Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

পাসপোর্ট-টিকিট ছাড়া কুয়েতের বিমানে শিশু

১০ কর্মকর্তা প্রত্যাহার তদন্ত কমিটি

Icon

বিশেষ প্রতিনিধি

প্রকাশ: ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

১০ কর্মকর্তা প্রত্যাহার তদন্ত কমিটি

ফাইল ছবি

বড় ধরনের নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়েছে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। মঙ্গলবার রাতে পাসপোর্ট, টিকিট ও বোর্ডিং কার্ড ছাড়া জুনায়েদ নামের ১২ বছরের এক শিশু বিনা বাধায় কুয়েত এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে উঠে পড়ে। এতে নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি হয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এ ঘটনায় বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন ও সিকিউরিটি বিভাগের ১০ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে প্রত্যাহার করা হয়েছে।

গঠন করা হয়েছে পাঁচ সদস্যের একটি উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি। যে এয়ারলাইন্সের ফ্লাইটে এ ঘটনা ঘটে, সেই কুয়েত এয়ারলাইন্সকে শোকজ করা হয়েছে। প্রত্যাহার হওয়া কর্মকর্তাদের মধ্যে বাংলাদেশ বিমানের গ্রাউন্ড সার্ভিস বিভাগের একজন কর্মীও রয়েছেন। বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল এম মফিদুর রহমান যুগান্তরকে বলেছেন, যে ঘটনা ঘটেছে, এটি অত্যন্ত দুঃখজনক ও অপ্রত্যাশিত। ঘটনাটি যাই হোক, ছেলেটি যেভাবেই প্রবেশ করুক, তা কোনোভাবে মেনে নেওয়া যায় না। এখানে এত সিকিউরিটি, এত সিস্টেম, এত নিরাপত্তাব্যবস্থা থাকার পরও এরকম ঘটনা মেনে নেওয়া যায় না। তার মতে, এটি নিরাপত্তা ঘাটতি বলা যাবে না, বরং নিরাপত্তা থ্রেড।

চেয়ারম্যান বলেন, এ ব্যাপারে আমরা যেটা করেছি অর্থাৎ যারা পুরো প্রসেসের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল, তাদের প্রত্যেককে কর্মক্ষেত্র থেকে অপসারণ করা হয়েছে। পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত শুরু হয়েছে। যে চ্যানেল দিয়ে ছেলেটি প্রবেশ করেছে, আই ডোন্ট কেয়ার, তাদের প্রত্যেককে অপসারণ করতে হবে। তাদের কাছ থেকে স্টেটমেন্ট নেওয়া হচ্ছে।

চেয়ারম্যান বলেন, যদিও ছেলেটি ব্রোকেন ফ্যামেলির, মা-বাবার সঙ্গে সম্পর্ক নেই। সে মানসিক ভারসাম্যহীন। বাবা অন্যত্র বিয়ে করেছে। ছেলেটিকে মেনে নেয়নি তারা। তবে সে খুবই ইন্টিলিজেন্ট। সে মিথ্যা পরিচয় দিয়ে বিমানবন্দরে ঢুকেছে। অন্য যাত্রীকে বাবা-মা পরিচয় দিয়ে সে ইমিগ্রেশন ও সিকিউরিটির লোকদের ফাঁকি দিয়েছে। দূরে থাকা মহিলাকে মা দেখিয়ে নিরাপত্তা বেষ্টনী পার হয়েছে। সিকিউরিটির লোকজনও সহজসরলভাবে তাকে ছেড়ে দিয়েছে। ইমিগ্রেশনে আরেক পরিবারের মাঝখানে ঢুকে কাউন্টারের নিচে লুকিয়ে থেকে পরে সুযোগ বুঝে পার হয়েছে। তবে তিনি বলেন, যেভাবেই পার হোক, এটা মেনে নেওয়া অসম্ভব। কারণ, আন্তর্জাতিক যাত্রী হিসাবে একটা ইনফ্যান্ট বেবিকেও পাসপোর্ট দেখিয়ে পার হতে হয়। এমনকি যে কোনো প্রাণী-একটি বিড়াল পর্যন্ত ফ্লাইটে উঠতে হলে সরকারের অনুমতি লাগবে।

ইমিগ্রেশনের পাশাপাশি এসব ক্ষেত্রে প্রতিটি এয়ারলাইন্সেরও অনেক ভূমিকা রয়েছে। এখানে কুয়েত এয়ারলাইন্সেরও অনেক গাফিলতি ছিল। নিয়ম হলো-প্রতিটি প্যাসেঞ্জারকে ফাইনাল গেট পার হওয়ার সময় এয়ারলাইন্স কর্মীদের বোর্ডিং পাশ দেখিয়ে ঢুকতে হয়। এছাড়া বিমানে ওঠার আগে দুই দফা কেবিন ক্রুরা বোর্ডিং কার্ড দেখে যাত্রীদের ভেতরে প্রবেশ করানোর কথা। কাজেই কুয়েত এয়ারলাইন্সেরও গাফিলতি ছিল। এছাড়া বাংলাদেশ বিমানের গ্রাউন্ড সার্ভিস বিভাগের একজন স্টাফও দায়িত্ব অবহেলার জন্য দায়ী। তিনি বলেন, সিসি টিভিতে দেখা গেছে বিমানবন্দরের বিভিন্ন সংস্থার বেশকিছু লোকজনেরও গাফিলতি ছিল। তাদেরও সন্দেহের তালিকায় রেখে তদন্ত করা হচ্ছে। বেবিচক চেয়ারম্যান বলেন, তদন্ত শেষে যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হবে, তাদের সাময়িক বরখাস্ত করা হবে।

এদিকে তদন্ত সূত্র জানিয়েছে, ১০-১২ বছর বয়সি ছেলেটি গোপালগঞ্জের একটি মাদ্রাসার শিক্ষার্থী। শিশুটি পাঁচ দিন আগে বাসা থেকে পালিয়ে যায়। তবে বাসা থেকে পালানো এটি তার প্রথম নয়। এর আগেও একাধিকবার বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছিল সে। পরে নিজে নিজেই বাড়িতে ফিরে যেত। তাই এবার পালানোর পর বাবা-মা আর পুলিশে খবর দেননি।

তদন্ত সূত্র জানায়, শিশুটি জানিয়েছে, একান্ত কৌতূহলবশত প্লেনে উঠেছে। তিন মাসে চারবার বাড়ি থেকে পালিয়ে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যায় সে। এর আগেও প্লেনে চড়তে ব্যর্থ হয়ে বাড়িতে ফিরে গেছে। এবার কৌশল পালটে বিমানবন্দরে ঢোকে শিশুটি। একটি পরিবারের সঙ্গে কথাবার্তার মাধ্যমে মিশে যায় সে। তাই কেউ ধরতে পারেনি যে ছেলেটি সেখানে একা কিংবা তার কাছে কোনো পাসপোর্ট বা বোর্ডিং পাশ নেই।

তার সঙ্গে এভসেক ও বিমানবন্দর থানা পুলিশ একাধিকবার কথা বললেও এর চেয়ে বেশি তথ্য পায়নি তারা।

বুধবার বিমানবন্দর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আজিজুল হক মিয়া বলেন, আগে মাদ্রাসায় পড়লেও বর্তমানে শিশুটি পড়াশোনা করছে না। পরিবার জানে সে বাড়ি থেকে বের হলেও কয়েকদিন পর আবার ফিরে আসবে, তাই পুলিশে জানায়নি। যেহেতু ঘটনাটি একজন শিশু ঘটিয়েছে, আমরা শিশুদের ওভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারি না। তবে সে জানিয়েছে, বিমান দেখতে বিমানবন্দরে এসেছে, লোকজনের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে প্লেনে উঠেছে।

বেবিচক চেয়ারম্যান জানান, বুধবার ভোরে তাকে মা-বাবার কাছে হস্তান্তরের চেষ্টা করলেও শেষ পর্যন্ত তারা শিশুটিকে হেফাজতে নেয়নি। তারা শিশুটিকে না নিয়ে চলে গেছেন। পরে শিশুটিকে তার এক চাচার কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে বলে বিমানবন্দর থানা পুলিশ তাকে জানিয়েছে।

এদিকে বিমানবন্দরে কর্মরত প্রত্যেক কর্মী ডিউটি পাশ ব্যবহার করে চলাফেরা করেন। আর যাত্রীরা পাসপোর্ট ও বোর্ডিং পাশ নিয়ে চলাফেরা করেন। এছাড়া বিমানবন্দরে ঢুকে ইমিগ্রেশনসহ ৮-১০টি ধাপ পেরিয়ে প্লেনে চড়তে হয়। কোনো ধাপেও শিশুটিকে না আটকানোর বিষয়টি নিরাপত্তাহীনতা বলে মন্তব্য করেছেন অনেক যাত্রী।

এভিয়েশন বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এ ঘটনায় কোনোভাবে দায় এড়াতে পারে না শাহজালাল বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ। কারণ, এটি শুধু দেশের ভাবমূর্তি নয়, আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরটি নিরাপত্তা গাফিলতিজনিত হুমকির মুখে পড়বে। আগামী দিনে ঢাকা-নিউইয়র্ক ফ্লাইট চালু করার চেষ্টা চলছে। যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেশন এভিয়েশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফএএ) ঘটনাটি কীভাবে দেখবে, সেটিও সামনে আসবে। তারা বলেছেন, প্রতিবারই বিমানবন্দরে নানা দুর্ঘটনা ঘটছে আর বেবিচক কর্তৃপক্ষ একটার পর একটা তদন্ত কমিটি গঠন করছে। ১০ বছরে দেশের বিভিন্ন বিমানবন্দরে এরকম ৫০টির বেশি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কিন্তু কোনো কমিটির তদন্ত রিপোর্ট আলোর মুখ দেখেনি। তদন্ত কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ী কোনো ব্যবস্থাও নেওয়া হয়নি। কিছুদিন যাওয়ার পর সবকিছু ধামাচাপা পড়ে যাচ্ছে।

এর আগে এক জরিপে বলা হয়েছিল, বিমানবন্দরের খুব কাছেই অনেক উঁচু উঁচু ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। এ কারণেও এর নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়েছে। বিমানবন্দরে প্রবেশকারী যানবাহন নিচ থেকে স্ক্যান করার জন্য চারটি গেটে ক্যামেরা বসানোর জোরালো সুপারিশ করা হয়েছে। তাছাড়া বিশ্বের কোনো বিমানবন্দরের অভ্যন্তরে থাকা গাড়ি বাইরে বের হতে পারে না। কিন্তু শাহজালালের ৮ নম্বর হ্যাঙ্গার গেট দিয়ে প্রতি মিনিটে একটি গাড়ি শাহজালালের ভেতর থেকে বের হচ্ছে আবার ভেতরে প্রবেশ করছে। এসব গাড়ি বের হওয়ার সময় কোনো ধরনের তল্লাশির মুখেও পড়ছে না। বাইরে থেকে বিমানবন্দরের ভেতরে খাবার যাচ্ছে। বিমানবন্দরের ভেতরে বিভিন্ন দোকানের মালিক-কর্মচারীদের জন্য বাইরে থেকে এসব খাবার ভেতরে পাঠানো হচ্ছে। আবার এসব খাবারের প্যাকেট বহনকারী গাড়িগুলো অনায়াসে বাইরে বের হয়ে যাচ্ছে। অভিযোগ আছে, হ্যাঙ্গার গেটের সিকিউরিটি বিভাগের দায়িত্বরত কর্মীদের এক প্যাকেট খাবার দিয়ে এসব গাড়ি অনায়াসে ভেতরে ডুকছে আবার বের হয়ে যাচ্ছে।

২০১২ সালে এক জরিপে বাউনিয়ার বেড়িবাঁধে মানুষ চলাচল বন্ধ করতে একটি আন্ডারপাস বা সুড়ঙ্গ নির্মাণের সুপারিশ করা হয়েছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত সে ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। রানওয়ে-১৪ থেকে বিমানের ওঠানামা দেখতে প্রচুর মানুষ বাউনিয়া অঞ্চলে ভিড় করেন। এমনকি রাতে সেখানে কিছু লেজার লাইটও ব্যবহার করা হয়। যা চালক, উড়োজাহাজ ও বিমানবন্দরের নিরাপত্তার জন্য হুমকি বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

বিমানবন্দরের এ অঞ্চলটিতে আলোক স্বল্পতা রয়েছে। কারণ, ৫৭টি ফ্লাড লাইটের আলো বিমানবন্দরের ১ হাজার ২৯৮ একর জায়গার সব কোনায় পৌঁছায় না। এছাড়া এখানে সিসিটিভি কাভারেজও আশানুরূপ না এবং কিছু কিছু সিসিটিভি ক্যামেরা রাতে ভালো কাজ করে না বলে জানানো হয়েছে। কিন্তু এসব সুপারিশ এখনো আলোর মুখ দেখেনি। প্রতিবেদনে কিছু এলাকায় নাইট-ভিশন সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন এবং সেগুলো কঠোরভাবে পর্যবেক্ষণের সুপারিশ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, বিমানবন্দরের ভেতরে অনেক ঝোপ রয়েছে, যা নিরাপত্তাকর্মীদের দৃষ্টিসীমায় বাধা তৈরি করে। এগুলো নির্দিষ্ট সময় পরপর ছাঁটাইয়ের সুপারিশ করা হয়েছে।

বিমানবন্দরের সামনে নিয়মবহির্ভূতভাবে প্রভাবশালীদের ৫টি বহুতল ভবন নির্মাণ করা হয়েছে, সেগুলো বিমানবন্দরের জন্য বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি করেছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত এগুলোর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এ ভবনের সামনে দিয়ে আশকোনা হজ ক্যাম্প থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত একটি বড় আন্ডারপাস নির্মাণের কথা রয়েছে। কিন্তু ওই ভবনগুলোর জন্য এই আন্ডারপাস নির্মাণ করা যাচ্ছে না।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম