মহাখালীর খাজা টাওয়ারে আগুন, তিনজনের মৃত্যু
১০ জনকে জীবিত উদ্ধার, বাঁচার আকুতি * ইন্টারনেট সার্ভার বন্ধ, ঢাকায় সেবা ব্যাহত
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ২৭ অক্টোবর ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
রাজধানীর মহাখালীর ১৪ তলাবিশিষ্ট খাজা টাওয়ারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে দুই নারীসহ তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। ভবনটির ১৩ তলায় লাগা এই আগুনে আতঙ্কে হুড়োহুড়ি করে এবং ভবন থেকে বেরোতে গিয়ে আহত হয়েছেন অনেকে।
বাঁচার আকুতি শোনা যায় আটকেপড়াদের। আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ইন্টারনেট সরবরাহকারীদের আন্তঃসংযোগ এক্সচেঞ্জ (আইসিএক্স)। এতে ঢাকার ইন্টারনেট সেবা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়েছে। অনলাইনে লেনদেনেও ছিল ধীরগতি।
সপ্তাহের শেষ কর্মদিবস বৃহস্পতিবারের এ অগ্নিদুর্ঘটনায় কয়েক ঘণ্টার জন্য থমকে যায় মহাখালী ও এর আশপাশের এলাকার মানুষের জীবনযাত্রা। বন্ধ হয়ে যায় ভবনটির সামনের সড়কে যান চলাচল। এতে অফিস ছুটি শেষে বাড়ি ফেরা মানুষজন চরম ভোগান্তিতে পড়েন। রাজধানীর সড়কের বড় অংশজুড়ে এর প্রভাব পড়ে।
বৃহস্পতিবার রাত দেড়টা পর্যন্ত আগুন সম্পূর্ণভাবে নেভেনি। বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে।
ফায়ার সার্ভিস জানায়, বিকাল ৪টা ৫৮ মিনিটে তারা আগুন লাগার সংবাদ পান। ৫টা ৭ মিনিটে প্রথম ইউনিট পৌঁছে আগুন নেভানোর কাজ শুরু করে। একে একে ১১টি ইউনিট আগুন নেভাতে কাজ করে। যোগ দেয় সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী।
মোতায়েন করা হয় পুলিশ, বিজিবি ও আনসার সদস্যদের। নিয়ে আসা হয় বহুতল ভবনের আগুন নেভাতে ব্যবহৃত টার্ন টেবল লেডার (টিটিএল)। আগুনে ভবনটির ভেতরে অনেকেই আটকা পড়েন। তাদের উদ্ধারে কাজ করে ফায়ার সার্ভিসের বিশেষ দল। এর মধ্যে আগুনে আতঙ্কিত হয়ে অনেকেই ভবনের সঙ্গে লাগোয়া বিভিন্ন সংযোগের তার ধরে নিচে নামার চেষ্টা করেন। শুরুর দিকের হতাহতের ঘটনাগুলো এ কারণেই ঘটেছে।
রাত নয়টার দিকেও ভবনটিতে অনেকের আটকে পড়ার খবর জানা গেছে। তখন ফায়ার সার্ভিসসহ অন্য সংস্থাগুলো ভবনের ভেতরে প্রবেশের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। রাত নয়টার দিকে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে আসেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম।
আগুনে আতঙ্কিত হয়ে ইন্টারনেটের তার ধরে নামার সময় পড়ে গিয়ে মৃত্যু হয় হাসনা হেনা (২৭) নামে এক নারীর। রাত ১২টা ৩৫ মিনিটে আকলিমা রহমান নামের এক নিখোঁজ নারীর মরদেহ উদ্ধার করে ফায়ার সার্ভিস। তিনি ভনটিতে থাকা রেস অনলাইন লিমিটেডে কাজ করতেন। তার মরদেহ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়।
মৃত্যু হয়েছে মো. রফিকুল ইসলাম (৬২) নামে এক ব্যক্তির। তাকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেলে নিলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এছাড়া রাত সোয়া একটা পর্যন্ত সাত পুরুষ ও তিন নারীকে উদ্ধার করা হয়। শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে অন্তত চারজনকে অসুস্থ অবস্থায় ভর্তি করা হয়েছে।
সরেজমিন দেখা যায়, ভবনটিতে বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অফিস রয়েছে। আগুনের কারণে ভবনটির ১১, ১২, ১৩ ও ১৪ তলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বন্ধ করে দেওয়া হয় ওই এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ। ফলে গোটা এলাকা অন্ধকার হয়ে পড়ে।
আতঙ্কে বহু মানুষ ভবনের ছাদে জড়ো হয়। দড়ি বেয়ে ঝুঁকি নিয়ে পাশের ভবনের ছাদে নামছিল কেউ কেউ। ভবনের বিভিন্ন ফ্লোরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে মোবাইলের লাইট জ্বালিয়ে বাঁচার আকুতি জানাচ্ছিলেন আটকে পড়া অনেকে। ঘটনাস্থলে দুটি লেডার সংবলিত অগ্নিনির্বাপণ ও উদ্ধারকাজের গাড়ি টিটিএল নেওয়া হয়।
এগুলো দিয়ে টাওয়ারের বিভিন্ন ফ্লোরের গ্লাস ভাঙা হয়। প্রাথমিকভাবে আগুন লাগার কারণ ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানা যায়নি।
ফায়ার সার্ভিসের নিয়ন্ত্রণ কক্ষের ডিউটি অফিসার রাফি আল ফারুক বলেন, ঘটনাস্থলে দুটি লেডার সংবলিত অগ্নিনির্বাপণ ও উদ্ধারকাজের গাড়ি (টিটিএল) নেওয়া হয়েছে। টিটিএল দিয়ে টাওয়ারের বিভিন্ন ফ্লোরের গ্লাস ভাঙা হয়। অনেকে ফোন দিয়ে আমাদের বলেন, ভবনের ভেতরে মানুষ আটকে আছে।
ঘটনাস্থলে ফায়ার সার্ভিসের পরিদর্শক এনায়েত উল হক যুগান্তরকে বলেন, আগুনের কারণে ভবনের বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ হয়ে যায়। এ কারণে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের হেঁটে ১০ তলার ওপরে ওঠানামা করতে হয়। এতে তাদের কাজে কিছুটা বেগ পেতে হয়।
রাত ৯টা ১০ মিনিটে দুর্ঘটনাকবলিত ভবনটি থেকে বেরিয়ে আসেন মো. সোহেল নামে রেড ক্রিসেন্টের এক উদ্ধারকারী। ভেতরের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তিনি বলেন, ভেতরে অনেকে আটকা আছেন বলে শুনেছি। প্রচণ্ড ধোঁয়ার কারণে উদ্ধারকাজে বেগ পেতে হচ্ছে।
মহাখালীর আমতলীর খাজা টাওয়ারের আগুন সন্ধ্যা সাতটা থেকে নিয়ন্ত্রণে এসেছে তবে পুরোপুরি নির্বাপণে এখনও সময় লাগবে বলে জানিয়েছেন ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন।
বৃহস্পতিবার রাত পৌনে ১২টার দিকে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে তিনি এ তথ্য জানান। তিনি বলেন, এখনো ভেতরে আগুন আছে। কারণ ভেতরে ব্যাটারি, স্টোর, ক্যাবল, সুইচ রয়েছে। এখানে সামগ্রিকভাবে সেফটি প্ল্যান ছিল না। দাহ্য পদার্থ বেশি থাকায় আগুন ছড়িয়েছে। সাড়ে সাতটা থেকে আগুন নিয়ন্ত্রণে কিন্তু নির্বাপণে সময় লাগবে আরও। আগুন নেভানোর পরও বারবার করে জ্বলে উঠছে।
ফায়ার সার্ভিসের ডিজি বলেন, প্রায় দেড় শতাধিক ফায়ার ফাইটার আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করেছে। আগুন বাইরে তেমন ছিল না। অনেক সময় নেওয়া হয় একজন মানুষকে উদ্ধার করার জন্য। দুজন প্রথমে লাফিয়ে পড়ে। তাদের হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়।
আগুন লাগার কারণ হিসাবে তিনি বলেন, আপাতদৃষ্টিতে ধারণা করা হচ্ছে বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট থেকে আগুন লেগেছে। তদন্ত শেষে নিশ্চিত বলা যাবে কোথায় এবং কেন আগুন লেগেছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের গুলশান বিভাগের ডিসি মো. শহিদুল্লাহ যুগান্তরকে বলেন, মহাখালী অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি এলাকা। কর্মদিবস থাকায় এখানে অনেক লোকের সমাগম হয়েছিল। আগুন লাগার পর প্রচুর উৎসুক জনতা ঘটনাস্থলে ভিড় করে। এতে উদ্ধারকারীদের কাজে বেগ পেতে হয়।
ঢাকায় ইন্টারনেট সেবা ব্যাহত : খাজা টাওয়ারে অগ্নিকাণ্ডে টাওয়ারটিতে থাকা আন্তঃসংযোগ এক্সচেঞ্জ (আইসিএক্স) অপারেটরদের সংযোগ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ইন্টারনেট সেবা ব্যাহত হচ্ছে।
একাধিক অপারেটর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, মহাখালীর অগ্নিকাণ্ডের কারণে ইন্টারনেট সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
ফলে গ্রাহকরা নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারেনট সেবা পাচ্ছেন না। এছাড়া রেলওয়ের উন্নয়ন কাজের জন্যও ফাইবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সবমিলিয়ে গ্রাহকরা ইন্টারনেট সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। ইন্টারনেট না থাকায় ফেসবুক, টিকটকসহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঢোকা যাচ্ছে না বলে অনেকে টেলিফোনে যুগান্তরকে জানিয়েছেন।
ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার অ্যাসোসিয়েশনের (আইএসপিএবি) সভাপতি ইমদাদুল হক বলেন, বিকাল ৫টার দিকে আগুন লাগার পরপরই ইন্টারনেট সার্ভার বন্ধ হয়ে যায়। ৪০ ভাগ ইন্টারনেট সেবা ইতোমধ্যে বন্ধ রয়েছে। আরও বন্ধ হতে পারে। ইমদাদুল হক আরও বলেন, খাজা টাওয়ারের ট্রান্সমিশনে দুটি ডাটা সেন্টার রয়েছে যারা ঢাকার অনেক বড় এলাকা কভার করছে। আগুন লাগার কারণে তাদের কেবল ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
ইমদাদুল হক বলেন, খাজা সেন্টারে লেভেল থ্রি, ম্যাক্স হাব, আমরা নেটওয়ার্কস, আর্থনেট ও উইনস্ট্রিম আইআইজি পুড়ে গেছে। ফলে আমরা এরই মধ্যে ৭০-৮০ শতাংশ ব্যান্ডউইথ হারিয়েছি। কবে নাগাদ ইন্টারনেটের এই গতি ফিরবে, সে বিষয়ে এখনই কিছু বলা যাচ্ছে না।
রাস্তা বন্ধ, যানজট : খাজা টাওয়ারে আগুন লাগার পর আমতলী থেকে গুলশান এক নম্বরমুখী সড়কের দুই পাশে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এতে আশপাশের এলাকায় যানজট তৈরি হয়। গুলশানগামী যানবাহন মহাখালী অংশে এবং মহাখালীর দিকে যাওয়া যানবাহন তিতুমীর কলেজ অংশে ঘুরিয়ে দেওয়া হচ্ছিল।