নির্বাচনের প্রস্তুতি ও একদফা আন্দোলন
কৌশলী রাজনীতিতে দুদল
রাজপথের নিয়ন্ত্রণ, নির্বাচনসহ নানামুখী প্রস্তুতি আওয়ামী লীগের * আন্দোলন সফল ও মামলা-হামলা মোকাবিলায় নানা উদ্যোগ বিএনপির
তারিকুল ইসলাম ও হাসিবুল হাসান
প্রকাশ: ০৫ নভেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে উত্তপ্ত দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন। নিজেদের লক্ষ্যে পৌঁছাতে ভিন্ন ভিন্ন কৌশল নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি।
ক্ষমতাসীনদের টার্গেট-সংবিধান অনুযায়ী যথাসময়ে নির্বাচন এবং বিএনপির আন্দোলন মোকাবিলা করা।
অন্যদিকে সরকার পতনের একদফা আন্দোলন সফল করতে মাঠের বিরোধী দল বিএনপি পরিস্থিতি বুঝে বিভিন্ন কৌশল নিচ্ছে। দুদলের নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে এসব তথ্য।
আওয়ামী লীগ যেসব পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে, এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে-রাজপথ নিয়ন্ত্রণ, নির্বাচনের নানা প্রস্তুতিসহ নির্বাচনি জনসভা, ইশতেহার প্রণয়ন, বর্তমান সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ড জনসাধারণের কাছে তুলে ধরা, কেন্দ্রভিত্তিক কমিটি গঠন এবং কর্মিসভার আয়োজন।
অপরদিকে তফশিল ঘোষণার আগেই চূড়ান্ত আন্দোলনে নেমেছে বিএনপি। এরই অংশ হিসাবে হরতাল, তিন দিন অবরোধের পর আজ থেকে আবারও ৪৮ ঘণ্টার অবরোধ শুরু হচ্ছে। এরপর টানা আরও কঠোর কর্মসূচির পরিকল্পনা করেছে দলটি।
এছাড়া সারা দেশে টিম গঠনের পাশাপাশি মামলা-হামলা মোকাবিলায় নেওয়া হয়েছে নানা উদ্যোগ। গ্রেফতার এড়ানোসহ একগুচ্ছ বার্তাও ইতোমধ্যে তৃণমূলে দেওয়া হয়েছে।
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য লে. কর্নেল (অব.) মুহাম্মদ ফারুক খান যুগান্তরকে বলেন, যথাসময়ে নির্বাচন হবে। আমরা আশা করছি, নির্বাচন কমিশন শিগগিরই নির্বাচনের শিডিউল ঘোষণা করবে। আওয়ামী লীগ নির্বাচনমুখী গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল।
ইতোমধ্যে আমাদের নির্বাচনি কাজ শুরু হয়ে গেছে। শিডিউল ঘোষণার পর নির্বাচনি কাজ আরও গতিশীল হবে। আমাদের দলীয় সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও ইতোমধ্যে দলের নেতাকর্মীদের নির্বাচনি প্রস্তুতির পাশাপাশি বিএনপি-জামায়াতের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে সজাগ ও সতর্ক থাকার নির্দেশনাও দিয়েছেন।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান বলেন, যারা ভাবছেন সরকারের প্রশাসনযন্ত্র ব্যবহার করে সারা দেশে ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টির মাধ্যমে এবং মিডিয়ায় অপপ্রচারের সুযোগ নিয়ে বিএনপিকে নেতৃত্বশূন্য ও নিশ্চিহ্ন করে দেবেন, তাদের উদ্দেশে বলতে হয়-বিএনপি এমন একটি রাজনৈতিক দল, যার ভিত্তি হচ্ছে তৃণমূলের জনগণের শিকড়ে। তার ওপরে রয়েছেন মধ্যসারির ও স্থানীয় পর্যায়ের নেতারা।
সবার শীর্ষে এ দুয়ের ওপরে শক্ত মাটির ওপরে দাঁড়িয়ে আছে বিএনপিকে যারা সমন্বয় করে দিকনির্দেশনা দেন সেই কেন্দ্রীয় নেতারা। কয়েকদিনে সবাই প্রত্যক্ষ করেছেন, যাকেই যেখানে গ্রেফতার করে নিয়ে যাচ্ছে, সেখানে তাৎক্ষণিকভাবে নতুন নেতৃত্ব গড়ে উঠছে জনগণের মধ্য থেকে।
তিনি বলেন, যতদিন না এদেশের মানুষের গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার সংগ্রাম সফল হবে, ততদিন নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন চলতেই থাকবে। কাজেই মিথ্যা মামলা-হামলা আর গ্রেফতার-আটকের মাধ্যমে জনগণের গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে স্তব্ধ করা যাবে না।
আওয়ামী লীগ: দেশবিদেশে ভোট নিয়ে যেন কোনো সমালোচনা না হয়, এজন্য আওয়ামী লীগও চায় বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিক। আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা বারবার বিএনপিকে ভোটে আসার আহ্বানও জানাচ্ছেন।
এক্ষেত্রে একাধিকবার সংবিধানের মধ্যে থেকে ছাড় দেওয়ার কথাও বলেছে ক্ষমতাসীনরা। কিন্তু সংবিধানের বাইরে না যাওয়া এবং এ নিয়ে বিএনপির সঙ্গে এবার আর কোনো ধরনের আলোচনা না বসার ব্যাপারে এখন পর্যন্ত অনড় আওয়ামী লীগ। সেক্ষেত্রে বিএনপি নির্বাচনে না এলেও সংবিধান মেনে যথাসময়ে নির্বাচন করার কথা দৃঢ়তার সঙ্গেই বলছেন দলটির শীর্ষ নেতারা।
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, আমরা সর্বাত্মকভাবে আমাদের নির্বাচনি প্রস্তুতি নিচ্ছি। বিএনপি নির্বাচনে এলে আসবে, না এলে নেই। কিন্তু আমরা আমাদের সব প্রস্তুতি রাখছি। তাদের মাইনাস করে আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছি না। কারণ, আমরা চাই তারা (বিএনপি) নির্বাচনে আসুক। আমরা সেভাবেই আমাদের নির্বাচনের সব প্রস্তুতি নিচ্ছি।
দলীয় সূত্রে জানা যায়, নির্বাচনি জনসভা, ইশতেহার প্রণয়ন, উন্নয়ন প্রচার, কেন্দ্রভিত্তিক কমিটি গঠন, কর্মী-জনসভাসহ নির্বাচনি সব কাজও এগিয়ে নিচ্ছে দলটি। শুরু হয়েছে দলীয় প্রার্থী বাছাইয়ের কাজও। একাধিক বৈঠকে প্রার্থী বাছাইয়ের বিষয়ে ইঙ্গিতও দিয়েছেন দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা। এবার যে দলীয় মনোনয়ন কঠিন হবে, তা তিনি স্পষ্টই জানিয়ে দিয়েছেন।
বিভিন্ন মাধ্যমে জরিপ পরিচালনার কথা জানিয়ে শেখ হাসিনা দলের নেতাকর্মীদের বলেছেন, আগামী নির্বাচন কঠিন হবে। সেই নির্বাচনে সবদিক বিবেচনা করে যোগ্যদের দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হবে। আর দল যাকে মনোনয়ন দেবে, তার পক্ষেই কাজ করতে কঠোর নির্দেশনাও দিয়েছেন তিনি।
আওয়ামী লীগ ইতোমধ্যে ঘোষণা দিয়েছে, আগামী নির্বাচনও তারা ১৪ দলীয় জোটগতভাবে করবে। এর বাইরে ছোট-বড় অন্য রাজনৈতিক দলগুলোকেও নির্বাচনি মাঠে রাখতে তাদের সঙ্গে গভীর যোগাযোগও রাখছে। দলীয় সূত্রে জানা যায়, আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতাদের চাওয়া-দল ও সহযোগী সংগঠনের সব পর্যায়ের পদধারী নেতা এবং তাদের পরিবার ও আত্মীয়স্বজনকে ভোটে নিয়ে আসা।
এজন্য সারা দেশে জেলা, মহানগর, উপজেলা, থানা, পৌরসভা, ইউনিয়ন, ওয়ার্ড পর্যায়ে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন স্তরের কমিটিতে পদধারী কত নেতা রয়েছেন, এ বিষয়ে একটি তালিকা করা হয়েছে। এ তালিকা দলের কেন্দ্রীয় নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে জাতীয় নির্বাচনে তরুণ ভোটার ও নারী ভোটার টানার কৌশল থাকে আওয়ামী লীগের নির্বাচনি ইশতেহারে। এবারও এর ব্যতিক্রম হচ্ছে না। ইতোমধ্যে দলটি তাদের ইশতেহারে তরুণ প্রজন্মকে আকৃষ্ট করতে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ বিনির্মাণের ঘোষণা দিয়েছে।
বিএনপি: নেতাকর্মীদের গ্রেফতারের মধ্যেও আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোনো বিকল্প দেখছে না বিএনপি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দলটির একজন স্থায়ী কমিটির সদস্য যুগান্তরকে বলেন, সরকার বিএনপিকে ভাঙার তৎপরতায় নেমেছে বলে তাদের কাছে তথ্য রয়েছে। দুজন ভাইস চেয়ারম্যানসহ একাধিক নেতা হাইকমান্ডকে জানিয়েছেন, তাদেরকে বিভিন্নভাবে ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে। এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে কেন্দ্রীয় নেতাদের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
স্থায়ী কমিটির ওই নেতা মনে করেন, সিনিয়র নেতাদের গ্রেফতারও এরই অংশ হতে পারে। তবে গত ১৫ বছর বিএনপিকে ভাঙার অনেক চেষ্টা হয়েছে; কিন্তু পারেনি। নির্বাচনের আগ মুহূর্তে তা একেবারেই অসম্ভব। বরং এখন আগের চেয়ে নেতারা আরও ঐক্যবদ্ধ। একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা মনে করেন, এ সরকার ক্ষমতায় থাকলে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত কাউকে মুক্তি দেওয়া হবে না। তাই সামনে ‘অসহযোগ’ আন্দোলন নাম দিয়ে অবরোধ ও হরতালের মতো কঠোর কর্মসূচি দেওয়ারও পরিকল্পনা রয়েছে। এছাড়াও যুগপৎ আন্দোলনের বাইরে থাকা আরও বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দলও আগামী দিনে আন্দোলনে মাঠে থাকবে বলেও জানান নেতারা।
সম্প্রতি ভার্চুয়ালি এক বৈঠকে সরকারের কঠোর মনোভাব, দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মনোভাব নিয়ে বিচারবিশ্লেষণ করেন নীতিনির্ধারকরা। নেতারা মনে করেন, চলমান আন্দোলন দেশে-বিদেশে সবার কাছে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। হরতাল ও অবরোধ উভয় কর্মসূচিতে জনগণের সমর্থন ছিল। সরকারের দমন-পীড়নের বিষয়ে জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্রসহ গণতান্ত্রিক বিশ্বের প্রতিক্রিয়া ইতিবাচক। সরকার দেশে এবং দেশের বাইরে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।
নীতিনির্ধারকদের পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, রাজনীতিতে টিকে থাকতে হলে বিএনপিকে কঠোর কর্মসূচি নিয়েই রাজপথে থাকতে হবে।
কূটনীতিকদের সঙ্গে কাজ করেন বিএনপির এমন এক সিনিয়র নেতা বলেন, দেশের পরিস্থিতি যেখানে গিয়ে ঠেকেছে, মুক্তি পেতে হলে গণতান্ত্রিক বিশ্বের হস্তক্ষেপ ছাড়া আর কোনো উপায় দেখছে না বিএনপি। তাদের বিশ্বাস, খুব শিগগিরই সরকারের ওপর গণতান্ত্রিক বিশ্ব থেকে চাপ আসবে। সেটা হলে নেতাকর্মীরা আরও চাঙা হবে বলে মনে করেন ওই নেতা।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্মমহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, ব্যাপক ধরপাকড় চলছে। নেতাকর্মীদের ধরতে গিয়ে তাদের বাসায় না পেয়ে বাবা-ভাইকে আটক করছে। এতে লাভ নেই। দেশের জনগণ দাবি আদায়ে হাতের মুঠোয় জীবন নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়েছে। আন্দোলন দমানোর জন্য সরকারের কোনো কৌশলই সফল হবে না। বিএনপির নেতৃত্বকেও দুর্বল করা যাবে না। কারাগারের বাইরে থাকা বিএনপির সর্বশেষ ব্যক্তিটি আন্দোলনের নেতৃত্ব দেবে। বিজয় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে।
সূত্রমতে, আন্দোলন সফল করতে নানা পরিকল্পনা নিয়ে এগুচ্ছে বিএনপি। দলীয় নেতাকর্মীদের পাশাপাশি যাতে সাধারণ মানুষও এতে অংশ নেয়, এ ব্যাপারে বিশেষভাবে জোর দেওয়া হচ্ছে। একই সঙ্গে মামলা মোকাবিলায় নেতাকর্মীদের পাশে দাঁড়াতে বিএনপিপন্থি আইনজীবীদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে হামলায় আহতদের সুচিকিৎসা দিতে তাদের চিকিৎসকদের বলা হয়েছে। এজন্য গঠন করা হয়েছে কয়েকটি টিমও। জানতে চাইলে দলটির আইনবিষয়ক সম্পাদক ও জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের মহাসচিব ব্যারিস্টার কায়সার কামাল যুগান্তরকে বলেন, সারা দেশে নেতাকর্মীদের মামলা আগে থেকেই পরিচালনা করে আসছেন আমাদের আইনজীবীরা। তাদের এ বিষয়ে সব দিকনির্দেশনা দেওয়া রয়েছে।
বিএনপির স্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পাদক ডা. রফিকুল ইসলাম বলেন, সরকারি-বেসরকারি মেডিকেলে আমাদের টিম সব সময় প্রস্তুত থাকে। আহত নেতাকর্মীদের চিকিৎসার জন্য তারা কাজ করে যাচ্ছেন।