Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

এনবিআরের যুগ্ম কমিশনার অপহরণ

সাবেক ও বর্তমান দুই গাড়িচালকই জড়িত

নির্যাতনের ভয়াবহ বর্ণনা মাসুমার * সন্দেহের তির সাবেক স্বামীর দিকে

Icon

যুগান্তর প্রতিবেদন

প্রকাশ: ২৫ আগস্ট ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

সাবেক ও বর্তমান দুই গাড়িচালকই জড়িত

বড় মগবাজারের বাসা থেকে সিদ্ধেশ্বরী স্বামীর বাসায় যাচ্ছিলাম। ১৭ আগস্ট রাত সোয়া ৮টার দিকে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের নয় নম্বর গেটের বিপরীত পাশে পৌঁছলে একটি মোটরসাইকেল আমার গাড়িকে ধাক্কা দেয়। আমার সাবেক ব্যক্তিগত গাড়িচালক মাসুদ ওরফে মাসুম ওই মোটরসাইকেলে ছিলেন। গাড়ি থামালে মাসুদ ও তার সহযোগীরা আমাকে এবং আমার গাড়িচালককে গাড়ির ভেতরেই মারধর শুরু করে। একপর্যায়ে চালককে গাড়ি থেকে বের করে এবং মাসুদ গাড়ি চালিয়ে আমাকে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যায়। নির্যাতন চালিয়ে তারা আমার বাম পা ভেঙে ফেলে। মাথা ও চোখে মারাত্মক আঘাত করে। শরীরের বিভিন্ন স্থানে জখম করে। বৃহস্পতিবার রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে কাতরাতে কাতরাতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) যুগ্ম কমিশনার মাসুমা খাতুন যুগান্তরের কাছে নিজের অপহৃত হওয়ার মুহূর্তের কথা বর্ণনা করেন। 

মাসুমা খাতুন বলেন, ‘১৮ ঘণ্টা অপহৃত থেকে ও ভয়াবহ নির্যাতন সহ্য করে ১৮ আগস্ট দুপুর ২টার দিকে আমি গাড়ি থেকে লাফ দিই। ওইটা ছিল আমার প্রাণরক্ষার সর্বশেষ চেষ্টা।’ গাড়ি থেকে লাফ দিয়ে আমি বাঁচাও বাঁচাও চিৎকার না করলে কেউ আমাকে বাঁচাতে এগিয়ে আসত না। আর কিছুক্ষণ আটকে রাখতে পারলেই অপহরণকারীরা আমাকে মেরে ফেলত। লাশ বস্তাবন্দি করে নদীতে ভাসিয়ে দিত। তিনি আরও বলেন, এ অপহরণের পেছনে শুধু আমার সাবেক গাড়িচালক মাসুদ এবং বতর্মান গাড়িচালক আনোয়ারের নেতৃত্বাধীন চক্রই জড়িত নয়-এর নেপথ্যে আরও অনেকে থাকতে পারে। 

ঘটনার বর্ণনা দিয়ে মাসুমা বলেন, ভিকারুন নিসা স্কুল অ্যান্ড কলেজের সামনে গাড়ি থামানোর পর মাসুদ যখন আমার গাড়িতে উঠে পড়ে তখনই বুঝতে পারি-বড় ধরনের বিপদে পড়তে যাচ্ছি। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই মাসুদের নেতৃত্বে অপহরণকারী চক্রের সদস্যরা আমার গাড়িতে ঢুকে পড়ে। আমি বিপদ বুঝতে পেরে গাড়ি থেকে নামার চেষ্টা করি। পা ও শরীর গাড়ি থেকে বের করে দিই। এ সময় আমি গাড়ির ভেতর ঢুকতে চাইনি। বের হতে প্রাণপণ চেষ্টা করি। বাঁচাও বাঁচাও চিৎকার করি। প্রকাশ্যে জনসম্মুখে এ ঘটনা ঘটলেও কেউ আমাকে বাঁচাতে এগিয়ে আসেনি। লাথি মেরে ও চুলের মুঠি ধরে, কিল-ঘুসি দিয়ে আমাকে পাঁজাকোলে করে তারা গাড়ির পেছনের সিটে ছুড়ে মারে। এরপর একটি চিকন তার দেখিয়ে তারা বলে, ‘এটা দিয়ে তোর গলা কেটে ফেলা হবে।’ তাদের হাতে হাতুড়ি, রেঞ্চ, সুঁই ছিল। গাড়িতে বসেই তারা আমার চোখ তুলে ফেলার এবং হাত-পায়ের আঙুল থ্যাঁতলে দেওয়ার হুমকি দেয়। 

মাসুমা খাতুন বলেন, চক্রের সদস্যরা গাড়ির নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর উচ্চৈস্বরে গান বাজিয়ে ফুলবাড়িয়া, চানখাঁরপুল হয়ে অজ্ঞাত স্থানের উদ্দেশে রওয়ানা দেয়। গাড়িটি নন্দীপাড়ার নির্জন একটি স্থানে গিয়ে থামার পর আমার সাবেক এবং বর্তমান দুই স্বামীর সঙ্গেই কথা বলিয়ে দেয়। তারা যা শিখিয়ে দেয় আমি তাই বলি। বাঁচার জন্য আমি তাদের বলেছি-‘যত টাকা চাও, তোমাদের দেওয়া হবে। আমার গাড়ি নিয়ে যাও। আমি একজন সরকারি কর্মকর্তা। তোমরা আমাকে এভাবে আটকে রাখতে পার না। বাচ্চারা আমার জন্য কান্না করছে।’ এরপরও তারা আমাকে মেরে ফেলার পরিকল্পনা করে। 

মাসুমার অভিযোগ, অপহৃত হওয়ার পর তার স্বজনরা থানায় গেলে পুলিশ জিডি নিতে চায়নি। তার বন্ধু রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মনিরুজ্জামান প্রযুক্তির মাধ্যমে লোকেশন বের করে রমনা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে ফোন দেওয়ার পর পুলিশ জিডি নেয়।

নিজের অবর্ণনীয় কষ্টের কথা বর্ণনা করে মাসুমা বলেন, প্রাণ ভয়ে আমি ১৮ ঘণ্টা ধরে গাড়িতে কুঁকড়ে ছিলাম। ১৮ আগস্ট দুপুর ২টার দিকে সাবেক গাড়িচালক মাসুদসহ কয়েকজন যখন দুপুরের খাবারের জন্য বাইরে যায়। এ সময় তিনজনকে পাহারায় রেখে যায়। আমি খেয়াল করলাম, গাঁজা খাওয়ার পর ওই তিনজন ঝিমাচ্ছে। আমার বাঁচার জন্য জীবনের শেষ চান্স এটা বলে মনে হলো। তখন খুব সতর্কভাবে দেখার চেষ্টা করলাম, গাড়ির দরজা লক করা কিনা। নিজের গাড়ি, তাই বিষয়টি তুলনামূলক সহজ ছিল। বুঝলাম, দরজা লক করা হয়নি। এ সুযোগে দরজা খুলে ভাঙা পা নিয়ে গাড়ি থেকে লাফিয়ে পড়ে বাঁচাও বাঁচাও চিৎকার করি, পাশের একটি বাড়ির নিচে আশ্রয় নেই। আমার গলায় তখন পরিচয়পত্র ছিল। এটা দেখে বাসিন্দারা আমাকে আস্থায় নেন। একটু দূর থেকে গাড়ি দেখিয়ে তাদের বললাম, আমার গাড়িটি রক্ষা করুন। গাড়িতে তিনজন অপহরণকারী আছে। 

পরে স্থানীয়রা গিয়ে অপহরণকারীদের আটক করেন। এ সময় কয়েকজন লোক নামাজ পড়ে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন। তারাও আমাকে সহায়তা করেন। এরপর আমি আমার সাবেক ও বর্তমান দুই স্বামীকে ফোন দেই। পরে পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে তিন অপহরণকারীকে আটক করে। 

মাসুমা বলেন, আমি যখন গাড়ি থেকে লাফ দিই তখন চালক গাড়িতে ছিল না। এ কারণে তারা গাড়ি চালাতে পারেনি। তারা আমাকে হত্যার পরিকল্পনা করছিল-এটা আমি পরিষ্কার বুঝতে পারছিলাম। তারা আমার গাড়ির নম্বর প্লেটের ওপর কাগজ দিয়ে ভুয়া নম্বর প্লেট লিখে রাখে। তাদের সব মোবাইল ফোনের সিম ফেলে দেয়। তিনি বলেন, অপহরণের ঘটনায় বর্তমান গাড়িচালক আনোয়ারও জড়িত। এক প্রশ্নের জবাবে মাসুমা খাতুন বলেন, যে তিনজন ধরা পড়েছে তারা ভাড়াটিয়া। মূল হোতা মাসুদকে কেন পুলিশ গ্রেফতার করছে না? চুরি, ছিনতাই এবং হত্যাসহ বেশ কয়েকটি মামলা আছে তার নামে। ১০ বছরের ছেলেকেও সে কুপিয়েছে।

এনবিআরের যুগ্ম কমিশনার মাসুমা এবং তার স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে আরও জানা গেছে, চাঞ্চল্যকর এ ঘটনার পেছনে তার সাবেক স্বামী হারুনুর রশিদের হাত থাকতে পারে। এ বিষয়ে বক্তব্য নিতে হারুনের বাসায় গেলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। এমনকি যুগান্তরের সাংবাদিক পরিচয়ে তার হোয়াটসঅ্যাপে খুদেবার্তা পাঠানো হলেও তার সাড়া পাওয়া যায়নি। তবে তিনি ওই খুদে বার্তাটি ‘সিন’ করেছেন।

মাসুমার বর্তমান স্বামী ইলিয়াস খান যুগান্তরকে বলেন, ৩১ জুলাই আমার ও শ্বশুর বাড়ির লোকজন একসঙ্গে সিলেটের টাঙ্গুয়ার হাওড়ে ঘুরতে যাই। ১ আগস্ট গাড়িচালক মাসুদ অসদাচরণ করে। এ কারণে তার কাছ থেকে গাড়ির চাবি নিয়ে নেন মাসুমা। তাকে অন্য হোটেলে থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়। কিন্তু সিলেটে অবস্থান না করে মাসুদ ঢাকায় এসে হারুনুর রশিদের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করেন। 

ইলিয়াস খান আরও বলেন, মাসুমাকে অপহরণ করার দুই-তিন দিন আগে সন্ত্রাসীরা নারীর ভুয়া ফেসবুক আইডির মাধ্যমে আমাকে রিকোয়েস্ট পাঠায়। অপহরণের পর সুন্দরী তরুণীর ছবি দিয়ে তৈরি করা ওই ফেসবুক আইডি থেকে আমাকে হাতিরঝিলে গিয়ে দেখা করতে বলা হয়। আমি তাদের ফাঁদে পা দিইনি। হাতিরঝিলে গেলেই আমাকে অপহরণ করা হতো। তিনি বলেন, আমার স্ত্রীকে অপহরণের পর তাকে সন্ত্রাসীরা হুমকি দিয়ে বলে, ‘ধর্ষণের পর তোকে আগের স্বামীর কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হবে।’ মাসুমাকে উদ্ধারের পর মাসুদ আমাকে হুমকি দিয়ে বলেছে, ‘তোকেও অপহরণ করা হবে। 

তুই কেন মাসুমাকে বিয়ে করেছিস?’ তাই সার্বিকভাবে আমার মনে হচ্ছে-এ ঘটনার সঙ্গে মাসুমার সাবেক স্বামী হারুনুর রশিদ জড়িত থাকতে পারে। 

বৃহস্পতিবার দুপুরে মাসুমার সাবেক স্বামী হারুনুর রশিদের বড় মগবাজারের বাসায় তার ছোট ছেলে আরিয়ানের সঙ্গে কথা হয়। মতিঝিল আইডিয়ালের দশম শ্রেণির ছাত্র আরিয়ান জানায়, মাকে দেখে থানায় কান্নায় ভেঙে পড়ি। তার চেহারার দিকে তাকানো যাচ্ছিল না। সে বলে, আমি জন্মের পর থেকে দেখে আসছি বাবা-মায়ের মধ্যে বিরোধ চলছে। প্রথমদিকে আমরা সবাই একই ফ্ল্যাটে থাকলেও পরে পাশাপাশি দুই ফ্ল্যাটে মা-বাবা আলাদা থাকতেন। আমি বাবার সঙ্গে এবং দুই বোন মায়ের সঙ্গে থাকতেন। ২২০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট দুটি বাবা কিনেছেন। একটি বড় বোনের নামে কেনা হয়েছে। বোনের বিয়ের পর একই ভবনে আরেকটি ফ্ল্যাট নেওয়া হয়। কিন্তু বোন ওই ফ্ল্যাটে থাকতেন না। আমাদের সবার অগোচরে সেখানে মা তার দ্বিতীয় স্বামীকে নিয়ে সময় কাটাতেন। তারা যে বিয়ে করেছেন-সেটি আগে জানতাম না। একদিন বাবা দুজনকে একসঙ্গে বেডরুমে দেখার পর, বাসায় অনেক ভাঙচুর করেন। ওইদিন দ্বিতীয় বিয়ের কথা স্বীকার করেন মা। 

ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারের উপকমিশনার ফারুক হোসেন বলেন, মাসুদ ও তার সহযোগীরা পেশাদার অপহরণকারী চক্রের সদস্য। মাসুদের পরিকল্পনাতেই এ ঘটনা ঘটেছে। তাকে গ্রেফতার করতে পারলেই সব জানা যাবে। এছাড়া এ অপহরণের সঙ্গে অন্য কোনো বিষয় আছে কিনা সেটিও জানা যাবে। রমনা থানার ওসি আবুল হাসান বলেন, এ ঘটনার তদন্ত চলছে। তাই এ নিয়ে এ মুহূর্তে কোনো মন্তব্য করব না।
 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম