পুলিশের ভয় দেখিয়ে অভিযোগ তুলে নেওয়ার ফন্দি
উপসচিবের মামলার জালে বিচারপ্রার্থীর সর্বনাশ
নেসারুল হক খোকন
প্রকাশ: ১৫ অক্টোবর ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বিয়ের প্রলোভনে অনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের বিচার চেয়ে মামলা করেছিলেন স্কুলশিক্ষিকা। এতেই বিপত্তি বাধে। অভিযুক্ত কর্মকর্তা বিচারপ্রার্থীকে কাবু করতে থানা পুলিশের সহযোগিতায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে বিভিন্ন থানায় চারটি মামলা দিয়েছেন।
যার বিরুদ্ধে নৈতিকস্খলনের এই অভিযোগ তিনি একজন উপসচিব, নাম ড. সঞ্জয় চক্রবর্তী। সর্বশেষ তিনি রাজশাহী কারা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের প্রকল্প পরিচালক ছিলেন। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বিভাগীয় তদন্তে এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দেওয়া অভিযোগের সত্যতা মিলেছে।
এ ঘটনায় বিভাগীয় মামলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের শৃঙ্খলা শাখা। আর অভিযুক্ত উপসচিব বিচারপ্রার্থী ভিকটিমকে জেলে রাখতে একটার পর একটা মামলা দিয়েই চলেছেন।
এসব মামলার কারণ দেখিয়ে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার ভিকটিমকে সাময়িকভাবে বরখাস্তও করেছেন। এর মধ্যে সুজন নামে একজন বাদী অভিযুক্ত উপসচিবের বন্ধু পরিচয়ে দুই থানায় একই অভিযোগে দুটি মামলা করার সুযোগ নিয়েছেন। যা নজিরবিহীন।
জানা যায়, কোনো রকম প্রাথমিক তদন্ত ছাড়াই ভিকটিম এই শিক্ষিকার বিরুদ্ধে পুলিশ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা রেকর্ড করেই যাচ্ছে। এমনকি তাকে দ্বিতীয় দফায় গ্রেফতার করতে গোপনে অভিযান চালাচ্ছে।
একটি মামলায় দুই মাস জেল খেটে জামিনে বের হওয়ার পর আবারও আরেকটি মামলা দেওয়া হয়েছে রাজধানীর শাহবাগ থানায়। এই ভিকটিম স্কুলশিক্ষিকার বাড়ি মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগরে। তিনি স্থানীয় একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকা।
আর অভিযুক্ত সঞ্জয় চক্রবর্তী সর্বশেষ রাজশাহী কারা প্রশিক্ষণ একাডেমির প্রকল্প পরিচালক ছিলেন। বর্তমানে তাকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগে ন্যস্ত করা হয়েছে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একজন পদস্থ কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, ‘বিভাগীয় তদন্তে ড. সঞ্জয় চক্রবর্তীর বিরুদ্ধে শিক্ষিকার অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে। ২০ বিসিএসের একজন কর্মকর্তার এভাবে চারিত্রিক অধঃপতনে প্রশাসন ক্যাডারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছে।
পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করে যুগ্মসচিব পর্যায়ের একজন কর্মকর্তা তার বিরুদ্ধে প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন। কয়েকদিনের মধ্যেই তদন্তসংক্রান্ত শৃঙ্খলা কমিটি বিভাগীয় মামলা রুজু করবে।’
উপসচিব সঞ্জয় চক্রবর্তীর বিরুদ্ধে শিক্ষিকার অভিযোগ, তিনি বিয়ের আশ্বাস দিয়ে তাকে দফায় দফায় ধর্ষণ করেছেন। মামলা তুলে নেওয়ার জন্য ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে উপসচিব সঞ্জয় চক্রবর্তী ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ৪টি মামলা দিয়েছেন। একটা মামলায় জামিন হওয়ার পর আরেকটি মামলা দিয়েছেন।
অথচ একজন নির্যাতিত নারী হিসাবে যেখানে পুলিশ আমাকে সহযোগিতা করবে সেখানে উলটো গ্রেফতার করে জেলে দিয়েছে। এটা কেমন বর্বর আচরণ!
শিক্ষিকা বলেন, ‘ফেসবুকে পরিচয় হয় উপসচিব সঞ্জয় চক্রবর্তীর সঙ্গে। পরিচয় থেকেই তার সঙ্গে বন্ধুত্ব। একপর্যায়ে তাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠে। সঞ্জয় নিজেকে অবিবাহিত পরিচয় দিয়ে তাকে বিয়ের আশ্বাস দেন। এভাবেই সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হতে থাকে। একপর্যায়ে তারা ঢাকার ফকিরাপুলের একটি হোটেল ছাড়াও চাঁদপুর ও মুন্সীগঞ্জগামী যাত্রীবাহী লঞ্চের কেবিন ভাড়া নিয়ে স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে যাতায়াত করেছেন। ওই সময়ই তার সর্বনাশ যা হওয়ার হয়ে গেছে।’
এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘আমাকে বিভ্রান্ত করেছেন সঞ্জয় চক্রবর্তী। এই মানের একজন কর্মকর্তা এতটা নীচ হতে পারে ভাবতে অবাক লাগে।’
তিনি বলেন, বিয়ের কথা বললে সঞ্জয় চক্রবর্তী নিজেকে বিবাহিত বলে প্রকাশ করেন এবং তাকে বিয়ে করা সম্ভব নয় বলে জানান। এরপরই ২০২১ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-২ এ ক্ষুব্ধ শিক্ষিকা উপসচিব সঞ্জয়ের বিরুদ্ধে পিটিশন মামলা করেন।
২০০০ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন (সংশোধনী-০৩) এর ৯(১) ধারার অভিযোগটি আমলে নিয়ে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) তদন্তের নির্দেশ দেন আদালত। ২০২২ সালের ২৬ জানুয়ারি পিবিআইর এসআইএন্ডও (অর্গানাইজড ক্রাইম দক্ষিণ) পরিদর্শক ও মামলাটির তদন্তকারী মো. মেছবাহ উদ্দিন পিবিআই প্রধান কার্যালয়ে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেন।
এক মাস পর ওই বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি পিবিআই থেকে মামলার তদন্ত প্রতিবেদন সংশ্লিষ্ট আদালতে দাখিল করা হয়।
পুলিশ প্রতিবেদনের একস্থানে এ বিষয়ে বলা হয়, ‘উভয়ের (শিক্ষিকা-উপসচিব সঞ্জয় চক্রবর্তী) সম্মতিতে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করেছেন।’
ধর্ষণের কিছু আলামত পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য সিআইডিতে পাঠিয়ে দিয়ে এ প্রসঙ্গে তদন্তকারী কর্মকর্তা বলেছেন, কিছু আলামত জব্দ করে বাদিনী ও বিবাদীর ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করে সিআইডিতে পাঠানো হয়। মতামত পাওয়া যায়নি। মতামত না পাওয়া পর্যন্ত এ সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু বলা যাচ্ছে না।’
প্রতিবেদনের আরেক স্থানে বলা হয়, ‘আমার এ যাবৎ তদন্তে দেখা গেছে, বিভিন্ন সাক্ষ্যপ্রমাণ গ্রহণ এবং বাদিনী ও বিবাদীর আলাদা মোবাইল, ফেসবুক মেসেঞ্জারে যোগাযোগ ছিল। তারা নিজেদের মধ্যে বিভিন্ন মেসেজ আদান-প্রদান করেছেন। হোটেলে ও লঞ্চে যাওয়ার বিষয়ে মোবাইল ও মেসেঞ্জারে যোগাযোগের তথ্য রয়েছে।’
তদন্তে সীমাবদ্ধতার বিষয়টি উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘আদালত ২০২২ সালের ২৭ জানুয়ারির মধ্যে অনুসন্ধান প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ করেছেন। এ কারণে ডিএনএ মতামত ছাড়া বাদীনির ধর্ষণের অভিযোগ তথা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ (সংশোধনী-৩)এর ৯(১) ধারার অভিযোগের সুস্পষ্ট মতামত প্রদান করা সম্ভব নয়।’
এই প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে নারাজি আবেদন করেন ভুক্তভোগী শিক্ষিকা। আবেদনটি গ্রহণ না করে আদালত খারিজ করেন। এরপর শিক্ষিকা উচ্চ আদালতে রিট পিটিশন নং (৪০৭৩) দায়ের করেন। রিটটি প্রাথমিক শুনানি হয়েছে। যে কোনো সময় এ বিষয়ে চূড়ান্ত শুনানির জন্য অপেক্ষায় আছে।
ভিকটিমকে কাবু করতে যত মামলা : এদিকে উপসচিব সঞ্জয় চক্রবর্তীর বন্ধু পরিচয়ে সুজন নামে একজনের একটি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলার কারণে ভিকটিম স্কুলশিক্ষিকাকে সাময়িক বরখাস্ত করেন মুন্সীগঞ্জের তৎকালীন জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মাসুদ ভূঁইয়া।
১০ এপ্রিল এ সংক্রান্ত এক অফিস আদেশে তিনি উল্লেখ করেন, ‘শ্রীনগর উপজেলার গাদিঘাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকার বিরুদ্ধে ২৪/৩৫ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮ এ ধারায় থানায় মামলা হয়। মামলা নং ৩৯, তারিখ ১৯ মার্চ ২০২৩।
মামলার প্রেক্ষিতে শিক্ষিকাকে পুলিশ ৪ এপ্রিল গ্রেফতার করে। সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা ২০১৮-এর বিধি ১২ অনুযায়ী গ্রেফতারের তারিখ থেকে সংশ্লিষ্ট শিক্ষিকাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হলো।’
এই মামলায় দুই মাস জেল খেটে ১৮ জুলাই ভিকটিম কারাগার থেকে জামিনে ছাড়া পান। এরপর কারাগার থেকেই জানতে পারেন একই ধারায় রাজশাহীর রাজপাড়া থানায় আরেকটি মামলায় তাকে শ্যোন অ্যারেস্ট দেখানো হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মামলাটির বাদী আরমানুজ্জামান বাঁধন। তিনি নিজেকে সঞ্জয় চক্রবর্তীর ব্যক্তিগত গাড়ি চালক পরিচয়ে ২০ এপ্রিল রাজশাহীর রাজপাড়া থানায় ২০১২ সালের পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন ৮-এর (২), (৩), (৫), (ক), (৭) ধারায় ভিকটিম শিক্ষিকার বিরুদ্ধে মামলাটি করেন। মামলা নং ১১।
তারিখ ২০ এপ্রিল ২০২৩। মামলাটিতে মূল অভিযোগ হচ্ছে-‘ইলেকট্রনিক্স ডিভাইস ব্যবহার করে অশ্লীল সংলাপ দ্বারা ব্যক্তির মর্যাদাহানি, ইন্টারনেট/মোবাইল ফোনে সরবরাহ করে বিতরণ ও সহযোগিতার অপরাধ। মামলাটি যখন দায়ের করা হয় তখন সঞ্জয় চক্রবর্তী রাজশাহী মহানগরীর রাজপাড়া থানা এলাকায় কারা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র প্রকল্পের পরিচালক ছিলেন।
বাদীর বর্তমান ঠিকানাও কারা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র দেওয়া আছে। রাজশাহীর ডিবিকে মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এই মামলার বাদীর গ্রামের বাড়ি খুলনার সোনাডাঙ্গায়। ১৯ মার্চ সুজন নামে একজন সঞ্জয় চক্রবর্তীর বন্ধু পরিচয়ে ভিকটিম শিক্ষিকা ও তার আপন দুই বোনকে আসামি করে মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর থানায় মামলা করেন। থানার তৎকালীন ওসি মো. আমিনুল ইসলাম ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২০১৮ এর ২৪/৩৫ ধারায় মামলাটি রেকর্ড করেন। শ্রীনগর থানার মামলা নং ৩৯, তারিখ ১৯ মার্চ ২০২৩।
জানা যায়, সঞ্জয় চক্রবর্তীর বিরুদ্ধে শিক্ষিকার দায়েরকৃত মামলায় তার দুই বোন সাক্ষী হওয়ায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় আসামি করা হয়। ভিকটিম এই মামলায় ২ মাস জেল খেটে বের হলেও তার দুই বোন এই মামলায় এখনো পলাতক।
এখানেই শেষ নয়, সঞ্জয় চক্রবর্তীর স্ত্রী ত্রোপা চক্রবর্তীকে বাদী করেও ভিকটিম শিক্ষিকার বিরুদ্ধে রাজধানীর চকবাজার থানায় মামলা করিয়েছেন। মামলা নং ২৩, তারিখ ১১ মার্চ ২০২৩। চকবাজার থানার ওসি আবদুল কাইউম ত্রোপা চক্রবর্তীর মামলাটি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৪(১)(ক)২৫(ক)/২৬(১)/২৯(১) ধারায় রেকর্ড করেন।
সর্বশেষ যে মামলাটি শাহবাগ থানায় রেকর্ড হয় সেটির বাদীও সুজন। শাহবাগ থানার মামলা নং ৪০, তারিখ ৩০ আগস্ট ২০২৩। এই সুজন সঞ্জয় চক্রবর্তীকে বন্ধু পরিচয় দিয়ে তার পক্ষে মামলাটি করেন। শাহবাগ থানার ওসি নুর মোহাম্মদ সুজনের এই মামলাটি পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইনের ২০১২ এর ৮ (১)(২)(৩) ধারায় রেকর্ড করেন। বুধবার এই মামলায় হাইকোর্ট থেকে আগাম জামিন নিয়েছেন ভিকটিম।
সঞ্জয় চক্রবর্তী যা বললেন : অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ড. সঞ্জয় চক্রবর্তী যুগান্তরকে বলেন, ভিকটিম শিক্ষিকার অভিযোগ আদালতে নাকচ হয়েছে। আমিই বরং তার দ্বারা হয়রানির শিকার হয়েছি। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ভিকটিমের বিরুদ্ধে যে কয়টি মামলা হয়েছে, সেগুলো আমার পক্ষ থেকেই হয়েছে। সাধারণ ডায়েরি তদন্তে সত্যতা পাওয়ার পরই প্রত্যেকটি মামলা হিসাবে রেকর্ড হয়েছে।
আমি নিজেই মামলা করতে পারতাম, যেহেতু সরকারি চাকরি করি, এ কারণে করিনি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পুলিশ প্রথম তদন্ত প্রতিবেদনে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনের বিষয়ে লিখলেও ডিএনএ প্রতিবেদনে কোনো আলামত পায়নি।
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিভাগীয় তদন্তে অভিযোগের সত্যতা পেয়েছে কি না আমি জানি না। এ বিষয়ে আমাকে কিছুই জানানো হয়নি।