Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

দাম বাড়ায় ভোগান্তি শুরু

অতিরিক্ত বিদ্যুৎ বিলে নাভিশ্বাস গ্রাহকের

Icon

মুজিব মাসুদ

প্রকাশ: ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

অতিরিক্ত বিদ্যুৎ বিলে নাভিশ্বাস গ্রাহকের

বিদ্যুতের অতিরিক্ত বিলে নাভিশ্বাস উঠেছে গ্রাহকদের। গত এপ্রিল মাসের পর থেকে অধিকাংশ গ্রাহকের বিল দ্বিগুণের বেশি আসছে। এপ্রিল মাসের পর থেকে বিলের এই উত্তাপ দিন দিন বেড়েই চলছে। আগে যাদের বিল গড়ে ১২শ থেকে ১৫শ টাকা আসত এখন তাদের বিল আসছে সাড়ে ৩ হাজার টাকার বেশি। মে-জুন মাসে এই বিল এসেছিল ৭-৮ হাজার টাকা।

গ্রাহকদের অভিযোগ, বিতরণ কোম্পানিগুলো পরিকল্পিতভাবে অতিরিক্ত বিল করছেন। তাদের দাবি গড়ে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ বেশি বিল করছেন। প্রিপেইডেও অতিরিক্ত বিল জমা দিতে বলা হচ্ছে। নিয়ম হলো প্রিপেইড গ্রাহকদের কার্ডে যে পরিমাণ টাকা থাকবে সে পরিমাণ বিদ্যুৎ খরচ করতে পারবেন তারা। কিন্তু অভিযোগ, রাজধানীর অনেক প্রিপেইড মিটার নষ্ট। মিটারগুলো মেরামত করা হচ্ছে না। এই সুযোগে অতিরিক্ত বিল করা হচ্ছে বলে অভিযোগ গ্রাহকদের।

চাঁদপুর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-২ এর এক গ্রাহকের জুন মাসের বিল আসে ৮৪ টাকা। কিন্তু জুলাই মাসে তার বিল এসেছে ১৭৩৮ টাকা। ভুক্তভোগীরা বলছেন, গ্রামগঞ্জে এমনিতেও ঠিকমতো বিদ্যুৎ থাকে না। তার ওপর বাড়তি বিলের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, সিস্টেম লস কমাতে গিয়ে বাড়তি বিদ্যুৎ ব্যবহারের বোঝা গ্রাহকের বিলে যোগ করা হচ্ছে।

বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলো বলেছে, জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি দুই মাসে তিন দফায় বিদ্যুতের দাম ১৫শ শতাংশ বেড়েছে। অন্যান্য বছরের তুলনায় ওই সময়ে গরমের তীব্রতাও বেশি ছিল। গরম থেকে বাঁচতে এয়ারকন্ডিশন চালাতে গিয়ে বিদ্যুৎ ব্যবহারের স্ল্যাবও পরিবর্তন হয়। অর্থাৎ যারা আগে ৭৫ ইউনিট থেকে ২০০ ইউনিট পর্যন্ত ব্যবহার করতেন এয়ারকন্ডিশন চালানোর কারণে তাদের ব্যবহৃত বিদ্যুতের পরিমাণ ২০০ ইউনিট ছাড়িয়ে গেছে। এতে বিল করতে হয়েছে ৫.৬২ টাকার পরিবর্তে ৬.৯৫ টাকা হারে। এছাড়া মার্চ-এপ্রিল-মে মাসে বিদ্যুতের ব্যবহার অনেক বেশি হলেও গ্রাহককে সহনীয় রাখার জন্য কোম্পানিগুলো বিল করেছে নির্ধারিত ইউনিট থেকে অনেক কম। সেগুলো এখন সমন্বয় করা হচ্ছে। ফলে এখনো বিল বেশি হচ্ছে। কোম্পানিগুলো আশা করছেন নভেম্বর মাস থেকে বিদ্যুৎ বিল আস্তে আস্তে কমে আসবে।

ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির (ডিপিডিসি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিকাশ দেওয়ান যুগান্তরকে বলেন, বাড়তি বিলের কোনো সুযোগ নেই। বাড়তি বিল করার নির্দেশনা দেওয়ার তথ্যটি সঠিক নয়। তবে মে মাস থেকে অতিরিক্ত গরম পড়ায় বাসবাড়িতে এয়ারকন্ডিশন ব্যবহার বেড়ে গেছে। এতে আগে যে স্ল্যাবে বিল হতো এখন তার চেয়ে বেশি দামের স্ল্যাবে বিল করা হচ্ছে। ফলে বিলের পরিমাণ বেড়ে যেতে পারে। তিনি বলেন, ডিপিডিসির বিল করার জন্য প্রথমে গ্রাহকদের মিটারের ছবি তোলা হয়। ওই ছবি যাচাই-বাছাই করে তারপর বিল করা হয়। তবে মাঝে মধ্যে ভুল হয়। এসব ঘটনায় গ্রাহক অভিযোগ করলে সংশোধন করা হয়। মোহাম্মদ আলী নামে গুলশান এলাকার এক গ্রাহক যুগান্তরকে বলেন, আগে তার বিল আসত গড়ে ২৫শ টাকার মধ্যে। কিন্তু জুন মাসে তার বিল এসেছে সাড়ে ৫ হাজার টাকা।

রাজধানীর মহানগর প্রজেক্টের এক গ্রাহক অভিযোগ করেন, মে মাসে পুরো এসি চালিয়েও বিল এসেছে সাড়ে ৩ হাজার টাকা। জুন মাসে তা বেড়ে হয় সাড়ে ৪ হাজার টাকা। জুলাইয়ে এসি খুব কম চালানোর পরও বিল এসেছে ৬৮০০ টাকা। ধানমন্ডি মধুবাজার ১৬২ নম্বর বাড়ির এক গ্রাহকের আগে প্রতিমাসে গড়ে বিল আসত ১৫শ থেকে সর্বোচ্চ আড়াই হাজার টাকা। মে-জুন মাসে তার বিল এসেছে ৭ হাজার থেকে ৯ হাজার টাকা। ওই ভবনের অন্য গ্রাহকদেরও এভাবে ২-৩ হাজার টাকা অতিরিক্ত বিল আসছে বলে সংশ্লিষ্টরা অভিযোগ করেছেন।

অতিরিক্ত বিলের অভিযোগ সবচেয়ে বেশি পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির বিরুদ্ধে। কারণ হিসাবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গ্রামের গ্রাহকদের বিল বেশি করলেও সে বিষয়ে তারা তেমন অভিযোগ করেন না। গ্রামের মানুষ সবচেয়ে বেশি অবহেলিত। তারা একদিকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লোডশেডিংয়ে ভুগছেন, অপরদিকে বিলও বেশি দিতে হচ্ছে।

ভূতুড়ে বিলের বিষয়ে কনজুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম যুগান্তরকে বলেন, সরকার বিতরণ কোম্পানিগুলোকে সিস্টেম লস কমাতে নিয়মিত লক্ষ্যমাত্রা দিয়ে দেয়। কিন্তু বিতরণ ব্যবস্থাপনার তো সেভাবে উন্নতি হয়নি। ফলে সিস্টেম লস তেমন কমে না। কিন্তু বছর শেষে সাফল্য দেখাতে বেশি বেশি বিল করে সিস্টেম লস কমিয়ে দেখানো হয়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি বিতরণ কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, বিদ্যুতের ব্যবহার যেমন বেড়েছে, তেমনি চুরিও হচ্ছে। নানা কারণে সিস্টেম লস হচ্ছে। অনেক লাইনম্যান গ্রাহকদের হয়রানি করতে এবং বেশি বেশি আদায় দেখাতে বিল বাড়িয়ে দেখাচ্ছে।

জানা গেছে, বাড়তি বিলের এই বোঝা শুধু আবাসিক নয়, ক্ষুদ্র, মাঝারি, বাণিজ্যিক, শিল্প ও অফিস গ্রাহকদেরও দুর্ভোগ বাড়িয়েছে। গত জানুয়ারি থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দুই মাসে তিন দফায় ১৫ শতাংশ বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়।

রাজধানীর শাহজাহানপুরের বাসিন্দা তারেক হোসেন বলেন, ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (ডিপিডিসি) প্রিপেইড গ্রাহকদের আগে যেখানে মাসে ৬০০ টাকা পরিশোধ করতে হতো এখন সেখানে মাসে ১ হাজার টাকার বেশি ব্যয় করতে হচ্ছে। শান্তিনগরের বাসিন্দা হাফিজুর রহমান জানান, প্রিপেইড মিটারে তিনি ১ হাজার টাকা রিচার্জ করেছেন। ১৮-২০ দিন পর আবারও রিচার্জ করতে হয়েছে ৫শ টাকা। প্রিপেইড মিটার চালুর পর থেকে বিদ্যুৎ বিল বাবদ মাসে দেড় হাজার টাকার মতো ব্যয় হয় তার।

ঢাকার ৬৮ এলিফ্যান্ট রোডে বহুতল ভবনের এক বাসিন্দা জানান, তাদের ভবনের ৪০টি প্রিপেইড মিটার ৬ মাস ধরে নষ্ট। এ কারণে ডিপিডিসি কর্তৃপক্ষ তাদের ইচ্ছেমতো বিল করছে। মাসের ১ তারিখে ১১ হাজার টাকা বিল পরিশোধের জন্য ক্ষুদে বার্তা পাঠালেও ওই টাকা পরিশোধ করার পর ফের ৬শ টাকা অতিরিক্ত বিল পরিশোধের জন্য বার্তা পাঠান। ওই ফ্ল্যাট মালিক যুগান্তরকে বলেন, আগে তাদের যে বিল আসত মিটার নষ্ট হওয়ার পর থেকে তাদের গড়ে দ্বিগুণের বেশি বিল দিতে হচ্ছে।

প্রিপেইড মিটার সঠিকভাবে কাজ করে কিনা তা নিয়েও অনেক গ্রাহক প্রশ্ন তুলেছেন। মিটারগুলো বিতরণের আগে ভালোভাবে পরীক্ষা করে দেওয়া হয় কিনা, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। ডিপিডিসির গুলবাগ এনওসিতে প্রিপেইড মিটার অভিযোগ কেন্দ্রে কর্মরত এক কর্মচারী যুগান্তরকে বলেন, সম্প্রতি মিটারকেন্দ্রিক অভিযোগ অনেক বেড়েছে। অনেক সময় স্মার্টকার্ডেও সমস্যা হয়। তিনি বলেন, যাদের ওয়্যারিং সিস্টেম পুরনো, তাদের বিদ্যুৎ খরচ একটু বেশি হচ্ছে।

বর্তমানে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ২৮ হাজার ১৩৪ মেগাওয়াট। এ পর্যন্ত সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন ১৫ হাজার ৬৪৮ মেগাওয়াট। গ্রাহক সংখ্যা ৪ কোটি ৫৪ লাখ। মোট সঞ্চালন লাইন ১৪ হাজার ৯৩৪ সার্কিট কিলোমিটার। বিতরণ লাইন ৬ লাখ ৭৩ হাজার কিলোমিটার। ২০২২ সালের তথ্যমতে, বিতরণ লস ৭ দশমিক ৭৪ শতাংশ।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম