দেশে একদিনের হরতাল কর্মসূচি পালন করে বিএনপি। এরপর প্রথম দফায় তিন দিন এবং দ্বিতীয় দফায় টানা ৪৮ ঘণ্টার অবরোধ কর্মসূচি পালন করেছে দলটি। তৃতীয় দফায় আজ থেকে আবারও ৪৮ ঘণ্টার অবরোধ ডেকেছে বিএনপি। এখন মাঝে দু-একদিন বিরতি দিয়ে কর্মসূচি ঘোষণা করলেও তফশিলের পর একটানা হরতাল-অবরোধ কর্মসূচির পরিকল্পনা দলটির রয়েছে বলে জানা গেছে।

এদিকে এসব কর্মসূচি ঘিরে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে বেশ কিছু গাড়িতে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। ব্যাহত হচ্ছে আমদানি, রপ্তানি এবং পরিবহণ সেবা। প্রতিবন্ধকতা তৈরি হচ্ছে অফিস-আদালতে যাওয়ার পথেও। অগ্নিসন্ত্রাসের শিকার হওয়ার ভয় রয়েছে সাধারণ মানুষের মধ্যেও। সব মিলিয়ে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে সরকারবিরোধীদের এসব কর্মসূচি ঘিরে রাজনৈতিক অঙ্গনে শুরু হয়েছে অস্থিরতা। জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম মঙ্গলবার যুগান্তরকে বলেন, বর্তমানে দেশের রাজনীতিতে অস্থিরতা চলছে। এই পরিস্থিতি অর্থনীতির জন্য শুভবার্তা বহন করছে না। আগামীতে অস্থিরতা অব্যাহত থাকলে অবশ্যই অর্থনীতিতে বড় ধরনের চাপ আসবে। ফলে আমাদের আমদানি, রপ্তানি এবং পরিবহণ সেবা আরও ব্যাহত হবে। কমবে পণ্য উৎপাদন। ঠিক সময়ে পণ্য সরবরাহ করতে না পারলে বিদেশি ক্রেতারাও ক্রয় আদেশ কমিয়ে দেবে।

তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে যেসব পণ্য আমদানি করা হয়, তার উল্লেখযোগ্য অংশই মূলধনী যন্ত্রপাতি এবং শিল্পের কাঁচামাল। বিনিয়োগের জন্য এই দুটি পণ্য আনা হয়। ফলে এই দুটি পণ্যের আমদানি কমলে স্বাভাবিকভাবেই বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। তার মতে, এমনিতেই দেশে বিনিয়োগ কম। এরপর তা আরও কমলে কর্মসংস্থান ও মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) কমবে। এটি কোনোভাবেই কাম্য নয়। অন্যদিকে অর্থনীতিতে অস্বস্তির জায়গা হলো মূল্যস্ফীতি। ইতোমধ্যে জিনিসপত্রের দাম অনেক বেশি বেড়েছে। রাজনীতির এই অবস্থা মূল্যস্ফীতিতেও প্রভাব ফেলছে। অক্টোবরে মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৯ দশমিক ৯২ শতাংশে পৌঁছেছে। আগামীতে রাজনৈতিক অস্থিরতা অব্যাহত থাকলে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়বে। সবকিছু মিলে বলা যায়, রাজনৈতিক অস্থিরতা অব্যাহত থাকলে পরিস্থিতি সুখকর হবে না।

একই বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আআমস আরেফিন সিদ্দিক যুগান্তরকে বলেন, আমি মনে করি নির্বাচন যথাসময়েই হবে এবং অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনের সক্ষমতা নির্বাচন কমিশনের আছে এবং তারা সেটা করবে। নির্বাচনের বিকল্প নির্বাচন। কাজেই নির্বাচন কতটা ভালো করা যায় সেটাই এখন সব রাজনৈতিক দলের চিন্তা হওয়া উচিত। বিএনপি তাদের এই ধরনের কর্মসূচি না দিয়ে তারা যদি কমিশনের কাছে গিয়ে বলত এই কাজগুলো করলে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে। তারা সুস্পষ্টভাবে তাদের কথাগুলো উল্লেখ করলেই কিন্তু হয়। আমার ধারণা তাহলেই আর সংলাপেরও প্রয়োজন হয় না। আনুষ্ঠানিক সংলাপ ছাড়াও সমস্যার সমাধান করা যায়। কিন্তু এক জায়গায় বসে থাকলে হবে না।

তিনি আরও বলেন, আমি মনে করি তফশিল ঘোষণা হলে আমাদের রাজনীতির চক্রটা অনেক পালটে যাবে। তখন বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল নির্বাচনমুখী হবে। এমনকি দল হিসাবে বিএনপি না এলেও তাদের অনেক নেতাও স্বতন্ত্র হিসাবে নির্বাচনে অংশ নিতে পারে। রাজনীতি কোনো স্থবির বিষয় নয়। ফলে এই ধরনের গতিশীলতা আসবে। তিনি আরও বলেন, সংকট আছে। তবে আমরা কিন্তু সব সময় এই ধরনের সংকট মোকাবিলা করে এসেছি। কারণ দেশের ১৮ কোটি মানুষ কোনো সংকট বা সহিংসতা, সন্ত্রাস চায় না। কাজেই দেশের বেশিরভাগ মানুষ যেটা চায় না, সেটা দিয়ে একটা দেশকে স্থবির করে রাখা যাবে না।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম