যমুনা নদীর টেকসই ব্যবস্থাপনা
পরামর্শকের থাবা পুনর্বাসন প্রকল্পে
হামিদ-উজ-জামান
প্রকাশ: ২৮ আগস্ট ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বন্যার হাত থেকে নদীর তীরবর্তী জনগোষ্ঠীর সহায়তায় বাস্তবায়ন করা হবে পুনর্বাসন প্রকল্প। কিন্তু এ কাজের জন্য পরামর্শক ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে ৪১ কোটি ৬০ লাখ টাকা। পুরো প্রকল্পটি বাস্তবায়নে মোট ব্যয় হবে ১০২ কোটি ২৩ লাখ টাকা। এ হিসাবে পরামর্শকের পকেটেই যাবে প্রকল্প ব্যয়ের ৪১ শতাংশ অর্থ। ‘যমুনা রিভার সাসটেইনেবল ম্যানেজমেন্ট প্রজেক্ট-১ : ডিজাস্টার রিস্ক ফাইন্যান্সিং (কম্পোনেন্ট-৩)’ শীর্ষক প্রকল্পে এমন প্রস্তাব করা হয়েছে। অনুমোদন পেলে এটি বাস্তবায়ন করবে বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ।
প্রকল্পটি বাস্তবায়নে অনুদান হিসাবে ‘গ্লোবাল রিস্ক ফাইন্যান্সিং ফ্যাসিলিটি’ তহবিল থেকে অর্থায়ন করবে বিশ্বব্যাংক। পরামর্শক খাতে এ ধরনের ব্যয় প্রস্তাবকে অযৌক্তিক বলে মনে করছে পরিকল্পনা কমিশনও। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অনুদানের টাকায় পরামর্শকের থাবা ছাড়া এটি আর কিছুই নয়। এছাড়া বৈদেশিক অর্থায়নের প্রকল্পে দেশীয় পরামর্শকদের প্রাধান্য দেওয়া হয় না। তাদের টাকা থাকায় তারাই সুবিধা নিতে চায়। তবে দেশীয় পরামর্শকদের যথেষ্ট দক্ষতা, অভিজ্ঞতার অভাব এবং সংকটও অস্বীকার করা যায় না।
এ প্রসঙ্গে কথা হয় ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফিন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইএনএম) নির্বাহী পরিচালক ড. মোস্তফা কে. মুজেরীর সঙ্গে। রোববার তিনি যুগান্তরকে বলেন, সত্যিকার অর্থে এ ধরনের প্রকল্পে বিপুল পরিমাণ পরামর্শক ব্যয় অযৌক্তিক। এটা এক ধরনের আর্থিক অনুকম্পা বিতরণ করার মতো অবস্থা। অতীত অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায়, এমন প্রকল্পে পরামর্শক নিয়োগের নামে অনিয়ম এবং আর্থিক অপচয়ের আশঙ্কা থাকে। কেননা এমন প্রকল্প বাস্তবায়নের অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের আছে। এখানে পরামর্শকরা নতুন কী আবিষ্কার করবেন যে, মোট প্রকল্প ব্যয়ের প্রায় অর্ধেকই এ খাতে দিতে হবে? পরামর্শক খাতে এত টাকা ব্যয় কোনোভাবেই যৌক্তিক হবে না। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বৈদেশিক সহায়তা থাকলে যারা অর্থ দেয় তাদের কিছু লাভ বা সুবিধা নেওয়ার প্রবণতা থাকে। এই সুবিধা নেওয়ার বড় মাধ্যম হলো পরামর্শক। তাই দেশীয় পরামর্শকদের প্রাধান্য দিতে চায় না। এক্ষেত্রে একেবারেই অপরিহার্য না হলে বিদেশি পরামর্শক নেওয়া উচিত নয়। কেননা তাদের পরামর্শক অনেক সময় আমাদের দেশের বাস্তবতার সঙ্গে মেলেও না।
আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (পরিকল্পনা অনুবিভাগ) মফিজ উদ্দিন আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, এ বিষয়টি কাগজপত্র না দেখে বলতে পারছি না। আপনি যে পরামর্শক ব্যয়ের কথা বললেন, সেটির যৌক্তিকতা আছে বলেই প্রস্তাব করা হয়েছিল। এরপরও পরিকল্পনা কমিশনের যদি কোনো অবজারভেশন থাকে তবে প্রস্তাবটি ভালোভাবে পরীক্ষা করে দেখা হবে।
সূত্র জানায়, ‘যমুনা রিভার সাসটেইনেবল ম্যানেজমেন্ট প্রজেক্ট : ডিজাস্টার রিস্ক ফাইন্যান্সিং (কম্পোনেন্ট-৩)’ শীর্ষক প্রকল্পটির প্রস্তাব করেছে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের আওতায় বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ। গত ১৬ জুলাই এটি নিয়ে পরিকল্পনা কমিশনে অনুষ্ঠিত হয় প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা। পরে এর কার্যবিবরণী পাঠানো হয়েছে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগে (ইআরডি)। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রকল্পটির মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ১০২ কোটি ২০ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকারি তহবিল থেকে ৩৮ কোটি এবং বিশ্বব্যাংকের তহবিল থেকে ৬০ লাখ ডলার বা ৬৪ কোটি ২০ লাখ টাকা ব্যয় করা হবে। এটি অনুমোদন পেলে চলতি বছর থেকে ২০২৮ সালের জুনের মধ্যে বাস্তবায়নের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে যমুনা নদীর টেকসই ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত পুরো প্রকল্পটি ৩টি কম্পোনেন্টের মাধ্যমে বাস্তবায়নে সহায়তা দেবে বিশ্বব্যাংক। এর মধ্যে কম্পোনেন্ট-১ বাস্তবায়ন করবে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়, কম্পোনেন্ট-২ বাস্তবায়ন করবে নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয় এবং কম্পোনেন্ট-৩ এর আওতায় প্রস্তাবিত প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে।
প্রকল্পের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে, যমুনা নদীসংলগ্ন নির্বাচিত এলাকার জনগোষ্ঠীকে বন্যার কারণে আর্থিক ক্ষতির প্রভাব থেকে রক্ষায় আর্থিক কর্মসূচি তৈরি করা হবে। এছাড়া প্রকল্পের আওতায় দুটি আর্থিক সেবা তৈরি করা হবে। একটি হলো ম্যাক্রো লেবেল বন্যা ঝুঁকি স্থানান্তর সেবা। অন্যটি কমিউনিটি সুরক্ষা তহবিল গঠন। এ কম্পোনেন্টের আওতায় কমপক্ষে ১ লাখ সুবিধাভোগী পরিবারের জন্য আর্থিক সুরক্ষা দেওয়া হবে।
বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন বলেন, এ প্রকল্পের আওতায় সামষ্টিক বা অঞ্চলভিত্তিক বিমার বিষয় থাকতে পারে। সেই সঙ্গে আরও কিছু অর্থনৈতিক স্কিম আছে। তাই কারিগরি পরামর্শক লাগবে। এ ধরনের পরামর্শক দেশে পাওয়াটাও কঠিন। কিন্তু প্রশ্ন হলো পরামর্শকরা কী কাজ করবে? খতিয়ে দেখতে হবে আদৌ এত টাকা ব্যয়ের পরামর্শক প্রয়োজন আছে কিনা। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পরামর্শক দেশি বা বিদেশি এটা বড় কথা নয়, মূল কথা হলো পরামর্শক নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে। যদি এমন নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয় যেখানে দেশি-বিদেশি সবাই অংশ নিতে পারে। তাহলে প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে যোগ্য লোক বা প্রতিষ্ঠান নিয়োগ পাবে। এটি করা গেলে পরামর্শক নিয়োগ প্রশ্নবিদ্ধ হবে না।
পিইসি সভা সূত্র জানায়, সভায় প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য প্রস্তাবিত পরামর্শকের প্রয়োজনীয়তা, সেবার মান, বিষয়, সংখ্যা এবং টিওআরসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। এসব আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে অর্থ বিভাগের প্রতিনিধি সভায় বলেন, পরামর্শক খাতে প্রকল্পের মোট ব্যয়ের ৪১ শতাংশ অর্থাৎ ৪১ কোটি ৬০ লাখ টাকার প্রস্তাব করা হয়েছে। পরে বিস্তারিত আলোচনার পর বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে নেগোসিয়েশন করে পরামর্শক সেবার ব্যয় ও সংখ্যার প্রাক্কলন আরও যুক্তিযুক্তভাবে নির্ধারণ করতে বলা হয়েছে।
সাবেক পরিকল্পনা সচিব মামুন-আল-রশীদ যুগান্তরকে বলেন, এ প্রকল্পে পরামর্শক কতটা প্রয়োজন সেটি আগে নিশ্চিত হতে হবে। কেননা এর আগে বিমা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এবং জীবন বিমা যৌথভাবে এ ধরনের কাজ করেছে সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চলের মৎস্যজীবীদের জন্য। সুতরাং আমাদের শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা আছে। সেটি কাজে লাগানো যেতে পারে। কেননা বিভিন্ন সময় দেখা যায়, পুনর্বাসন কাজে বড় ধরনের চুরির সুযোগ থাকে। সেদিকেও সতর্ক থাকতে হবে। পরামর্শকরা এ প্রকল্পে কী সেবা দেবে, তাদের কাজের ফাইনাল আউটপুট কী হবে সবকিছুই টিওআরে থাকতে হবে। পরে সেসব কাজ বুঝেও নিতে হবে।